আবু তালিবের জীবন ও মৃত্যু থেকে শিক্ষণীয় | খাদিজা (রা) ও আবু তালিবের মৃত্যু,
আবু তালিবের জীবন ও মৃত্যু থেকে শিক্ষণীয় | খাদিজা (রা) ও আবু তালিবের মৃত্যু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
১) কাউকে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন, এমনকি যদি তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বা আমাদের পূর্বপুরুষ কিংবা পিতামাতাও হয়। আল্লাহর আদেশ ও রসুলের (সা) সুন্নাহর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই হতে পারে না। আল্লাহ ও তাঁর রসুলের (সা) বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য কাউকে, এমনকি তিনি যদি কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিও হন, অনুসরণ করলে কেয়ামতের দিন পার পাওয়া যাবে না। পবিত্র কোরানে উল্লেখ আছে, এই লোকেরা কেয়ামতের দিনে বলবে:
“তারা আরও বলবে, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আনুগত্য করেছিলাম এবং ওরা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল।” [সুরা আহজাব, ৩৩:67) “…আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এক ধর্মমত পালন করতে দেখেছি আর আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি।” [সুরা জুখরুফ, ৪৩:23] আল্লাহ এর ঠিক পরের আয়াতেই সাড়া দিয়েছেন, “প্রত্যেক সতর্ককারী বলত, ‘তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের যা অনুসরণ করতে দেখেছ আমি যদি তোমাদের জন্য তার চেয়ে ভালো পথের হদিস দেই (তবুও কি তোমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে)?” [সুরা জুখরুফ ৪৩:২৪ ) আমরা মুসলিম বলেই ধরে নেওয়া যাবে না যে আমরা নিরাপদ, আমাদের কিছুই হবে না। আমরা অনেক সময় পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে ইসলাম সম্পর্কে এমন ধারণাও পেয়ে থাকি যা অনেক সময় সঠিক নয়। আমাদের পূর্বপুরুষরা তো ইসলামের মাপকাঠি নয়। আল্লাহ ও তাঁর রসুল (সা) যা বলেন তা-ই মাপকাঠি ।

২) আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে, আল্লাহই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। নবিজি (সা) যাঁদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন, আবু তালিব তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে সঠিক পথটি দেখাতে পারেননি। আল্লাহ বলেছেন: “তুমি যাকে ভালোবাসো (ইচ্ছা করলেই) তাকে সৎপথে আনতে পারবে না; তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন, আর তিনিই ভালো জানেন কারা সৎপথ অনুসরণ করে।”
[২৮:৫৬) এখানে লক্ষ করার মতো একটি ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাপার আছে। যদি জীবদ্দশায়ই নবিজির (সা) নিজের কোনো ক্ষমতা না থেকে থাকে, তাহলে মৃত্যুর পর তাঁর কী করার থাকতে পারে? এখন এমন অনেক মুসলিম আছে যারা মনে করেন, নবিজি (সা) নিজে সিদ্ধান্ত দিতে পারেন কে বেহেশতে যাবে আর কে দোজখে যাবে। এই ভুলটাই অনেক মুসলিম করে থাকেন তাঁরা নবিজির (সা) প্রশংসা করতে করতে কুফর ও শিরকের পর্যায়ে চলে যান। আসলে নবিদের মর্যাদা কখনোই আল্লাহর সঙ্গে তুলনীয় নয়। আমাদের আবেগ যেন এ বিষয়ে আমাদের কখনোই বিভ্রান্ত না করতে পারে।
৩) আল্লাহ তায়ালাই নিশ্চিত করেছেন যে আবু তালিবের প্রতি নবিজির (সা) গভীর ভালোবাসা ছিল। কিছু উগ্রপন্থি মুসলিম বলে, আমাদের অবশ্যই সব কাফেরকেই ঘৃণা করতে হবে। এটা কীভাবে সম্ভব যেখানে আল্লাহই বলছেন যে নবিজি (সা) আবু তালিবকে ভালোবাসতেন? এটা কোরান ও সুন্নাহর সম্পূর্ণ পরিপন্থি। অবিশ্বাসীদের প্রতি আমাদের বিদ্বেষের একমাত্র কারণ তারা ইসলামের মূল বার্তা প্রত্যাখ্যান করে।

অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে প্রত্যাখ্যানকারী কিংবা তাঁদের প্রতি ঘৃণা পোষণকারী কারও সঙ্গে আমাদের ধর্মীয় ভালোবাসা থাকতে পারে না। আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেছেন: “তুমি এমন কোনো সম্প্রদায় পাবে না যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে অথচ আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরোধিতাকারীদের ভালোবাসে; হোক না তারা তাদের পিতা, পুত্র, ভ্রাতা বা জ্ঞাতি-গোত্র।” [সুরা মুজাদালা, ৫৮:২২] ওপরে উল্লিখিত আয়াতটির আলোকে কিছু মানুষের ধারণা, ইসলাম অমুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করে। এ ধারণা ঠিক নয়। এই আয়াতে আল্লাহ যে ভালোবাসার কথা বলছেন, তা ধর্মীয় ভালোবাসা। পৃথিবীর সব মুসলিমের প্রতি আমাদের ধর্মীয় ভালোবাসা রয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরোধিতাকারী, প্রতি আমাদের ধর্মীয় ভালোবাসা থাকতে পারে না, এমনকি তারা আমাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হলেও। তবে তাদের প্রতি আমাদের স্বাভাবিক মানবিক ভালোবাসা থাকতে পারে; যেমন যদি তাঁরা মা কিংবা বাবা হন।
আরেকটি উদাহরণ: ইসলামে মুসলিম পুরুষকে ইহুদি বা খ্রিষ্টান নারীকে বিয়ে করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কীভাবে একজন পুরুষ এমন একজন নারীর সঙ্গে বৈবাহিক বন্ধন অটুট রাখবেন যদি তাঁকে ঘৃণা করতে হয়? ইসলামের দৃষ্টিতে নিজের পরিবার, গোত্র, জাতি ইত্যাদির প্রতি মানুষের সহজাত স্নেহ-ভালোবাসা থাকা খুবই স্বাভাবিক এবং অনুমোদিত।
৪) আবু তালিব পূর্বপুরুষদের ধর্ম অনুসরণ করে যাওয়ার ফলেই কুরাইশদের নেতা থাকতে পেরেছিলেন। ওই অবস্থানে থেকে তাঁর পক্ষে নবিজিকে (সা) সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁর পক্ষে নেতৃত্ব ধরে রাখা সম্ভব হতো না। তিনি কুফরের মধ্যে থাকার কারণেই নবিজির (সা) পক্ষে ইসলামের প্রচার করা সহজ হয়েছিল। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, আল্লাহ কেন তাঁকে মৃত্যুশয্যায়ও ইসলামের পথে নিয়ে এলেন না? এর উত্তর আমরা কখনোই জানতে পারব না।
এ বিষয়ে আল্লাহর কী প্রজ্ঞা ছিল, তা তিনিই ভালো জানেন। আল্লাহ সুরা আম্বিয়ায় বলেছেন, “তিনি (আল্লাহ) যা করেন সে বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হবে না, বরং ওদেরকেই প্রশ্ন করা হবে।” | 21:23] আল্লাহর জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো অধিকার আমাদের নেই। সুতরাং আল্লাহর ইচ্ছাকে আমাদের মেনে নিতে হবে, যদি আমরা তা বুঝতে নাও পারি।
৫) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস শুধু নবিজিকে (সা) স্বীকৃতি দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। অন্য কথায়, শুধু এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস এবং মুহাম্মদকে (সা) সত্য নবি হিসেবে মেনে নিলেই মুসলিম হওয়া যায় না। আবু তালিবও এটা বিশ্বাস করতেন। তিনি ভালোভাবেই জানতেন, তাঁর ভাতিজা মুহাম্মদ (সা) যা বলছেন। তা সত্য, কিন্তু তিনি তা সর্বসমক্ষে মানতে রাজি হননি। সুতরাং কেউ সত্য জানলেই তাকে আমরা মুসলিম বলতে পারব না। মুসলিম তিনিই যিনি সত্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেন।
ইসলাম অর্থই সমর্পণ। ইবলিসও সত্য জান এবং গ্রহণ করেছিল, কিন্তু সে আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেনি। প্রকৃতপক্ষে, ইবলিস নবিদের সত্যতা স্বীকার করেছিল, সে আল্লাহকে আমার প্রতিপালক’ বলে সম্বোধন পর্যন্ত করেছিল। [সুরা হিজর ১৫:৩৬] সে কেয়ামতেও বিশ্বাসী ছিল এবং আল্লাহকে অনুরোধ করেছিল, “কেয়ামতের দিন পর্যন্ত আপনি আমাকে অবকাশ দিন (বেঁচে থাকতে)।” [সুরা আরাফ, ৭:১৪] তবে কি ইবলিস একজন মুমিন? অবশ্যই না! আল্লাহ বলেছেন, “সে অমান্য করল ও অহংকার করল। তাই সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।” [সুরা বাকারা, ২:৩৪] অতএব একজন কাফের হচ্ছে::
(১) এমন কেউ যে সত্য জানে না; অথবা
(২) এমন কেউ যে সত্য জানে, কিন্তু তা আমল করতে অস্বীকার করে।
যে মুসলিম ইসলামকে সত্য বলে জানেন কিন্তু তার ওপর আমল করেন না। তাঁকে আমরা কী বলব? আবু তালিবের সঙ্গে এমন একজন মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য কী? তাঁরা উভয়ই স্বীকৃতি দেন যে আল্লাহ এক এবং মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রসুল, কিন্তু উভয়েই আল্লাহর নির্দেশিত আমল করতে অস্বীকার করেন। আসলে, কেউ যদি নিজেকে মুসলিম বলেন, কিন্তু কোনো আমল (অর্থাৎ নামাজ পড়া, রোজা রাখা, জাকাত দেওয়া, ইত্যাদি) না করেন, তাহলে তাঁর ইমানের সঙ্গে আবু তালিবের কিংবা ইবলিসের ইমানের খুব বেশি পার্থক্য নেই। এ বিষয়ে একটা হাদিস আছে। “যে ব্যক্তি কালেমা পড়বে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” কিন্তু এই হাদিস পড়তে হবে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে মিলিয়ে; যেমন, “যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে কালেমা পড়বে….”, “যে ব্যক্তি মন থেকে কালেমা পড়বে…” ইত্যাদি ।
সব শেষে বলতে হয়, ইমানকে ‘বিশ্বাস’ হিসেবে অনুবাদ করা পুরোপুরি সঠিক নয়। আবু তালিবেরও বিশ্বাস ছিল, ইবলিসেরও বিশ্বাস আছে। কিন্তু এই বিশ্বাস তাদেরকে মুমিনে পরিণত করে না। বিশ্বাস ইমানের একটি অংশ মাত্র, পূর্ণাঙ্গ ইমান নয়।
৬) মন্দ সংসর্গ। শেষ পর্যন্ত আবু তালিবের সহযোগী ছিল আবু জেহেল, ওয়ালিদ ইবনুল মুগিরা প্রমুখ। তিনি একপর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করতে চাইলেও এই সহযোগীরাই তাঁকে বাধা দেয়।
৭) একটি ফিকহ বিষয়: কেউ অমুসলিম হিসেবে মারা গেলেও মুসলিমদের জন্য তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের বিধান আছে। নবিজি (সা) আলিকে তাঁর পিতাকে দাফন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, একজন মুসলিম তাঁর কোনো অমুসলিম আত্মীয় মারা গেলে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে, আনুষঙ্গিক কাজে সহায়তা করতে, এমনকি আর্থিকভাবেও সহায়তা করতে পারেন। আলি (রা) শুধু পিতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেই হাজির থাকেননি, কবর খনন, কাফনের কাপড় পরানোসহ অন্যান্য কাজেও অংশ নিয়েছিলেন। এ থেকে ধারণা করা যায়, আমরা কোনো অমুসলিম আত্মীয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়ও যোগ দিতে পারি।
আরো পড়ুনঃ
- উমর ইবনুল খাত্তাব | উমর ও হামজার ইসলাম গ্রহণ এবং বয়কট | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- উমরের ইসলাম গ্রহণ | উমর ও হামজার ইসলাম গ্রহণ এবং বয়কট | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- আবু তালিব বয়কট | উমর ও হামজার ইসলাম গ্রহণ এবং বয়কট | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- বয়কটের সমাপ্তি | উমর ও হামজার ইসলাম গ্রহণ এবং বয়কট | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
- আবু তালিবের মৃত্যু | খাদিজা (রা) ও আবু তালিবের মৃত্যু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন