মদিনায় হিজরত: আৰু সালামার পরিবার | মদিনায় প্রাথমিক পর্যায়ে হিজরত,মুসলিমদের মধ্যে প্রথম মক্কা ছেড়েছিলেন আবু সালামা ইবনে আবদ আল- আসান। তিনি ছিলেন মক্কায় বসবাসকারী একজন মুক্ত ও অভিজাত ব্যক্তি। কিন্তু তিনি কুরাইশ ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী উম্মে সালামা ছিলেন একজন কুরাইশ। আৰু সালামা স্ত্রীর সঙ্গে বসবাসের জন্য মক্কায় আসেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই আবিসিনিয়ায় প্রথমবার হিজরতকারী মুসলিমদের দলে ছিলেন।
স্যাটানিক ভার্সেসের ঘটনার পর তাঁদের দুজনকে ‘দুইবার হিজরতকারী’ (প্রথমে আবিসিনিয়ায়, পরেরবার মদিনায়) মুসলিম বলা যেতে পারে। পরিকল্পনা অনুসারে আবু সালামা হিজরতের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ করলেন। স্ত্রী ও এক পুত্রকে জিনিসপত্রসহ উটের পিঠে চাপিয়ে তিনি মদিনার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। মদিনায় হিজরতকারী প্রথম ব্যক্তি হওয়ায় তিনি জানতেন না এতে কুরাইশরা কীভাবে এ ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাবে।

মদিনায় হিজরত: আৰু সালামার পরিবার | মদিনায় প্রাথমিক পর্যায়ে হিজরত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
তাই তিনি গোপনে যাত্রা করেননি। ধারণা করা হয়, তাঁর ক্ষেত্রে সংঘটিত অনভিপ্রেত ঘটনার কারণেই মুসলিমরা এরপর থেকে গোপনে হিজরত শুরু করেন। আবু সালামা যে চলে যাচ্ছেন এ কথা আগেই মক্কার মানুষদের মধ্যে চাউর হয়েছিল। সালামার যাত্রার শুরুতেই কুরাইশরা অস্ত্র নিয়ে তাঁর মুখোমুখি হয়ে বলল, “হে আবু সালামা! তুমি কোথায় চলে যাচ্ছ?” আবু সালামা বললেন, “আমি একজন মুক্ত/স্বাধীন মানুষ (অতএব আমি যেখানে খুশি সেখানেই যেতে পারি)। আমি ইয়াথরিবের উদ্দেশে যাচ্ছি।” কুরাইশরা বলল, “ঠিক আছে। তোমার ব্যাপারে আমাদের বলার নেই। কিন্তু তোমার স্ত্রী তো আমাদেরই একজন (অর্থাৎ একজন কুরাইশ)। তুমি তাঁকে নিয়ে যেতে পারবে না। তাঁর পুত্রকেও নিয়ে যেতে পারবে না, কারণ সে। আমাদের পুত্র।”
আসলে উম্মে সালামা বা তাঁর সন্তান নিয়ে কুরাইশদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না, এটা ছিল তাদের আবু সালামাকে নিপীড়ন কৌশল, কারণ তিনি মুসলিম হয়েছেন। তারা আবু সালামার স্ত্রী, সন্তান ও জিনিসপত্র রেখে খালি হাতে তাঁকে মক্কা থেকে তাড়িয়ে দিল। আবু সালামার গোত্র এই খবর জানার পর তাদের মধ্যেও জাহেলি মনোভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তারা কুরাইশদের কাছে গিয়ে বলল, “মহিলাটি তোমাদের, তা মানলাম। কিন্তু এই ছেলেটি তো আমাদের।” তারা আবু সালামার ছেলেকে নিয়ে যেতে চাইলে কুরাইশরা তাতে বাধা দেয়।

দুই বছর বয়সী শিশুটিকে নিয়ে টানাটানির একপর্যায়ে শিশুটির হাত মচকে যায়। ছেলের এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে উম্মে সালামা চিৎকার করে বললেন, “ছেলেটিকে আমার কাছে দাও।” এই পুরো ঘটনাটিই ছিল জাহেলি বর্বরতার এক নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ। কোনো পক্ষের কাছে ছেলেটির গুরুত্ব ছিল না। মূল বিষয়টি ছিল তাদের বংশমর্যাদা ও অহংকারের। শেষ পর্যন্ত আবু সালামার গোত্র উম্মে সালামাকে কুরাইশদের কাছে রেখে শিশুটিকে নিয়ে চলে গেল। আর ওদিকে আবু সালামা একাই চলে মদিনায় গেলেন।
উম্মে সালামা ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন: “১৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে আমি প্রতিদিন আল-বাতহা (মক্কার বাইরের প্রান্তসীমার একটি স্থান) পর্যন্ত। গিয়ে কান্নাকাটি করেছি। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। অবশেষে আমার কয়েকজন কাজিন আমার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে বনু মাখজুমের নেতাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করে যাতে তারা আমাকে মক্কা ছেড়ে চলে যেতে দেয়।”
উম্মে সালামা তাঁর স্বামীর গোত্রের কাছে চলে গেলেন। ততদিনে তাদের মেজাজ শান্ত হওয়ায় তারা শিশুটিকেও তাঁর কাছে ফিরিয়ে দিল। তিনি শিশুপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে মরুভূমির পথ ধরে মদিনার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। তাঁর মনে তখন একটিই ভাবনা, “আমাকে যে কোনোভাবে মদিনায় যেতে হবে।” তিনি মক্কার বাইরে তানিমের কাছে পৌঁছলে (যেখানে এখন ‘আয়েশা মসজিদ’ অবস্থিত), তাঁর সঙ্গে উসমান ইবনে তালহার সাক্ষাৎ হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উসমান তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি উম্মে সালামাকে ওরকম বিপজ্জনক জায়গায় একা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি এখানে কী করছেন?”
- উম্মে সালামা: আমি আমার স্বামী আবু সালামার কাছে ইয়াসরিবে যাচ্ছি।
- উসমান ইবনে তালহা : আপনি কি একা?
- উম্মে সালামা: আমার কেউ নেই ।
- উসমান ইবনে তালহা। আল্লাহর কসম, তা হবে না (অর্থাৎ আপনি একা যেতে পারেন না)। আমি আপনাকে (ইয়াসরিবে আপনার স্বামীর কাছে) পৌঁছে দেব।
উম্মে সালামা পরে সাহাবিদের কাছে এই ঘটনাটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, “আরবদের মধ্যে উসমান ইবনে তালহার চেয়ে ভদ্র ও মহৎ হৃদয়ের কোনো মানুষ আছে বলে আমার জানা নেই। তিনি আমাদের দুজনকে তাঁর উটের ওপর বসিয়ে মক্কা থেকে মদিনা পর্যন্ত পুরোটা পথ নিজে হেঁটে যান। পথিমধ্যে তিনি আমার সঙ্গে একটি কথাও বলেননি। কখনও থামার প্রয়োজন হলে তিনি উটটিকে নিচু হতে বলতেন, তারপর এগিয়ে গিয়ে আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াতেন।
আমি নারী বিধায় আমার সম্ভ্রমের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য তিনি এমনটি করতেন। দিনশেষে তিনি আমাকে গাছের নিচে ঘুমাতে দিয়ে নিজে দূরে গিয়ে উটের পাশে ঘুমাতেন। সকাল হলে আমি আবার উটের ওপর উঠে বসতাম। এভাবে পথ চলতে চলতে আমি একসময় ইয়াসরিবের বাড়িঘরগুলো দেখতে পেলাম। তিনি বললেন, ‘আপনার স্বামী সেখানে আছেন। এই বলে তিনি আমাকে উটে চড়ে সেখানে (শহরের ভেতরে) যেতে দিলেন।” এই ছিলেন উসমান ইবনে তালহা, যিনি কিনা তখনও মুসলিম হননি। পায়ে হেঁটে মক্কা থেকে মদিনা, যা ছিল কমপক্ষে দুই সপ্তাহের পথ। ভেবে দেখুন, মদিনা থেকে মক্কায় ফেরার পথে তাঁর কাছে নিজের উটটিও ছিল না।