অত্যন্ত খারাপ আবহাওয়া এবং হুদায়ফা ইবনুল ইয়ামানের (রা) ভূমিকা | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৪, ওদিকে সেই শুক্রবারের রাতেই আবহাওয়া ভীষণ খারাপ হতে শুরু করে। সেটা ছিল সেই বছরের সবচেয়ে খারাপ রাত। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে আকাশে কালো মেঘ জমতে শুরু করে। শহরজুড়ে বইতে শুরু করে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাস। কিছু সাহাবি বর্ণনা করেছেন, এর চেয়ে বেশি দুর্যোগময় আবহাওয়া তাদের জীবনে আগে কখনও আসেনি।
সেই রাতেই নবিজি (সা) সাহাবিদের মধ্য থেকে একজন স্বেচ্ছাসেবক চাইলেন যে গিয়ে কুরাইশদের ওপর নজরদারি করবে এবং সেখানে কী ঘটছে তা জেনে নেবে। এই অবিশ্বাস্যরকম সাহসী এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য এগিয়ে এলেন হুদায়ফা ইবনুল ইয়ামান। নবিজির (সা) গোপনীয় তথ্য সংরক্ষণকারী হিসেবে সাহাবিদের মধ্যে হুদায়ফার সুনাম ছিল।
অত্যন্ত খারাপ আবহাওয়া এবং হুদায়ফা ইবনুল ইয়ামানের (রা) ভূমিকা | খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধ-৪ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

হুদায়ফা হলেন সেই সাহাবি যাঁর পিতা (আল-ইয়ামান) দুর্ঘটনাক্রমে ওহুদের যুদ্ধে নিহত হলে তিনি উদারতাবশত তাঁর পিতার খুনিদের শুধু ক্ষমাই করেননি, রক্তমূল্যও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন (৪৮তম পর্বে আলোচনা করেছি)। তিনিই সেই সাহাবি, যিনি বদরের যুদ্ধের আগে মরুভূমির মাঝখানে তাঁর পিতাসহ কুরাইশদের হাতে ধরা পড়েছিলেন এবং কুরাইশরা অস্ত্রের মুখে তাঁদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিল যে তাঁরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন না (৩৬তম পর্বে আলোচনা করেছি)।
আহজাবের যুদ্ধে কুরাইশদের ওপর নজরদারির ওই ঘটনা হুদায়ফা বহু বছর পরে নিজের মুখে বর্ণনা করেন, যা সহিহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদিসগ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। হুদায়ফা তখন বৃদ্ধ বয়সে ইরাকে বসবাস করছিলেন। একদিন এক সমাবেশে কিছু লোক তাঁর কাছে নবিজির (সা) সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কাহিনি শুনতে চায় । হুদায়ফা তাদের কিছু কাহিনি বললে এক যুবক মন্তব্য করে, “আমি যদি তখন জন্মাতাম, তাহলে নবিজিকে (সা) হাঁটতেও দিতাম না। আমি তাঁকে আমার পিঠে বয়ে বেড়াতাম।” অর্থাৎ সে নিজেকে সাহাবিদের চেয়ে উত্তম একজন মুসলিম মনে করত। হুদায়ফা যুবকটির এই মন্তব্য শুনে আহজাবের সেই রাতের কাহিনি এভাবেই বর্ণনা করেন:
“আমার মনে আছে আবু বকর, উমর, উসমান, আলি, উবায়েদ প্রমুখ সাহাবি সেই রাতে নবিজির (সা) সঙ্গেই ছিলেন। চারিদিকে তীব্র বাতাস বইছিল, তার ওপর ছিল প্রচণ্ড শীত। আমাদের এক দিকে ছিল কুরাইশ, আরেক দিকে বনু কুরায়জা। (এটি কোরানের [৩৩:১০] আয়াতের একটি রেফারেন্স।) আমাদের পরিবারগুলো তাদের আক্রমণের শিকার হতে পারে ভেবে আমরা উৎকণ্ঠিত ছিলাম। এত বেশি অন্ধকার ও হিমশীতল রাত আর আমাদের জীবনে আগে কখনও আসেনি। বাতাসের আওয়াজ ছিল বজ্রপাতের মতো তীব্র। আর অন্ধকার এতটাই ঘন ছিল যে আমরা হাত বাড়ালে নিজেদের আঙুল পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না।”
বৈরী আবহাওয়া ছাড়াও সাহাবিরা পুরো এক মাসের অবরোধে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত এবং হতাশাগ্রস্ত। তাঁরা নিজেদের নিজ পরিবারের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত হুদায়ফা বলে চললেন, “(সেই রাতে) নবিজি (সা) উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, *এখানে কে আছে যে আমাকে শত্রুর খবর এনে দিতে পারবে? যে পারবে কেয়ামতের দিন আমি তার সঙ্গী হব।’ সাহাবিদের মধ্যে তখন কেউই কোনো কথা বলছিল না। তাই নবিজি (সা) আবার বললেন, ‘কে আছে যে আমাকে শত্রুর খবর এনে দিতে পারবে? যে পারবে কেয়ামতের দিন আমি তার সঙ্গী হব।’ এবারও সাহাবিদের দিক থেকে কোনো সাড়া এল না। নবিজি (সা) তৃতীয়বার একই কথা বললেন ।

পর পর তিনবার বলার পরেও কেউই এগিয়ে এল না। হুদায়ফা বর্ণনা করেছেন, “তখন নবিজি (সা) ডাক দিলেন, ‘ওহে হুদায়ফা।’ তাঁর ডাকে আমি উঠে দাঁড়ালাম। তিনি বললেন, ‘তুমি যাও, আমাকে খবর এনে দাও। যেহেতু তিনি আমার নাম ধরে ডেকেছিলেন, তাই আমাকে যেতেই হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে কয়েকটি বিষয় আমাদের জন্য লক্ষণীয়:
১. অবরোধের এক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর সাহাবিদের জন্য পরিস্থিতি কতটা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
২. এখানে হুদায়ফার সততা ও ভদ্রতার পরিচয় মেলে। ঘটনাটি যেমন ঘটেছিল তিনি ঠিক তেমনই বর্ণনা করছেন, নিজেকে বড় করে ফুটিয়ে তোলা কিংবা জাহির করার কোনো চেষ্টা করেননি। তিনি বলেছেন, যেহেতু নবিজি (সা) তাঁকে নাম ধরে ডেকে যেতে বলেছিলেন, তাই তাঁকে যেতেই হয়েছিল (অর্থাৎ যাওয়া ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় ছিল না)।
৩. এখানে আমরা মুস্তাহাব (যে ভালো কাজ করার পরামর্শ বা উৎসাহ দেওয়া হয়) এবং ওয়াজিবের (বাধ্যতামূলক) মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করি। যখন নবিজি (সা) বলেন, ‘কে যাবে’, তখন সাহাবিরা বুঝতে পেরেছিলেন যে এটি মুস্তাহাব, অর্থাৎ কেবল একটি অনুরোধ, কোনো আদেশ নয়। কিন্তু যখন তিনি হুদায়ফাকে নাম ধরে ডেকে যেতে বললেন, তখন হুদায়ফা বুঝতে পারলেন, যাওয়াটা তাঁর জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে। ৪) এখানে আমরা নবিজির (সা) কাছে হুদায়ফার গুরুত্ব ও অবস্থান দেখতে পাই।
সকল সাহাবির মধ্য থেকে তিনি তাঁকে বেছে নিয়েছিলেন। ৫. নবিজি (সা) তাঁর সাহাবিদের ভালো করে চিনতেন। তিনি জানতেন কোন সাহাবি কোন কাজের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। স্বাভাবিকভাবেই তিনি এই কাজে কোনো কুরাইশ সাহাবিকে (আবু বকর, উমর, উসমান, আলি, জুবায়ের ইবনুল আওয়াম প্রমুখ) পাঠাতে পারছিলেন না, কারণ এমন কাউকে পাঠানো উচিত যাকে মক্কার কুরাইশরা চিনতে পারবে না। তা ছাড়া হুদায়ফা বদরের যুদ্ধে অংশ নেননি, তাই মক্কার কুরাইশরা তাঁকে চেনে না।
হুদায়ফা দাঁড়িয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি কিছুটা ভয় আর কিছুটা শীতে থর থর করে কাঁপছিলেন। নবিজি (সা) তখন তাঁর জন্য একটি দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ, হুদায়ফাকে তার সামনের দিক, পেছনের দিক, ডান দিক ও বাম দিক থেকে, এবং উপর ও নিচের দিক থেকে রক্ষা করুন।” হুদায়ফা বলেছেন, “এই দোয়ার পর আমার মন থেকে সব ভয় ও উৎকণ্ঠা নিমেষেই দূর হয়ে গেল।”
তারপর তিনি বেরিয়ে গিয়ে সেই অন্ধকার রাতে তীব্র বাতাসের মধ্যে হাঁটতে শুরু করলেন। তিনি তা কীভাবে পারলেন তা কেবল আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই জানেন। এক সময় তিনি কুরাইশদের শিবিরের কাছে পৌঁছলেন। আশপাশটা একটু দেখে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে চুপিসারে সেখানে ঢুকে পড়লেন। তিনি কুরাইশদের শিবিরের ভেতরে যা দেখলেন তা এভাবে বর্ণনা করেছেন: “আমি একজনকে পেছন থেকে দেখতে পেলাম, যাকে একজন নেতার মতো মনে হলো । আমি বুঝতে পারলাম, এই লোকটিই আবু সুফিয়ান।”
হুদায়ফা আৰু সুফিয়ানকে আগে কখনও দেখেননি। একপর্যায়ে তিনি আৰু সুফিয়ানকে সরাসরি আক্রমণ করার মতো দূরত্বে চলে গিয়েছিলেন। মনে মনে প্রায় স্থির করে ফেলেছিলেন যে, তিরধনুক বের করবেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই তাঁর মনে পড়ে গেল আসার আগে নবিজি (সা) তাঁকে বলেছেন, “তাদের কাছ থেকে নিজেকে এবং আমাদের আড়ালে রেখো (অর্থাৎ নিজেকে আর আমাদের তাদের কাছে ধরা দিও না)।” তাই তিনি আক্রমণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন। তারপর স্থির হয়ে বসে তিনি যে কাজের জন্য এসেছেন, অর্থাৎ সেখানে কী ঘটছে, তা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পর আবু সুফিয়ান কুরাইশদের উদ্দেশে বলতে শুরু করল, “আমি এখন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে যাচ্ছি। অতএব তোমরা প্রত্যেকে নিজের পাশে বসা লোকটিকে ভালো করে দেখো সে বিশ্বাসযোগ্য কি না।” তখন ছিল ঘুটঘুটে অন্ধকার, কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। আবু সুফিয়ান তাই নিশ্চিত হতে চাইছিল সেখানে উপস্থিত সবাই তার নিজের দলের (কুরাইশের) লোক। হুদায়ফা দেখলেন, তিনি এখন ধরা পড়ে যেতে পারেন।
তাই কালবিলম্ব না করে স্বপ্রণোদিত হয়ে তাঁর ডানদিকে বসা লোকটির হাত ধরে বললেন, “তুমি কে?” লোকটি নিজের পরিচয় দিলে হুদায়ফা বামদিকের লোকটির হাত ধরে বললেন, “তুমি কে?” দ্বিতীয় লোকটিও নিজের পরিচয় দিল। হুদায়ফা আগ বাড়িয়ে এই কাজটি করলেন যাতে তাঁর নিজের পরিচয় কাউকে না দিতে হয়। এটি মনস্তত্ত্বের ব্যাপার। তিনি তাঁর দুই পাশের মানুষদের সঙ্গে এমন আত্মবিশ্বাস ও কর্তৃত্বের সুরে কথা বলেছিলেন যে কেউ তাঁকে সন্দেহ করেনি।
আরও পড়ুনঃ