মাঝামাঝি অবস্থানে আসার চেষ্টা | কুরাইশদের বিরোধিতা-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

মাঝামাঝি অবস্থানে আসার চেষ্টা | কুরাইশদের বিরোধিতা-১, এরপরে কুরাইশরা আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে একটা মাঝামাঝি অবস্থানে আসার চেষ্টা করেছিল। এটাকে ঘুষের চেষ্টাও বলা যেতে পারে। কারণ তারা দেখতে পাচ্ছিল যে, মানুষ একে একে ধর্মান্তরিত হচ্ছে, তাদের তথাকথিত সমাজের কাঠামো ভেঙে যাচ্ছে এবং পরিস্থিতি ক্রমশই তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই তারা নবিজিকে (সা) বলল, “এসো, আমরা একটা সমঝোতা করি। এক বছর আমরা সবাই মুসলিম হব, পরের বছর আমরা সবাই আমাদের দেবতাদের (প্রতিমা) পূজা করব।” এভাবেই তারা একটা আপস করতে চেয়েছিল। কিন্তু তওহিদের প্রশ্নে তো কোনো প্রকার আপস হতে পারে না।

 

 

মাঝামাঝি অবস্থানে আসার চেষ্টা | কুরাইশদের বিরোধিতা-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

মাঝামাঝি অবস্থানে আসার চেষ্টা | কুরাইশদের বিরোধিতা-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

এ বিষয়েই আল্লাহ সুরা কাফেরুন নাজিল করেন: “বলো, ‘হে কাফেররা! আমি তার ইবাদত করি না যার ইবাদত তোমরা কর। আর তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও যার ইবাদত আমি করি। আর আমি ইবাদতকারী হব না তার যার ইবাদত তোমরা করে আসছ। আর তোমরাও ইবাদতকারী হবে না তাঁর যার ইবাদত আমি করি। তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আর আমার ধর্ম আমার।’ [সুরা কাফেরুন, ১০৯১-৬] এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, কুরাইশরা যেখানে আল্লাহর ইবাদতই করছে সেখানে ‘আমি তার উপাসনা করি না যার উপাসনা তোমরা কর’ কথাটির কী অর্থ হতে পারে। এর উত্তর হচ্ছে: আপনি যখন শিরকের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করেন তখন প্রকৃতপক্ষে আপনি আল্লাহর ইবাদত করেন না।

দ্বিতীয় ও চতুর্থ আয়াতের মধ্যে পার্থক্য কী তা সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে দশটিরও বেশি মত আছে। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার মত অনুসারে, দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি আল্লাহ ও দেবতাদের বোঝায়, অর্থাৎ যাদের উপাসনা করা হয়। অন্যদিকে, চতুর্থ ও পঞ্চম আয়াতে ইবাদতের ক্রিয়াকলাপগুলোকে বোঝায়, অর্থাৎ উপাসনার জন্য যে কাজগুলো করা হয় (উদাহরণস্বরূপ: মুসলিমদের নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি; এবং মুশরিকরা প্রতিমাদের সামনে তির নিক্ষেপ করা, তালি দেওয়া, গান গাওয়া, শিস দেওয়া ইত্যাদি)।

একবার কুরাইশরা আবু তালিবের বাড়িতে বৈঠক ডেকে নবিজির (সা) কাছে সরাসরি প্রস্তাব দেয়, “তোমার এই ধর্মপ্রচার থেকে মুক্তি পেতে আমরা কী করতে পারি?” জবাবে নবিজি (সা) বললেন, “আমি আপনাদের কাছ থেকে কেবল একটি কথা শুনতে চাই।” তারা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মাত্র একটি কথা? আমরা তোমার দশটা কথা শুনব।” তারা ধরে নিয়েছিল যে এটি সমঝোতার জন্য কেবল ‘একটি শর্ত’।

নবিজি (সা) বললেন, “আমি চাই তোমরা শুধু কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই) পড়।” এর প্রত্যুত্তরে তারা যা বলেছিল তা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে প্রকাশ করেছেন: “সে কি সব ইলাহের (উপাস্যের) পরিবর্তে এক ইলাহ (উপাস্য) বানিয়ে নিয়েছে? নিশ্চয়ই এটা এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার।” [সুরা সাদ ৩৮:৫] নবিজিকে (সা) সরাসরি মুখের প্রস্তাব দেওয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনাটি হলো উতবা ইবনে রাবিয়ার। উতবা ছিল বনু হাশিম গোত্রের একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। সে ছিল নবিজির (সা) দূর সম্পর্কের এক চাচা।

প্রাসঙ্গিক বলতে হয়, এই সেই ব্যক্তি যে তায়েফে খ্রিষ্টান ভৃত্য বালককে দিয়ে নবিজির (সা) কাছে আঙুর পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল। সে বদরের যুদ্ধের আগে কুরাইশদের নিরুৎসাহিত করার জন্য বলছিল, “হে আমার সম্প্রদায়। ওখানে তোমার ভাই আছেন, তোমার পিতা আছেন, তোমার চাচা আছেন, কীভাবে তুমি তাদের সঙ্গে লড়াই করবে? তোমরা কি যুদ্ধের জন্য যাচ্ছ? তোমরা কি ওই লোকগুলোকে মেরে ফেলতে যাচ্ছ? যুদ্ধে কে জিতবে? যুদ্ধে যদি তুমি মারা যাও তো মারা গেলে।

আর যদি জিতে যাও তাহলে নিজের ভাইকে হত্যা করলে। কীভাবে তুমি নিজের ভাইয়ের খুনি হতে চাইছ?” এভাবেই উতবা ইবনে রাবিয়া এক মর্মস্পর্শী খুতবা দিয়ে বদর যুদ্ধ পরিহার করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আবু জেহেল সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে লোকদের তার কথা অগ্রাহ্য করতে বলেছিল। শেষ পর্যন্ত উতবা বদরের যুদ্ধে কুরাইশদের পক্ষে অংশ নিয়েছিল।

কুরাইশরা আলোচনায় বসে মুহাম্মদকে (সা) অভিশাপ দিচ্ছে, তাঁকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করছে। উত্তরাও সেখানে উপস্থিত। তাদের মধ্যে কথোপকথন ছিল এ রকম: উতবাঃ তোমাদের মধ্যে কেউ কি তাঁর সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছ? কুরাইশরা না, করিনি। উতবা ঠিক আছে। তবে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। আমাকে প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করো এবং তোমাদের পক্ষ থেকে আমাকে তাঁর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি দাও। আমরা তাঁকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে জানি। আমি নিশ্চিত যে আমরা কিছু একটা উপায় বের করতে পারব।

কুরাইশরা: ঠিক আছে। তুমি যেভাবে ভালো মনে কর সেভাবেই করো। তুমি আমাদের প্রতিনিধি। তার সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছার জন্য আলোচনার চেষ্টা করো।

কুরাইশদের অনুমতি পেয়ে উতবা নবিজির (সা) কাছে গেল। নবিজি (সা) তখন কাবার সামনে বসে ছিলেন। উতবা তাঁকে বলল, “হে আমার ভাতিজা, তুমি তোমার বংশমর্যাদা সম্পর্কে জানো। তুমি এমন একটি নতুন ধারণা নিয়ে এসেছ যার ফলে সমাজে এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হে মুহাম্মদ। তুমি কি তোমার পিতা আবদুল্লাহর চেয়েও উত্তম? তুমি কি তোমার পিতামহ আবদুল মুত্তালিবের চেয়েও উত্তম?”

স্পষ্টতই, এগুলো ছিল কৌশলগত প্রশ্ন। উত্তরা জানত যে, মুহাম্মদ (সা) ছিলেন একজন উত্তম ব্যক্তি। কিন্তু তাঁকে তাঁর পিতা কিংবা পিতামহের চেয়েও উত্তম বলে অভিহিত করা ছিল ওই জাহেলি সমাজের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গর্হিত ও অধার্মিক কাজ, বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি হন আবদুল মুত্তালিব (মক্কার সেই সময়ের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি)।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

নবিজি (সা) এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া থেকে বিরত থাকলেন। এর মধ্য দিয়ে আমরা নবিজির (সা) অপার বিচক্ষণতার পরিচয় পাই। যখন কেউ আপনাকে ফাঁদে ফেলার জন্য কৌশলী প্রশ্ন করে, তখন সেটার উত্তর দিতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। মুসলিম হিসেবে আমাদের মিথ্যা বলার সুযোগ নেই। আমাদের ধর্ম আমাদের দ্বিমুখী ভূমিকার অনুমতি দেয় না। প্রশ্নকর্তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সব সময় সম্ভব নয়।

প্রত্যেক মানুষেরই বুদ্ধিবৃত্তিক স্তর আলাদা। উতবার কাছে আবদুল মুত্তালিব ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আরব, আর মুহাম্মদ (সা) তাঁর নাতি মাত্র। নবিজি (সা) উতবার এই কৌশলটি বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বলতে পারতেন, ‘অবশ্যই আমি আরও উত্তম কারণ আমি তওহিদে বিশ্বাসী এবং সে শিরকে বিশ্বাসী।’ কিন্তু নবিজি (সা) চুপ করে রইলেন।

উতবা বলে চলল, “আমরা কখনও তোমার মতো সম্ভাবনাময় কোনো যুবককে দেখিনি যে উল্টো পথে চলছে। তুমি আমাদের সমাজকে ভেঙে দিয়েছ। তুমি আমাদের মধ্যে এত সম্ভাবনাময় ছিলে! কিন্তু তোমার তুলনায় অন্য কোনো যুবককে তার সম্প্রদায়ের জন্য এত বেশি ক্ষতি করতে আমরা আর দেখিনি। 1 আরবের অন্যসব উপজাতি আমাদেরকে নিয়ে বিদ্রুপ করছে, জনগণ তোমার এই নতুন ধর্মকে নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করছে, তুমি আমাদের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছ। তুমি এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছ যে গৃহযুদ্ধ শুরু শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ, তাই আমার কথা শোনো। আমি তোমাকে কিছু প্রস্তাবদিচ্ছি।

সম্ভবত তুমি এগুলোর এক বা একাধিক প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হবে: 

(১) তুমি যদি অর্থ-সম্পদ চাও, তাহলে আমরা তোমাকে এত বেশি অর্থ দেব যে তুমি হবে আরবদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী।

(২) তুমি যদি ক্ষমতা চাও, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের রাজা বানাব। (কুরাইশের রাজা ছিল না, তাদের ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের ভিন্ন ভিন্ন নেতা ছিল। কিন্তু তারা এখন ইসলামের বিরোধিতা করার জন্য এতটাই মরিয়া যে তারা একত্রিত হতে ইচ্ছুক)।

(৩) তুমি যদি কোনো নারীকে চাও, তাহলে তোমার পছন্দসই যে কাউকে বেছে নাও, আমরা নিশ্চিত করব যে সে তোমাকে বিয়ে করবে। [সর্বোপরি, এই তিনটি জিনিসই বেশিরভাগ পুরুষের কাম্য: অর্থ, ক্ষমতা এবং নারী; তবে অবশ্যই নবিজির (সা) নয়।] (৪) তুমি যদি মনে কর যে তুমি মানসিকভাবে অসুস্থ, আমরা তোমাকে নিরাময়ের জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করব।

উতবার প্রস্তাব দেওয়া শেষ হলে নবিজি (সা) বললেন, “হে আবা আল- ওয়ালিদ। আপনার কথা শেষ হয়েছে?” উতবা উত্তরে বলল, “আমি আমার কথা শেষ করেছি।” এবার নবিজি (সা) বললেন, “এখন আমার কথা শুনুন।” এ কথা বলে তিনি সুরা ফুসিলাত পাঠ করতে শুরু করলেন। অন্য কুরাইশদের মতোই উতবা কখনও কোরান তেলাওয়াত শোনেনি।

প্রস্তাব দেওয়া শেষ করার পর উতবা প্রথমে মুখ ঘুরিয়ে বসলেও নবিজির (সা) মুখ থেকে একের পর এক কোরানের আয়াত শুনতে শুনতে তার অভিব্যক্তি বদলে যেতে শুরু করে। তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। নবিজি (সা) কোরান তেলাওয়াতের এক পর্যায়ে এই আয়াত পর্যন্ত পৌঁছলেন: “এর পরও তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদেরকে বলো, ‘আমি তো তোমাদের এক ধ্বংসাত্মক শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেছি, যেমন শান্তির সম্মুখীন হয়েছিল আদ ও সামুদ।”

 

মাঝামাঝি অবস্থানে আসার চেষ্টা | কুরাইশদের বিরোধিতা-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

[সুরা হা-মিম সিজদা, ৪১:১৩] এই আয়াতটি এতটাই শক্তিশালী ও ভীতিজনক ছিল যে উতবা লাফিয়ে উঠে নবিজির (সা) মুখের ওপর হাত রেখে বলল, “আল্লাহর কসম, আমি তোমার কাছে মিনতি করছি, রক্তের আত্মীয় হিসেবে তোমার ওপর আমার যে অধিকার রয়েছে তা দিয়ে আমি তোমাকে অনুরোধ করছি—আমাকে এই শাস্তি দিয়ো না!” এই আয়াতটা তাকে এতটাই আপ্লুত করেছিল যে সে রীতিমতো কাঁপতে শুরু করে।

তারপর উতবা কুরাইশদের কাছে ফিরে গিয়ে বলল, “আমার কথা শোনো। এই লোকটিকে আর ঘাঁটিও না। কারণ আমি তাঁর কাছ থেকে এমন কিছু কথা শুনেছি যা আগে কখনও শুনিনি।” কিছু স্কলারের মতে, উপর্যুপরি শিরকের ফলে মুশরিকদের অন্তরে একটা পর্দা পড়ে যাওয়ার কারণে কোরানের কিছু কিছু আয়াত তারা বুঝতে পারত না, যেমনটি আল্লাহ কোরানে বলেছেন: “আল্লাহ তাদের হৃদয় ও কান মোহর (রুদ্ধ) করে দিয়েছেন, তাদের চোখের ওপর রয়েছে আবরণ এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশান্তি।”

[সুরা বাকারা, ২:৭] উতবা আরও বলেছিল, “আমি তাঁর কথাগুলোর মর্মও পুরোপুরি বুঝতে পারিনি। তবে এটুকু বুঝেছি যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। এখন অন্য আরবরা যদি তাঁকে মেরে ফেলতে পারে তাহলে আমাদের কোনো দায় থাকবে না (অর্থাৎ নিজের উপজাতির লোককে নিজেদের মেরে ফেলতে হবে না)। কিন্তু যদি সে আরবদের পরাজিত করতে পারে, তবে আল্লাহর কসম, তার বিজয় আমাদের (নিজস্ব গোত্রের) বিজয়; তার শক্তিই আমাদের শক্তি।”

উতবার কথা শুনে কুরাইশরা বলল, “সে অন্য সবার মতো তোমাকেও সম্মোহিত করেছে।” তারা তখনও সত্যটা গ্রহণ করতে পারছিল না। প্রকৃতপক্ষে কোরানের মাধ্যমেই আরবরা পরবর্তীকালে সম্মানিত হয়েছে, বিশ্বকে শাসন করেছে। আল্লাহ তায়ালার কথায়: “(হে মানবজাতি!) আমি তোমাদের ওপর কিতাব নাজিল করেছি, যার মধ্যে তোমাদের জন্য উপদেশ আছে, তবুও কি তোমরা বুঝবে না?” [সুরা আম্বিয়া, ২১:১০ ]

আরো পড়ূনঃ

Leave a Comment