এক হাজার ফেরেশতার বাহিনী | বদরের যুদ্ধ-৪, পবিত্র কোরান থেকে আমরা জানতে পারি, আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের সাহায্য করার জন্য বদরে ঠিক এক হাজার ফেরেশতা পাঠিয়েছিলেন। আল্লাহ বলেন: “স্মরণ করো, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কাছে কাতর প্রার্থনা করেছিলে, তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন (ও বলেছিলেন), ‘আমি তোমাকে সাহায্য করব সহস্র ফেরেশতা দিয়ে যারা একের পর এক আসতে থাকবে।” [সুরা আনফাল, ৮:৯] এখানে আল্লাহ বলছেন, ‘আমি তোমাকে সাহায্য করব’, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুমি কিছু না করেই বসে থাকবে, আয়েশ করবে। তা হবে না।
তুমি তোমার কাজ করো এবং আমি তোমাকে সাহায্য করব। আল্লাহ কোরানে বলেছেন: “স্মরণ করো, তোমাদের প্রতিপালক ফেরেশতাদের ওপর ওহি প্রেরণ করেন, “আমি তোমাদের সাথে আছি, সুতরাং মুমিনদের সাহস দাও।’ যারা কুফরি করে আমি তাদের হৃদয়ে ভয় ঢুকিয়ে দেব। সুতরাং তোমরা তাদের ঘাড়ে ও আঙুলের অগ্রভাগে আঘাত করো।” [সুরা আনফাল, ৮:১২] এখানেও ফেরেশতারা মুমিনদের সাহায্য করেছেন বলে বলা হয়েছে। মুমিনরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, আর ফেরেশতারা যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করেছেন।

এক হাজার ফেরেশতার বাহিনী | বদরের যুদ্ধ-৪ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
সিরাহের বইগুলোতে বেশ কয়েকটি ঘটনার বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, সাহাবিরাও ফেরেশতাদের স্বচক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন। আমরা এর আগের পর্বে উল্লেখ করেছি, নবিজি (সা) বলেছিলেন, জিব্রাইল (আ) পাগড়ি পরে সশস্ত্র অবস্থায় ঘোড়ায় চড়ে চলে এসেছেন। ফেরেশতারাও বাহন হিসেবে ঘোড়া ব্যবহার করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, ফেরেশতারা সশস্ত্র অবস্থায় ছিলেন কেন? কারণ, আল্লাহ হয়তো আমাদের দেখাতে চেয়েছিলেনন যে, কোনো কিছু অর্জন করার ক্ষেত্রে এমনকি ফেরেশতাদেরও প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
সহিহ মুসলিমে আছে, ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেছেন: বদরের যুদ্ধে এক সাহাবি এক মুশরিকের পেছনে ধাওয়া করেন। তিনি তাঁর সামনে থেকে আসা চাবুকের শব্দ শুনতে পান। তিনি আরও শুনতে পান, আরোহীটি তার ঘোড়াকে বলছে, “সামনে চলো, হাইজুম।” ওই আরোহী ছিলেন আসলে একজন ফেরে’শতা। সাহাবি মুশরিককে আক্রমণ করতে উদ্যত হতে না হতেই দেখলেন তার (মুশরিকটির) নাক কাটা পড়েছে।
অর্থাৎ, সাহাবি নিজের তলোয়ার নামানোর আগেই ফেরেশতা সেই মুশরিকের নাক কেটে ফেলেছেন । মূল বিষয়টি হলো, ফেরেশতারা মুমিনদের ‘সাহায্য’ করেছিলেন। মুমিনরা প্রতিটি কাজ শুরু করলেও ফেরেশতারা সেগুলো সম্পন্ন করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে নবিজি (সা) সাহাবির কাছ থেকে ঘটনাটি শোনার পর বলেন, “তুমি যা বলেছ তা সব সত্য। তা ছিল তৃতীয় আকাশ থেকে আল্লাহর পাঠানো সাহায্য।”
মুশরিকদের পক্ষে আব্বাস একজন শক্তিশালী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যুদ্ধে তিনি এমন একজন আনসারির হাতে যুদ্ধবন্দি হিসাবে আটক হন, যিনি ছিলেন তাঁর তুলনায় খাটো ও গাট্টাগোট্টা গড়নের। আব্বাসকে যখন নবিজির (সা) কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি একদিকে রাগান্বিত ছিলেন, অন্যদিকে বিব্রত বোধ করছিলেন। আনসারি অহমিকাবোধ থেকে কিছু বলার আগেই তিনি বলে ওঠেন, “এই লোক আমাকে বন্দি করেনি।”
আনসারি বলেন, “না, আমিই তাঁকে বন্দি করেছি।” আব্বাস আশেপাশে তাকিয়ে বললেন, “না, যে ব্যক্তি আমাকে বন্দি করেছিল তার চুল সিঁথি করা ছিল। এরকম সুদর্শন লোক আমি আগে কখনও দেখিনি। তার ঘোড়াটি ছিল সাদা ও কালো রঙের এক চমৎকার সংমিশ্রণ। সে এখন কোথায়? আমি তো তাকে দেখতে পাচ্ছি না।” আনসারি আবারও বলেন, “না, আল্লাহর রসুল। আমিই সেই ব্যক্তি, যে তাঁকে বন্দি করেছে। নবিজি (সা) তখন আনসারিকে বলেন, “চুপ থাকো।

আল্লাহ তোমাকে একজন ফেরেশতা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।” নবিজি (সা) নির্দিষ্ট করে আব্বাস ও আবু আল-বুখতুরির কথা বলেছিলেন। নবিজি (সা) বিভিন্ন সময় যারা মুসলিমদের ভালো চেয়েছেন, তাদের কাছ থেকে পাওয়া অনুগ্রহগুলো ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আরেকটি বর্ণনায় আছে, নবিজি (সা) বলেছিলেন, বনু হাশিমের সবাইকে যেন মেরে ফেলা না হয়, কেননা তাদের যুদ্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছিল ।
সুতরাং আমরা যারা অমুসলিম দেশে বাস করি, আমাদের আশেপাশের সব অমুসলিমকে এক দৃষ্টিতে দেখা উচিত নয়। অনেক অমুসলিমই আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সব ধর্মের লোকদের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চায় বিশ্বাসী। যারা ‘ইসলাম-বিদ্বেষ’ ছড়ায় তাদেরকে এদের সঙ্গে এক কাতারে ফেলা ঠিক নয়, সিরাহ থেকে আমরা সেই শিক্ষাই পাই। যারা আমাদের সঙ্গে ন্যায়নিষ্ঠ ও সম্মানজনক আচরণ করে, অবশ্যই তাদের প্রাপ্য অনুগ্রহ ও সম্মান ফিরিয়ে দিতে হবে। অমুসলিম হলেও তাদের অনেকেই সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ায়। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিশ্বাস তাদের সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আবু আল বুখতুরি ও মুর্তিম ইবনে আদি ছিলেন এমনই দুজন মানুষ।
আরেকজন আনসারির বর্ণনা অনুসারে, বদরের যুদ্ধে তাঁর পিতা এক শত্রুর পেছনে ধাওয়া করেছিলেন। একপর্যায়ে তলোয়ার উন্মুক্ত করে আক্রমণ করার আগেই তিনি দেখতে পেলেন যে লোকটি তাঁর সামনে মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। আনসারিটি বর্ণনা করেছেন, তাঁর পিতা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁকে কেউ সাহায্য করেছে। এই সাহাবির নাম জানা না গেলেও আমরা হাদিসের পরম্পরাকে সঠিক ও সত্য বলে গ্রহণ করতে পারি। আরেকটি হাদিস অনুসারে, জুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রা) বদরের যুদ্ধের সময় একটি হলুদ পাগড়ি পরে ছিলেন। তাঁর অনুকরণে সব ফেরে’শতাই হলুদ পাগড়ি পরে নেমে এসেছিলেন। এটি জুবায়েরের জন্য ছিল অত্যন্ত সম্মানের ব্যাপার।
এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহ কেন এক হাজার ফেরেশতাকে পাঠালেন যেখানে একজন ফেরেশতাই যথেষ্ট ছিল। জিব্রাইল (আ) একাই এত বেশি ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন যে, যখন আল্লাহ লুতের (আ) সম্প্রদায়কে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন {২}, তখন জিব্রাইল তাঁর আসল রূপ ধারণ করে শুধু তাঁর ডানার একটি ছোট্ট অংশ দিয়ে মাটিতে আঘাত করেন; আর সেই আঘাতেই শহরগুলো পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ফেরেশতারা যখন এতটাই শক্তিশালী তখন একজন ফেরে’শতাকে না পাঠিয়ে এক হাজার জনকে পাঠানোর কারণ কী?
কোরান ও সুন্নাহতে যে কথাটি বারবার বলা হয়েছে তা হলো, আপনি চেষ্টা ছাড়া কিছুই লাভ করতে পারবেন না, এমনকি জান্নাতও নয়। আপনাকে চেষ্টা করে যেতে হবে, যদিও সেই চেষ্টার ফলে আশানুরূপ ফল নাও আসে। উদাহরণ হিসেবে জান্নাতের কথা ধরা যেতে পারে। আমরা জানি না, আমাদের চেষ্টার পরেও আমরা জান্নাতে যেতে পারব কি না। তবে আমাদের জান্নাত পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের চেষ্টার মান দেখবেন, পরিমাণ নয়। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও যদি আপনি সফল না হন তবে আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন।
একাকী মরিয়ম (আ) যখন প্রসববেদনায় কষ্ট পাচ্ছিলেন, তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁকে বলেন, “চিন্তা করো না, আমি তোমাকে সাহায্য করব…তবে তোমাকে গাছটি ধরে ঝাঁকাতে হবে।” মরিয়মের (আ) সে সময় উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ছিল না। তবু আল্লাহ বলেছিলেন, “ঠিক আছে, তুমি যতটুকু পার ততটুকুই করো (অর্থাৎ গাছটি ঝাঁকাও)।” [১৯:২৫] [৩]। এমনকি মরিয়মও (আ) সেই অবস্থায় চেষ্টা ছাড়া কিছুই পাননি। যদি মরিয়মের (আ) ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে থাকে তাহলে আমাদের কথা বলাই বাহুল্য। মুসলিমদের জন্য বিজয় নির্ধারিতই ছিল, তবু তা অর্জন করতে তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে কুরাইশ বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়েছে। এটিই ছিল বদরের যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়।
উকাশা ইবনে মিহসান (রা)
বদরের যুদ্ধে উকাশা ইবনে মিহসান (রা) তলোয়ার দিয়ে একজনের বর্মে আঘাত করলে তাঁর তলোয়ারটি ভেঙে যায়। তিনি নবি করিমকে (সা) বলেন, “হে আল্লাহর রসুল, আমার তো একটাই মাত্র তলোয়ার, এখন আমি কী করব?” নবিজি (সা) তাঁকে কয়েকটি ডালপালা দিয়ে বললেন, “এই নাও, এগুলো দিয়ে যুদ্ধ করো।” উকাশা নবিজির (সা) কথা শুনে দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। যেই না তিনি ডালগুলো উপরে উঁচিয়ে ধরেছেন, অমনি সেগুলো একটি তলোয়ারে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এমন সুন্দর তলোয়ার উকাশা জীবনে কখনও দেখেনি।
উকাশা এর পর থেকে প্রতিটি যুদ্ধে এই তলোয়ারটি দিয়েই লড়াই করেন। তিনি আরও অনেক বছর পরে ১১ই হিজরি সালে আবু বকরের (রা) খেলাফতের সময় মুসায়ালিমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে শহিদ হন। কথিত আছে, তাঁকে কবর দেওয়ার সময় সেই তলোয়ারটিও তাঁর সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল।
আরও পড়ুনঃ