আবু জেহেলের শেষ পরিণতি | বদরের যুদ্ধ-৪ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

আবু জেহেলের শেষ পরিণতি | বদরের যুদ্ধ-৪, বদরের যুদ্ধের কাহিনিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমর ইবনে হিশাম ওরফে আবু জেহেলের মৃত্যু। নবি করিম (সা) বলেছিলেন, সে ছিল এই উম্মতের ফেরাউন। আল্লাহ চেয়েছিলেন, আবু জেহেল যেন ১৬/১৭ বছর বয়সী দুই তরুণের হাতে মারা যায়। এখানে আল্লাহ তায়ালার প্রজ্ঞাটি হলো, আবু জেহেলের মতো একজন দুর্বিনীত অত্যাচারী ব্যক্তিকে হত্যা করবে দুজন তরুণ আনসার, যা হবে তার জন্য অপমানকর আর কিশোরদের জন্য সম্মানের।

 

আবু জেহেলের শেষ পরিণতি | বদরের যুদ্ধ-৪ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আবু জেহেলের শেষ পরিণতি | বদরের যুদ্ধ-৪ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

বদরের যুদ্ধ চলার সময় আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা) চেয়েছিলেন তাঁর দুপাশে যেন মুসলিম বাহিনীর শক্তিশালী যোদ্ধারা থাকেন, যাতে তিনি তাঁদের কাছ থেকে সাহায্য পেতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর দুদিকে দুজন অল্পবয়সী তরুণকে লড়াই করতে দেখে তিনি কিছুটা হতাশই হয়েছিলেন। ওই তরুণদের নাম ছিল মুআদ ইবনে আমর ইবনুল জুমুহ এবং মুয়াবিদ ইবনে আফরা। মুআদের পিতা ছিলেন বনু সালামা গোত্রের একজন নেতা। মুআদ আকাবার দ্বিতীয় অঙ্গীকারের অংশ ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর।

অন্যদিকে মুয়াবিদ হচ্ছেন সেই তরুণ যিনি স্বেচ্ছায় মুবারাজায় অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁর মা, যাকে ‘আফরা’ নামে ডাকা হতো, তিনি এতটাই ধার্মিক ছিলেন যে তাঁর সন্তানেরা মায়ের নামেই পরিচিত ছিলেন। আফরার তিন পুত্র ছিলেন, তাঁদের দুজনই বদরের যুদ্ধে শহিদ হন। ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন: এই দুজন তরুণের একজন হঠাৎ আবদুর রহমানের কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, “চাচা, আপনি কি আৰু জেহেলকে এর আগে কখনও দেখেছেন? সে কোথায়? আমি শুনেছি, সে নাকি নবিজিকে (সা) অসম্মান করেছে।

আমি আল্লাহর কাছে শপথ করেছি যে, আমি যদি তাকে দেখি তবে আমাদের দুজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত আমি তাঁকে ছাড়ব না।” আবদুর রহমান বললেন, “আমি যদি তাকে দেখতে পাই, তাহলে তোমাকে জানাব।” উত্তর শুনে তরুণটি নিজের অবস্থানে ফিরে গেলেন। এর পরপরই অন্য তরুণ এসে আবদুর রহমানকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। আবদুর রহমান তাঁকেও একই জবাব দিলেন । বোঝা যাচ্ছিল, এই দুই তরুণ পরস্পরের বন্ধু ছিলেন, তাঁরা কে আগে আবু জেহেলকে হত্যা করবেন তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। দুজনই ছিলেন আনসারি, দুজনের কেউই আগে আবু জেহেলকে দেখেননি ।। আবদুর রহমান ওই তরুণদের কথা শুনে এই ভেবে কিছুটা খুশিই হয়েছিলেন যে বয়স কম হলেও ছেলেগুলোর উদ্যমের কমতি নেই।

ইবনে হাজার ও অন্যান্য ইতিহাসবিদের মতে, আবু জেহেল সেই সময় কয়েকটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল। কুরাইশ সৈন্যরা তার আশেপাশে থেকে তাকে পাহারা দিচ্ছিল । বিশেষ করে সেখানে ছিল তার নিজের শক্তসমর্থ জোয়ান পুত্র ইকরিমা । যুদ্ধের একপর্যায়ে আবদুর রহমান আবু জেহেলকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে ওই দুই তরুণের উদ্দেশ্যে জোরে চেঁচিয়ে বললেন, ‘এ-ই সেই লোক, যাকে তোমরা খুঁজছ’। দুজনই তাঁর কথা শুনে আৰু জেহেলের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন।

প্রথমে মুআদ ইবনে আমর গাছের যেদিকটায় আবু জেহেল দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে ছুটে গেলেন; তাঁর ভয় ছিল, কেউ না আবার তাঁর আগেই আবু জেহেলের কাছে পৌঁছে যায়। আবু জেহেল গাছের কিছুটা উপরে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে মুআদ তার শরীরের উপরের অংশের নাগাল পাচ্ছিলেন না। ফলে তিনি আর দেরি না করে তলোয়ার উঁচিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে আবু জেহেলের বাম পায়ে আঘাত করলেন। ফলে আবু জেহেলে বাম পা তার শরীর থেকে সম্পূর্ণ বিছিন্ন হয়ে গেল । তখন ইকরিমা তার পিতাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসে তলোয়ারের আঘাতে মুআদের ডান হাতটি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

মুআদ বাকি জীবন এক হাত নিয়েই বেঁচে ছিলেন। তিনি দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন, উসমানের (রা) খেলাফতের সময়ে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। তিনি পরবর্তীকালে এই মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ইকরিমার আঘাতের পর তাঁর হাতটি শুধু একটি মাংসপেশি দ্বারা দেহের সঙ্গে ঝুলে ছিল। সে অবস্থায় তাঁর পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়ায় অসুবিধা হচ্ছিল, তাই তিনি নিচু হয়ে নিজের পা দিয়ে টেনে আহত হাতটি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। এই যন্ত্রণাদায়ক কাজটি করার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৬-১৭ বছর । যুদ্ধের বাকি অংশে তিনি তাঁর বাম দিয়েই লড়াই চালিয়ে গেছেন।

অন্যদিকে মুয়াবিদও একই সময়ে আবু জেহেলকে আঘাত করেছিলেন। তাঁর আঘাতটি আবু জেহেলের শরীরের কোন অংশে লেগেছিল তা আমাদের জানা নেই । তবে তিনি আঘাত করেই আবার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসেন। মুআদ ও মুয়াবিদ নবিজির (সা) কাছে ছুটে এসে বলতে থাকেন, ‘আমি আবু জেহেলকে হত্যা করেছি’, ‘আমি আবু জেহেলকে হত্যা করেছি’। কে আৰু জেহেলকে হত্যা করেছে এ নিয়ে দুজন তর্ক শুরু করলে নবিজি (সা) বললেন, “আমাকে তোমাদের তলোয়ারগুলো দেখাও।” উভয়ে নবিজিকে (সা) নিজ নিজ তলোয়ার দেখালেন। তলোয়ার দুটি দেখে নবিজি (সা) বললেন “তোমরা উভয়েই আৰু জেহেলকে হত্যা করেছ।” অর্থাৎ উভয়ের আঘাতের ক্ষতের কারণেই আবু জেহেলের মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং আৰু জেহেলকে হত্যার কৃতিত্ব ও সম্মান উভয়ের সমানভাবে প্রাপ্য ।

আবু জেহেলকে আঘাত করার কিছু সময় পরে যুদ্ধরত অবস্থায় মুয়াবিদ শহিদ হন। ফলে আৰু জেহেলের বিশেষ বর্মটি মুআদের কাছে থেকে যায়। ৩ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ইসলামি আইন অনুসারে, যুদ্ধে আপনি যাকে হত্যা করবেন, তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের অধিকারী আপনি হবেন। আবু জেহেলকে হত্যা করার ফলে মুআদ বেশ কিছু জিনিসের মালিক হয়েছিলেন। যুদ্ধের শেষে নবিজি (সা) সাহাবিদের বললেন, “যাও, খুঁজে দেখো, আবু জেহেলের লাশটি কোথায় আছে।”

বেশ কয়েকজন সাহাবি কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে আবু জেহেলের লাশ খুঁজতে গেলেন। তাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) আবু জেহেলকে মুমূর্ষু অবস্থায় খুঁজে পেলেন, সে ভারী ভারী শ্বাস নিচ্ছিল। ইবনে মাসউদ তার বুকের উপর পা রেখে বললেন, “ওহে আল্লাহর শত্রু, তুমি কি এখন স্বীকার করবে যে, আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করেছেন?”

মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও আবু জেহেলের ঔদ্ধত্য বিন্দুমাত্র কমেনি। সে পাল্টা জবাব দিল, “আমি আবার কীভাবে লাঞ্ছিত হলাম? এখানে একজন ব্যক্তিকে তার নিজের লোকেরা হত্যা করছে। তোমাদের লজ্জা পাওয়া উচিত।” লক্ষ করুন, এখনও সে মুসলিমদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে। তারপর সে জিজ্ঞেস করল, “যুদ্ধের ফলাফল বলো। কে জিতেছে আজ?” ইবনে মাসউদ বললেন, “আল্লাহ ও তাঁর রসুল জিতেছেন।” এ পর্যায়ে আবু জেহেল হঠাৎ লক্ষ করল যে ইবনে মাসউদ তার বুকের উপর পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। সে দম্ভের সঙ্গে বলে উঠল, “হে রাখাল পুত্র! তুমি অনেক উঁচুতে তোমার পা রেখেছ!”

একথা শুনে ইবনে মাসউদ আবু জেহেলকে হত্যার উদ্দেশ্যে খাপ থেকে তলোয়ারটি বের করলেন। কিন্তু সারাদিন যুদ্ধে ব্যবহার করার কারণে তাঁর নিজের তলোয়ারে যথেষ্ট ধার না থাকায় তিনি আবু জেহেলের তলোয়ার দিয়েই তার জীবনের যবনিকা টানলেন। এভাবেই ইবনে মাসউদ আবু জেহেলের মৃত্যুর আগের শেষ আঘাতটি করার সম্মান পেয়েছিলেন, যদিও এক্ষেত্রে তাঁকে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেওয়া যাবে না। কারণ, সেই দুজন তরুণের আঘাতের কারণে আবু জেহেল এমনিতেই মারা যেত ।

 

আবু জেহেলের শেষ পরিণতি | বদরের যুদ্ধ-৪ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

এরপর ইবনে মাসউদ নবিজির (সা) কাছে ফিরে গিয়ে বলেন, “হে আল্লাহর রসুল! আমি আবু জেহেলের লাশটি খুঁজে পেয়েছি।”

নবিজি (সা): তুমি কি এ কথা আল্লাহর কসম খেয়ে বলতে পারবে? ইবনে মাসউদ: হ্যাঁ, আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি।

নবিজি (সা) (আবার): তুমি কি এ কথা আল্লাহর কসম খেয়ে বলতে পারবে? ইবনে মাসউদ (আবার): হ্যাঁ, আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি ।

নবিজি (সা) (তৃতীয় ও শেষবারের মতো: তুমি কি এ কথা আল্লাহর কসম খেয়ে বলতে পারবে?

উত্তরে ইবনে মাসউদ (আবারও): হ্যাঁ, আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি। নবিজি (সা) তিনবার জিজ্ঞেস করে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন, কারণ তা ছিল অনেক বড় একটি খবর। ইবনে মাসউদের জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে নবিজি (সা) বললেন, “কোথায় সেই লাশ?” ইবনে মাসউদ তখন তাঁকে লাশের জায়গায় নিয়ে গেলেন। আবু জেহেলের লাশ দেখে নবিজি করিম (সা) বললেন “এই লোকটি ছিল উম্মতের মধ্যে ফেরাউন!”

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment