আমাদের সময়ে অমুসলিমদের সমালোচনা | বদর ও ওহুদের মাঝে সংঘটিত ঘটনা, সরাসরি না হলেও বদরের যুদ্ধের সঙ্গে আরেকটি কাহিনি জড়িত আছে। সেটি ইহুদি উপজাতি বনু কায়নুকার কাহিনি। সেই কাহিনিটি শুরু করার আগে আমাদের এর পেছনের কিছু কথা বলে নিতে হবে।

আমাদের সময়ে অমুসলিমদের সমালোচনা | বদর ও ওহুদের মাঝে সংঘটিত ঘটনা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
আমাদের সময়ে অমুসলিমরা ইসলাম ধর্ম ও নবিজির (সা) জীবনী বিষয়ে সাধারণভাবে যে কয়েকটি বিষয় ও প্রেক্ষাপট নিয়ে সমালোচনা করে থাকে তা হলো:
১. নবি করিমের (সা) ব্যক্তিগত নৈতিকতা সম্পর্কিত কয়েকটি বিষয়; যেমন আয়েশার (রা) সঙ্গে বিয়ে, জয়নবের কাহিনি, কুরাইশদের কাফেলা আক্রমণ, স্যাটানিক ভার্সেসের ঘটনা ইত্যাদি।
২. নবিজির (সা) রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত কয়েকটি বিষয়; যেমন তিনি ইহুদি উপজাতিগুলোর সঙ্গে কেমন আচরণ করেছিলেন। এটি অত্যন্ত সংবেদনশীল ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আরও কিছু বিষয় আছে, যা নিয়ে আমরা ক্রমশ আলোচনা করব; যেমন কাব ইবনুল আশরাফের হত্যা ইত্যাদি)।
এই বিষয়টি আমাদের খুব মনোযোগ দিয়ে এবং সংবেদনশীলতার সাথে বুঝতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে কেন এটি সমস্যাপূর্ণ। কারণ, এখানে মহানবি মুহাম্মদকে (সা) ‘অ্যান্টি-সেমেটিজম’ বা ইহুদি-বিদ্বেষ {১} ও মিনি হলোকাস্টের’ বা ছোট আকারের ইহুদি নিধনযজ্ঞের [২] মতো বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় ।
এরকম অবস্থায় আমাদের অবশ্যই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে নবিজির (সা) পক্ষে ন্যায্যভাবে ও অকপটে কথা বলতে হবে। উপযুক্ত সূত্র থেকে প্রাপ্ত সত্য তথ্যের ভিত্তিতেই আমাদের কথা বলতে হবে। কোনো মিষ্টি প্রলেপ দিয়ে (‘সুগারকোর্ট’ করে) কিংবা ভুল তথ্য ও ব্যাখ্যার মাধ্যমে তাঁর পক্ষে সাফাই গাওয়ার সুযোগ নেই। দোষ স্বীকার করে কৈফিয়ত দেওয়ারও কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই। আমাদের কাজ হলো, প্রকৃতপক্ষে যা ঘটেছে, তা-ই বলা এবং উপস্থাপন করা।

আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বিরোধের প্রেক্ষিতে এই বিষয়টির একটি রাজনৈতিক গুরুত্বও আছে। আবার এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে যে, কারও মনে কোনো দুরভিসন্ধি বা কোনো নির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থাকলে সে সবসময়ই নেতিবাচক কিছু খুঁজে পাবে। নবিজি (সা) ইহুদিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন—এই দাবিটি আসলেই ঠুনকো।
তবে এটি বুঝতে হলে আমাদের ইসলামের ইতিহাসের দিকে নজর দিতে হবে। ১৯৪৭ সালে ইসরায়েল সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্তও কিন্তু মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে ইহুদিদের বড় বড় জনগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছিল। ইহুদিরা ইরাক, ইয়েমেন, তিউনিসিয়া, মরক্কো প্রভৃতি অঞ্চলে শত শত বছর ধরে বসবাস করত। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দেশগুলোতে নানা সময়ে ইহুদিদের নির্যাতন ও বহিষ্কারের পরিপ্রেক্ষিতে তারা মুসলিম ভূখণ্ডেই নিরাপদ আশ্রয় পেত—এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য ।
উমাইয়া শাসন থেকে শুরু করে আব্বাসীয় আমল পার হয়ে স্পেন থেকে বহিষ্কারের আগ পর্যন্ত ইহুদিরা উপরে উল্লিখিত মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোতে বাস করত। ইহুদিরা যদি মুসলিম ভূখণ্ড নিরাপদ মনে না করত, তাহলে স্পেন থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর কয়েক হাজার ইহুদি কেন মরক্কোতে আশ্রয় নিয়েছিল? মরক্কোর সুলতান ইহুদিদের কাছে জাহাজ পাঠিয়ে বলেছিলেন, “আমাদের দেশে চলে এসো।” এখানে বিদ্বেষ বা শত্রুতার লেশমাত্র ছিল না ।
প্রকৃত সত্য হলো, মুসলিম ও ইহুদিদের মধ্যে শত্রুতা ও ঘৃণার বেশিরভাগই সৃষ্টি হয়েছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত শুরুর পর থেকে। ইসরায়েল রাষ্ট্রে গঠনের আগে ইহুদিরা মুসলিম প্রতিবেশীদের সঙ্গে পূর্ণ সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করেছে। সত্যিকার অর্থে, ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে খ্রিষ্টানদের তুলনায় ইহুদিদের সঙ্গে মুসলিমদের মিল বেশি।
ইসলামি শরিয়ার ৭০ শতাংশ ইহুদিদের ‘হালাখা’র [৩] সঙ্গে মিলে যায়। ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইহুদিদের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মুসলিম ভূখণ্ডে বাস করে এসেছেন। সাদিয়া গাওঁ ছিলেন অন্যতম সেরা ইহুদি দার্শনিক ও চিন্তাবিদ যিনি সপ্তম শতাব্দীতে আব্বাসীয় খেলাফতের সময় বাগদাদে বসবাস করতেন।
ইহুদি ধর্মের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের মধ্যে মুসা ইবনে মায়মুন অন্যতম। তাত্ত্বিক ও আইনি বিষয়ে অবদানের বিবেচনায় তিনি একজন মহীরুহ। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বই থেকে জানা যায়, সেই মুসা ইবনে মায়মুন একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত একজন মুসলিমের মতো জীবনযাপন করতেন। তিনি মুসলিমদের মতোই পোশাক পরতেন, তাঁদের সঙ্গে প্রার্থনা করেছেন, মুসলিমদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসে তিনি ছিলেন ইহুদি। তিনি আন্দালুসিয়ায় ইসলামি সংস্কৃতির মধ্যে বড় হয়েছিলেন। এ কারণেই তাঁর সেরা বইগুলো আরবিতে লেখা: সেগুলো হিব্রু ভাষায় অনুবাদ করতে হয়েছে। তিনি এক সময় মিশরে চলে যান এবং সালাহউদ্দিন আইয়ুবির (সালাদিন) ব্যক্তিগত চিকিৎসক নিযুক্ত হন। ফলে তাঁর খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। তিনি শেষ পর্যন্ত মিশরের গ্র্যান্ড বাবাই হয়ে ওঠেন।
এই যদি হয় ঐতিহাসিক সত্য, তাহলে আমরা কীভাবে বলব যে, মুসলিমরা ইহুদিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেছেন? যেখানে আরবরা নিজেরাই সেমেটিক, সেখানে ইসলাম কীভাবে অ্যান্টিসেমেটিক হয়? ইব্রাহিমের (আ) বংশধররা তো সবাই সেমেটিক ছিলেন।
এখানে মূল বিষয়টি হলো, কেউ ‘শুধু ইহুদি বলেই নবিজি (সা) কারও সঙ্গে কখনও কোনো বৈরী আচরণ করেননি। বরং তিনি যা করেছিলেন তা ‘তারা যা করেছিল সে জন্য’: কোনোভাবেই ‘তারা কে সে জন্য’ নয়। এই দুইয়ের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। মূল কারণটি হলো, তাদের অপকর্ম ও মুসলিমদের সঙ্গে চুক্তিভঙ্গের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুনঃ