সাল্লাম ইবনে আবি আল-হুকায়কের প্রাণনাশ | খন্দক ও হুদায়বিয়ার মাঝে ছোট ছোট অভিযান | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

সাল্লাম ইবনে আবি আল-হুকায়কের প্রাণনাশ | খন্দক ও হুদায়বিয়ার মাঝে ছোট ছোট অভিযান, আমরা ৪৪তম পর্বে কাব ইবনুল আশরাফের প্রাণনাশের ঘটনা বিশদ আলোচনা করেছি। সাল্লাম ইবনে আবি আল-হুকায়েকের ঘটনাও কাবের ঘটনাটির মতো। তাই কাবের ক্ষেত্রে উল্লেখিত বিষয়য়গুলো সাল্লামের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অবশ্যই এটি ছিল লক্ষ্যাভিমুখী হত্যা বা টার্গেটেড কিলিং’, কোনো আনুষঙ্গিক ক্ষতি বা ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ {১} নয়। প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হয়, আমাদের সময়ে গত এক বা দুই দশকে যা ঘটেছে {২}, তার পরে এখন আর কারোরই এ নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার নেই। এটি এখন স্বাভাবিক যুদ্ধরীতির অংশ হয়ে গেছে ।

সাল্লাম ইবনে আবি আল-হুকায়কের প্রাণনাশ | খন্দক ও হুদায়বিয়ার মাঝে ছোট ছোট অভিযান | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

সাল্লাম ইবনে আবি আল-হুকায়কের প্রাণনাশ | খন্দক ও হুদায়বিয়ার মাঝে ছোট ছোট অভিযান | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

ঘটনাটি ঘটেছিল সম্ভবত খন্দকের যুদ্ধ ও খায়বারের যুদ্ধের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে। সাল্লাম ছিল খায়বার শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন ধনী ব্যক্তি। সে ছিল খন্দকের যুদ্ধের অন্যতম প্রধান অর্থ জোগানদাতা। পাতাফানদের আহজাবে যোগদান করানোর জন্য যে অর্থ দিতে হয়েছিল (৫৭তম পর্বে আলোচনা করা হয়েছে) তার জোগান দিয়েছিল এই সাল্লাম।

আমরা জানি, আহজাবের অধিকাংশ লোকই ছিল ভাড়াটে সৈন্য; ‘পৌত্তলিকতা বনাম ইসলাম’ বিষয়ে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই যখন আল্লাহর শাস্তি নেমে আসে, তখন তারাই সবার আগে পালিয়ে যায়। কারণ, তাদের মধ্যে ইসলামের প্রতি প্রকৃত বৈরিতা ছিল না, তারা শুধু চেয়েছিল টাকা। ভাড়াটে সৈন্যদের জোগাড় করার জন্য যারা টাকার জোগান দিয়েছে তাদের মধ্যে এক নম্বরে ছিল সাল্লাম। তাই মুসলিমরা তাকে শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একই সঙ্গে তাঁরা অন্যদেরও এই বার্তা দিতে চেয়েছেন: এরকম কাজ করলে মোটেই পার পাবে না। মুসলিমদের নির্মূল করার জন্য যদি কারও অর্থায়ন করার পরিকল্পনা থাকে, তাহলে আরেকবার ভেবে দেখো।’

সাল্লামের প্রাণনাশের পরিকল্পনা এসেছিল খাজরাজ গোত্রের কয়েকজনের কাছ থেকে। কীভাবে তাদের মাথায় এই চিন্তা এসেছিল? তারা দেখেছিল যে, আউসের লোকেরা কাব ইবনুল আশরাফের ব্যাপারে ‘ব্যবস্থা’ নিয়ে তাদের একরকম ‘হারিয়ে’ দিয়েছেন। তাই তাঁরা এমন কিছু করতে চেয়েছিল, যা থেকে বোঝা যাবে, তাঁরাও কোনো অংশে কম নন। নবিজি (সা) তাঁদের এই কাজের অনুমতি দেওয়ার সময় বললেন, “খেয়াল রেখো, তোমরা কোনো নারী বা শিশুকে যেন হত্যা না কর।” সেই সময়ে ‘বেসামরিক ব্যক্তি’ বলে কিছু ছিল না, ‘বিধিবদ্ধ সেনাবাহিনী’ বলতেও কিছু ছিল না। যুদ্ধের বয়সী প্রতিটি পুরুষ মানুষই যুদ্ধ করবে, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। নবিজি (সা) নারী ও শিশুদের হত্যা নিষিদ্ধ করে আসলে বুঝিয়েছেন, ‘বেসামরিক লোকদের হত্যা করবে না।

কাজটি সমাধা করতে খাজরাজ থেকে পাঁচজন স্বেচ্ছাসেবক এগিয়ে আসেন। তাঁদের নেতা ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আতিক। তাঁকে নেতা নির্বাচন করার কারণ হলো, তিনি অনর্গল খায়বারের লোকদের ভাষায় (হিব্রু ও আরবির মিশ্রণ) কথা বলতে পারতেন। সাহাবিরা কালবিলম্ব না করে খায়বারের উদ্দেশে রওয়ানা হন। মদিনা থেকে খায়বার তিন দিনের পথ। তাঁরা খায়বারের উপকণ্ঠে শিবির স্থাপন করে ভাবতে শুরু করেন কীভাবে ভেতরে ঢোকা যায়।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আবদুল্লাহ ইবনে আতিক একটা কৌশল বের করলেন। খায়বারের লোকেরা মাগরিবের সময় শহরে ঢোকার দরজা বন্ধ করে দিত। আবদুল্লাহ মাগরিবের সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। মাগরিবের ঠিক আগে আগে তিনি গ্রহরীর কাছাকাছি এমন এক স্থানে গিয়ে পৌঁছলেন যেখান থেকে প্রহরী তাঁকে দেখতে পায়। তারপর তিনি প্রস্রাব করার ভান করে কাছাকাছি দাঁড়ালেন। প্রহরী দরজা বন্ধ করার সময় দেখতে পেল কেউ একজন প্রস্রাব করছে। সে তাঁকে দেখে চিৎকার করে বলল, “তাড়াতাড়ি কর। আমি দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছি।” আবদুল্লাহ সুযোগ বুঝে পর মুহূর্তেই শহরের ভেতরে ঢুকে পড়লেন ।

আবদুল্লাহ শহরের ভেতরে ঢোকার পর কোথায় লুকিয়ে ছিলেন সিরাহের বইগুলোতে তার উল্লেখ নেই। রাত নামলে তিনি গিয়ে গেটটি আবার খুলে দিয়ে অন্য সাহাবিদের ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দেন। তারপর পাঁচজন দুর্গের ভেতরে সাল্লামের বাড়ি খুঁজে বের করেন। কীভাবে তাঁরা তা করেছিলেন তা আল্লাহ ভালো জানেন। তারপর তারা ঘরের ভেতরে ঢুকে সাল্লাম ইবনে আবি আল-হুকায়েককে হত্যা করেন। সাল্লামের স্ত্রী তাদের দেখে ফেলে এবং উচ্চস্বরে চিৎকার শুরু করে। এই অবস্থায় একজন সাহাবি তাকে হত্যা করতে উদ্যত হন, কিন্তু তাঁর হঠাৎ নবিজির (সা) সেই কথাটি মনে পড়ে যায়— তোমরা যেন কোনো নারী বা শিশুকে হত্যা করো না। তাই তিনি দ্রুত তলোয়ার নামান। তারপর পাঁচজন একসঙ্গে সেই স্থান ত্যাগ করেন।

সাল্লামের ঘরটি ছিল তার বাড়ির দোতলায়; সেটি এমনভাবে সুরক্ষিত ছিল যে নিচতলা থেকে সেই ঘরে ঢুকতে একটি মই বেয়ে উঠতে হতো। আবদুল্লাহ ইবনে আতিক চোখে কিছুটা কম দেখতেন, মই বেয়ে ওঠার সময় পড়ে গিয়ে তাঁর পা মচকে যায়। অন্য একজন সাহাবি তাকে কোলে করে বাইরে বের করে নিয়ে এসে দ্রুত মদিনায় ফিরে যান। আল্লাহই জানেন সাহাবিরা কীভাবে কাজটি করতে পেরেছিলেন। তাঁরা ফিরে আসার পর নবিজি (সা) আবদুল্লাহকে পা সোজা করতে বলেন; তিনি তাঁর পায়ে নিজের হাতটি একটু ঘষে দিলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় আবদুল্লাহর পা পুরোপুরি ঠিক হয়ে যায়।

 

সাল্লাম ইবনে আবি আল-হুকায়কের প্রাণনাশ | খন্দক ও হুদায়বিয়ার মাঝে ছোট ছোট অভিযান | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আমরা ৪৪তম পর্বে কাব ইবনুল আশরাফের প্রাণনাশের ঘটনার রাজনৈতিক পটভূমি ও কারণগুলো ব্যাখ্যা করেছি। ওই পর্বটি ভালোভাবে স্মরণ করলে সাল্লাম ইবনে আবি আল-হুকায়কের ঘটনাটি আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, যুগটি ছিল ভিন্ন, প্রেক্ষাপট ভিন্ন, সেই যুগের অনেক রীতিনীতিও ছিল ভিন্ন রকমের। উপরন্ত চারদিকে যুদ্ধাবস্থা লেগেই ছিল। আসলে, তখন এইভাবেই পৃথিবী চলত। পুরো ব্যাপারটা তখনকার মানুষের কাছে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য ছিল। আমরা কিছু আগে আলোচনা করেছি, আবু সুফিয়ান নবিজির (সা) প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল; অতএব ব্যাপারটি কখনই একপাক্ষিক ছিল না।

এই ঘটনা ছিল সেই সময় ও সমাজের প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য। এ নিয়ে কেউ সমালোচনা করতে চাইলে আমরা বলব, প্রথমে বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনা করুন, আপনার নিজের দেশ এখন কী করছে তা ভালো করে বুঝুন, তারপর ১৪ শ বছর আগে কোন দেশে কী ঘটেছিল তা নিয়ে সমালোচনা করুন। তবে তার মানে এই নয় যে মুসলিমরা যেখানে খুশি সেখানে এই কৌশল অবলম্বন করবেন। কোনো ইসলামি পণ্ডিত এ কথা বলেননি। প্রশ্ন উঠতে পারে, একজন খলিফা কি আমাদের সময়ে এমন কৌশল প্রয়োগ করতে পারেন? উত্তর হলো, এখন তো আমাদের কোনো খলিফা নেই; যদি কখনো হয় তাহলে তখন দেখা যাবে কী অনুমোদিত আর কী অনুমোদিত নয়।

আমাদের সময়ের কিছু পণ্ডিত-গবেষক আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের বিধিবিধানের সঙ্গে জেহাদের বিধিবিধানের সমন্বয় করে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের বক্তব্য এরকম: শরিয়া আমাদের আদি নির্দেশনাগুলোর মূল চেতনার মধ্যে থেকেই স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী কিছু পরিবর্তনের অনুমতি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক বিধান বা চুক্তি থাকে, যেমন জাতিসংঘের কোনো চুক্তি, তাহলে শরিয়া আমাদের সেই বিধানের সঙ্গে যতটা সম্ভব খাপ খাইয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুমোদন দেয়।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment