ইয়াসির কাদি মত | বদরের যুদ্ধ-৫, আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হচ্ছে, মৃতেরা জীবিতদের কথা শুনতে পায় না। কিন্তু আল্লাহই ভালো জানেন। তবে আমাদের এই বিষয়ে কোনো একটি পক্ষ নিয়ে অতিরিক্ত কঠোর অবস্থানে যাওয়া উচিত হবে না। (৩)

ইয়াসির কাদি মত | বদরের যুদ্ধ-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (গনিমত) (8)
আবার আমরা বদরের যুদ্ধের আলোচনায় ফিরে যাচ্ছি। মুসলিমরা মদিনায় ফিরে আসার আগে বদরে সেই তিন দিন অবস্থানকালে আরেকটি বিষয়ের অবতারণা হয়েছিল। তা হলো যুদ্ধলব্ধ সম্পদ (আরবিতে ‘গানিমাহ’ বা ‘গনিমত’) সম্পর্কিত। আমরা কোরান ও সুন্নাহ থেকে জানতে পারি, পূর্ববর্তী উম্মতদের ক্ষেত্রে যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিজয়ী দলের মালিকানায় নেওয়ার বিধান ছিল না। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা মহানবি মুহাম্মদের (সা) উম্মত ব্যতীত অন্য কোনো উম্মতের জন্য যুদ্ধলব্ধ সম্পদ হালাল করেননি, যা ওন্ড টেস্টামেন্টের (৫) বর্ণনা এবং হাদিস দ্বারাও সমর্থিত ।
বদরের যুদ্ধ শেষে শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া প্রচুর পরিমাণ সম্পদ যুদ্ধের ময়দানে পড়ে ছিল। মুসলিমরা ভাবলেন, এগুলো নিয়ে কী করণীয়। এ নিয়ে সাহাবিদের মধ্যে কিছুটা আলোচনাও শুরু হলো। যেহেতু সাহাবিরা যুদ্ধের সময় ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাই প্রতিটি দলই নিজেদের মতো করে যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ওপর মালিকানা দাবি করল। এক দল বলল, আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলাম এবং সেখান থেকে সম্পদগুলো সংগ্রহ করেছি।
সুতরাং এগুলো শুধু আমাদেরই পাওয়া উচিত। অন্য একটি দল বলল, আমরা কুরাইশদের খাওয়া করেছিলাম যাতে তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসতে না পারে। আমরা যদি তা না করতাম তাহলে তোমরাও সম্পদগুলো সংগ্রহ করার সুযোগ পেতে না। এবার তৃতীয় দল বলল, আমরা যুদ্ধের সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে নবিজির (সা) পাশে থেকেছি যাতে শত্রুপক্ষ তাঁর ওপর আক্রমণ না করতে পারে। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে রক্ষা করা। তাহলে তোমরা আমাদের কেন সম্পদের অংশ থেকে বঞ্চিত করবে? বরং আমরাও তো এর প্রাপ্যদের মধ্যে পড়ি।

সাহাবিরা কিন্তু এ নিয়ে কোনো ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হননি, যুক্তিতর্কসহ আলোচনা করিছেলন। একপর্যায়ে সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস একটি সুন্দর তলোয়ার নিয়ে নবিজির (সা) সামনে হাজির হলেন। তিনি যুদ্ধে যাকে হত্যা করেছিলেন তলোয়ারটি তার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তিনি নবিজিকে (সা) সেটি দেখিয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, এই তলোয়ার আমাকে আমার কাছেই রাখতে দিন। আল্লাহর কসম, আমি নিজে যুদ্ধে এটা ব্যবহার করেছি।” আর তখনই বদরের যুদ্ধক্ষেত্রের ঘটনাবলি প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা সুরা আনফালের প্রথম আয়াতগুলো নাজিল করেন।
“(হে মুহাম্মদ) লোকে তোমাকে আনফাল (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলো, ‘যুদ্ধলব্ধ সম্পদ আল্লাহ ও রসুলের। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো এবং নিজেদের মধ্যে সম্ভাব রক্ষা করো। যদি তোমরা সত্যিকার (অর্থে) মুমিন হও তবে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করো।” (সুরা আনফাল, ৮:১) আল্লাহ তখন সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন যে, লোভের বশবর্তী হয়ে কোনোভাবেই ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। সম্পদের চেয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সবার মাঝে বিতরণ করা যেতে পারে। কীভাবে তা করতে হবে ফিকহের সেই হিসেবটি বেশ জটিল। আমরা তার বিস্তারিত বিবরণে না গিয়ে সুরা আনফালের [৮:৪১] থেকে যতটুকু জানা যায় তা সংক্ষেপে আলোচনা করব:
যুদ্ধলব্ধ মোট সম্পদের পাঁচ ভাগের এক ভাগ (২০%) আলাদা করে রেখে বাকি অংশ (৮০%) সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতে হবে। তারপর ওই পাঁচ ভাগের এক ভাগকে আবার সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করে নিচে উল্লিখিত প্রাপকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে: ১. এক ভাগ নবি করিমের (সা) জন্য বরাদ্দ। তা শুধু তাঁর জীবদ্দশাতেই দেওয়া হতো, তাঁর মৃত্যুর পরে এটি আর প্রযোজ্য ছিল না। ২. এক ভাগ পাবেন নবি-পরিবারের সদস্যরা (আহলে বায়েত)। সুন্নি ফিকহ অনুসারে নবি-পরিবারের সদস্যদের সম্মানপূর্বক এই ভাগটি দেওয়া হতো। উল্লেখ্য, সুন্নিদের সংজ্ঞা অনুসারে আহলে বায়েতের আকার শিয়াদের সংজ্ঞার চেয়ে বড় [৬] ।
৩. এক ভাগ অনাথদের জন্য । ৪. এক ভাগ দরিদ্র মানুষদের জন্য ।
৫. এক ভাগ মুসাফিরদের জন্য, যারা অর্থকষ্টে রয়েছে।
এভাবে ২০%-কে ৫ ভাগ করলে উপরে উল্লিখিত প্রতিটি ভাগে যুদ্ধলব্ধ মোট সম্পদের ৪% করে পড়ে। বণ্টনের এই রীতি বদরের যুদ্ধের সময় থেকে অনুসরণ করা হয়। খায়বারের যুদ্ধের পরে নবিজি (সা) এই নিয়ম কিছুটা পরিবর্তন করেন; যাঁরা ঘোড়া বা উট নিয়ে যুদ্ধ করেছেন তিনি তাঁদের পদাতিক যোদ্ধাদের চেয়ে তিনগুণ বেশি সম্পদ দেওয়ার নিয়ম প্রচলন করেন।
আবার, ৯ জন সাহাবি বদরে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত না থেকেও যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ভাগ পেয়েছিলেন। যুদ্ধে না যাওয়ার পেছনে তাঁদের প্রত্যেকেরই যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উসমান ইবনে আফফান (রা)। বদরের যুদ্ধের সময় তাঁর স্ত্রী রুকাইয়া (নবিজির (সা) কন্যা) অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। তা সত্ত্বেও উসমান যুদ্ধে অংশ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নবিজি (সা) তাঁকে স্ত্রী রুকাইয়ার পরিচর্যা করতে বলেন। তাই উসমান (রা) মদিনায় স্ত্রীর কাছেই রয়ে যান। নবিজি (সা) যুদ্ধ শেষে ফিরে আসার দিনই রুকাইয়া মৃত্যুবরণ করেন। সেদিনই তাঁর দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। [আমরা এ বিষয়ে পরে আরও আলোচনা করব।
আরও পড়ুনঃ