মহানবি মুহাম্মদকে (সা) আরব ভূখণ্ডে প্রেরণের পেছনে প্রজ্ঞা | মহানবি মুহাম্মদের (সা) জন্ম | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

মহানবি মুহাম্মদকে (সা) আরব ভূখণ্ডে প্রেরণের পেছনে প্রজ্ঞা | মহানবি মুহাম্মদের (সা) জন্ম, আরবরা যদি এতই খারাপ ছিল তবে আল্লাহ তায়ালা কেন মহানবি মুহাম্মদকে (সা) পাঠানোর জন্য আরব ভূখণ্ড বেছে নিয়েছিলেন? তিনি তো তাঁকে রোমান কিংবা পার্সিয়ানদের মাঝেও পাঠাতে পারতেন। রোমানরা সেই সময় ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এক জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে পার্সিয়ানদের ছিল। এক প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী সভ্যতা। অথচ মহানবিকে (সা) পাঠানোর জন্য বেছে নেওয়া হলো এমন এক অনগ্রসর জনপদকে, যেখানে এমনকি কোনো সরকারব্যবস্থাও ছিল না। আল্লাহ তায়ালার মহানবিকে (সা) আরব ভূখণ্ডে প্রেরণ করার পেছনে আমরা কতকগুলো কারণ খুঁজে পাই।

 

মহানবি মুহাম্মদকে (সা) আরব ভূখণ্ডে প্রেরণের পেছনে প্রজ্ঞা | মহানবি মুহাম্মদের (সা) জন্ম | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

Table of Contents

মহানবি মুহাম্মদকে (সা) আরব ভূখণ্ডে প্রেরণের পেছনে প্রজ্ঞা | মহানবি মুহাম্মদের (সা) জন্ম | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

১) সেই সময়ের বিশ্বের দুটি প্রধান পরাশক্তি,

রোমান (বাইজেন্টাইন) ও পার্সিয়ানদের (সাসানিত) মধ্যখানে ছিল আরব ভূখণ্ডের অবস্থান। সঠিকভাবে বলতে গেলে, আরব ভূখণ্ড ওই দুই পরাশক্তির সঙ্গে একই সীমানার মাধ্যমে সংযুক্ত ছিল এবং ভৌগোলিকভাবে কিছুটা দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ছিল। দেখা গেছে, পরবর্তী ২০-৪০ বছরে আরবরা উভয় পরাশক্তিকেই জয় করেছিল। হয়তো ভৌগোলিকভাবে সংযুক্ত থাকার কারণেই আল্লাহ তায়ালা ওই দুই শক্তিশালী জাতির ওপর মুসলিমদের শুরুতেই বিজয়ী করতে চেয়েছিলেন।

২) আরবদের মধ্যে উপনিবেশবাদের (অন্য দেশকে আক্রমণ করার) ইতিহাস ছিল না,

কারণ তারা সব সময় নিজেরাই নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকত। তারা আগে কখনোই রোম বা পারস্য সাম্রাজ্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়নি। সুতরাং ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর আরব সেনাবাহিনী যখন প্রথম রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন এই দুই পরাশক্তির লোকেরা তাদের দেখে তাচ্ছিল্যভরে এবং ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল, “কারা এই বেদুইন, যারা আমাদের ওপর আক্রমণ করতে চাইছে?” শোনা যায়, লোকে যেমন করে শিশুদের বলে, পার্সিয়ানরা তেমন করে মুসলিম নেতাদেরকে বলেছিল, “তোমরা ফিরে যাও। তোমরা চাইলে আমরা না হয় তোমাদেরকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে দেব।” তারা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে, আরব অঞ্চল থেকে কেউ তাদেরকে আক্রমণ করতে পারে। সুতরাং পুরো ব্যাপারটিই রোমান ও পার্সিয়ানদের জন্য ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

৩) আরবদের নিজস্ব কোনো সভ্যতা ছিল না।

অর্থাৎ তাদের কোনো সরকারব্যবস্থা বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল না। সভ্যতার আরেকটি মানদণ্ড হলো সাহিত্য, শিল্প ও স্থাপত্য। আরবদের কবিতা ছিল বটে, কিন্তু কোনো লিখিত সাহিত্য ছিল না, ছিল না স্থাপত্য। অন্যদিকে রোমান ও পার্সিয়ানদের ছিল বিশাল বিশাল প্রাসাদ, যার অনেক কিছু আজও রয়ে গেছে। কিন্তু ইসলাম এসে আরবদের সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল, তাদেরকে তৎকালীন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা নিয়েছিল।

এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “(হে মানবজাতি) আমি তোমাদের ওপর কিতাব নাজিল করেছি, যার মধ্যে রয়েছে তোমাদেরই জন্য উপদেশ (অথবা সম্মান)’।” [সুরা আম্বিয়া, (২১:১০) এখানে আল্লাহ বোঝাতে চেয়েছেন, এই কিতাবটির আগে তোমাদের কোনো ‘লিগ্যাসি’ বা উত্তরাধিকার ছিল না। এখন এই কিতাবটি তোমাদের এমন একটি লিগ্যাসি দেবে যা দেখে পরবর্তীকালে লোকেরা তোমাদের স্মরণ করবে। যেহেতু ইসলাম আসার আগে আরবদের কোনো সভ্যতা ছিল না, সেহেতু তাদের পক্ষে নতুন করে একটি অনন্য সংস্কৃতি গড়ে তোলা সহজেই সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ইসলাম যদি রোমানদের কাছে আসত, তবে একটি সম্পূর্ণ নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলা কঠিন হতো।

অন্য কথায়, দীর্ঘ সময় ধরে থাকা একটি সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ভাঙা এত সহজ ব্যাপার হতো না। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আরবরা মুহাম্মদের (সা) নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সুতরাং বলা যায়, আরবদের সভ্যতার উত্তরাধিকার না থাকা ইসলামের জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছে। আর এর ফলে ইসলাম সম্পূর্ণ নিজস্ব এবং অনন্য এক সভ্যতা গড়ে তুলতে পেরেছিল, এনেছিল নিজস্ব কবিতা, সাহিত্য, স্থাপত্য, মুদ্রাব্যবস্থা ইত্যাদি ।

৪) মক্কা ছিল আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্মিত সর্বপ্রথম পীঠস্থান যা ইব্রাহিম (আ) এবং ইসমাইল (আ) স্থাপন করেছিলেন,

যা পবিত্র কোরানেও উল্লিখিত আছে। অর্থাৎ কাবা ছিল পৃথিবীতে নির্মিত সর্বপ্রথম মসজিদ। অন্য সব ধর্মের নবিদেরকেই নির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর কাছে প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু মহানবি মুহাম্মদকে (সা) প্রেরণ করা হয়েছিল পুরো মানবজাতির জন্য। স্বাভাবিকভাবেই মক্কা ছিল সমগ্র মানবজাতিকে আল্লাহর পথে আহ্বান জানানোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান।

৫) আরব উপজাতিগুলো সব সময় নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকত বলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোগতভাবে দুর্বল ছিল।

সেই আরব থেকে হঠাৎ করেই একটি রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ছিল পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। কেউ অনুমান করা তো দূরের কথা, স্বপ্নেও তা কল্পনা করতে পারেনি। এ যেন বিশ্বের ছোট্ট একটি ভূখণ্ডের হঠাৎ করেই পরাশক্তি হয়ে ওঠার মতো একটি ব্যাপার। সুতরাং রোমান ও পার্সিয়ানরা মুসলিমদের অভিযানের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিল।

 

মহানবি মুহাম্মদকে (সা) আরব ভূখণ্ডে প্রেরণের পেছনে প্রজ্ঞা | মহানবি মুহাম্মদের (সা) জন্ম | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

 ৬) আরবদের বেশ কয়েকটি ভালো গুণ বা বৈশিষ্ট্য ছিল,

যার কারণে তারা ইসলাম ও তার নবিকে সহজেই গ্রহণ করতে পেরেছিল: 

  • ক) আরবরা ছিল সহজ-সরল মানুষ। তাদের মধ্যে জটিল দার্শনিক মতদীক্ষা ছিল না। সহজ-সরল মানুষদের একটি ভালো দিক হলো, নতুন কিছু তাদের কাছে এলে তারা তা সহজেই গ্রহণ করে।
  • খ) আরবরা কষ্টের জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। যেমন পানি, খাদ্য ইত্যাদির অপ্রাচুর্য। এটি মুসলিম বাহিনীকে তাদের অভিযানের সময় সহায়তা করেছিল। রোমান ও পার্সিয়ান সৈন্যরা বিভিন্ন ধরনের ‘সাপ্লাই লাইন’ বা রসদ সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল থাকত। অন্যদিকে আরবরা খুব কম পরিমাণ পানি ও খাবার নিয়ে মরুভূমিতে দীর্ঘ সময় যাতায়াত করতে পারত। প্রথমদিকে ইসলামিক বিজয়ের ক্ষেত্রে আরবদের এই স্ট্যামিনা বা প্রাণশক্তি খুবই কাজে লেগেছিল। 
  • গ) আরবরা ছিল খুব সাহসী জনগোষ্ঠী।
  • ঘ) মিথ্যা বলা আরবদের স্বভাবের মধ্যে ছিল না। তারা ছিল সৎ ও সত্যবাদী। হেরাক্লিয়াসের সঙ্গে আবু সুফিয়ানের কথোপকথন থেকেও তা বোঝা যায়। হেরাক্লিয়াস জানতেন যে আবু সুফিয়ান মুহাম্মদের (সা) শত্রু ছিল। আৰু সুফিয়ান সত্য কথা বলছে কি না সে বিষয়ে হেরাক্লিয়াস নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি অন্য কুরাইশদের আবু সুফিয়ানের পেছনে দাঁড় করিয়ে রেখে বললেন, আৰু সুফিয়ান মিথ্যা বললে তারা যেন তা ইশারা করে বুঝিয়ে দেয়। তা দেখে আবু সুফিয়ান মন্তব্য করেছিল, “যদি আমার লোকেরা আমাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিযুক্ত না করত, তবে আমি মুহাম্মদের (সা) বিরুদ্ধে মিথ্যা আরোপ করতাম।” এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, যদিও আৰু সুফিয়ান পৌত্তলিক ছিল, তবুও সে মিথ্যাবাদী হিসেবে পরিচিত হতে চায়নি।
  • ঙ) তারা ছিল প্রতিশ্রুতি পালনের ব্যাপারে আন্তরিক। যদি তারা কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিত, তবে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। এ ব্যাপারে কোনো সাক্ষী কিংবা লিখিত দলিল ইত্যাদির দরকার পড়ত না। উদাহরণ হিসেবে আল্লাহ তায়ালার প্রতি আবদুল মুত্তালিবের প্রতিশ্রুতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
  • চ) আরবদের ঘোড়াগুলো ছিল সেরা জাতের। রোমান ও পার্সিয়ানদের চেয়ে আরবদের ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ার উভয়ই ছিল উন্নতমানের। নবিজি (সা) নিজেও আরবের প্রশংসা করেছিলেন। আজ অবধি আরবীয় ঘোড়া সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধ। ফলে মরুভূমির প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রোমান ও পার্সিয়ানরা যুদ্ধক্ষেত্রে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ২) ভাষার ওপর আরবদের অত্যন্ত ভালো দখল ছিল। তাছাড়া আরবি একটি ‘সেমেটিক ভাষা’, যা লাভিন-ভিত্তিক ভাষার চেয়ে অনেক বেশি প্রাঞ্জল ও শক্তিশালী। আরবি ভাষায় একটি শব্দ থেকে ২০০টিরও বেশি শব্দ তৈরি করা যায়।

৭) ইব্রাহিম (আ) কাবা নির্মাণ করার সময় দোয়া করেছিলেন।

“হে আমাদের প্রতিপালক। তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রসুল প্রেরণ করো যে তোমার আয়াত তাদের কাছে আবৃত্তি করবে, তাদেরকে তোমার কিতাবের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবে, এবং (তা দিয়ে) সে তাদেরকে পবিত্র করবে।” [সুরা বাকারা, ২:১২৯] ইব্রাহিম (আ) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাইলের (আ) বংশধরদের থেকে যেন একজন নবির আগমন ঘটে। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাকের (আ) বংশে নবি আসার কথা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে উল্লেখ করেছেন:

“তারপর আমি তাঁকে ইসহাকের এবং ইসহাকের পরবর্তী ইয়াকুবের (জন্মের সুসংবাদ দিলাম।” [সুরা হুদ, ১১:৭১) আমরা বিশ্বাস করি, ইব্রাহিমের (আ) পর থেকে পরবর্তী প্রত্যেক নবিই ইসহাকের (আ) বংশধর ছিলেন, শুধু একজন ব্যতিক্রম ছাড়া। তিনি হলেন সর্বশেষ নবি মুহাম্মদ (সা)। একমাত্র তিনিই ছিলেন ইসমাইলের (আ) বংশধর, যা ইব্রাহিমের (আ) দোয়ার ফল। নবিজি (সা) নিজেই বলেছেন, “আমি আমার পিতা ইব্রাহিমের (আ) দোয়ার ফলস্বরূপ, এবং যিশুখ্রিষ্ট যে সুসংবাদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আমিই সেই সুসংবাদ।”

আরো পড়ূনঃ

 

Leave a Comment