ওহি নাজিলের সূচনা | জায়েদ বিন হারিসা এবং ওহি নাজিলের শুরু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

ওহি নাজিলের সূচনা | জায়েদ বিন হারিসা এবং ওহি নাজিলের শুরু, কীভাবে ওহি নাজিলের শুরু হয়েছিল তা আয়েশার (রা) বর্ণনায় এক বিস্তারিত হাদিসে উল্লিখিত আছে। হাদিসটি বেশ বড়, প্রায় দুই পৃষ্ঠা দীর্ঘ। ঘটনার এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা থেকে আমরা একটা চমৎকার বিষয় লক্ষ করি; তা হলো, নবিজি (সা) তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আয়েশার (রা) সঙ্গে অনেক গভীর বিষয়ে বিশদ আলাপ করতেন ।

 

ওহি নাজিলের সূচনা | জায়েদ বিন হারিসা এবং ওহি নাজিলের শুরু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

ওহি নাজিলের সূচনা | জায়েদ বিন হারিসা এবং ওহি নাজিলের শুরু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

‘উম্মুল মুমিনিন’ আয়েশার (রা) বর্ণনায় সহিহ বুখারির হাদিসটি নিম্নরূপ: “আল্লাহর রসুলের (সা) কাছে সর্বপ্রথম ‘ঐশ্বরিক অন্তঃপ্রেরণা’ এসেছিল তাঁর নিদ্রাবস্থায় বাস্তব স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা-ই দিবালোকের মতো প্রকাশিত হতো। অতঃপর তিনি ধীরে ধীরে নির্জনতা পছন্দ করতে শুরু করেন, এবং তিনি একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে ‘হেরা’র গুহায় নির্জনে অবস্থান করতে থাকেন। সেখানে তিনি এক নাগাড়ে বেশ কয়েক দিন ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। মাঝে মাঝে তিনি খাদিজার (রা) কাছে ফিরে এসে কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এভাবেই ‘হেরা’ গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাঁর নিকট ওহি নাজিল হয় ।

ফেরেশতা এসে বললেন, ‘পাঠ করুন।’ নবিজি (সা) বললেন, ‘আমি পড়তে জানি না।’ আল্লাহর রসুল (সা) বলেন: অতঃপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। অতঃপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘পাঠ করুন।’ আমি বললাম, “আমি তো পড়তে জানি না।’ তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। অতঃপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন: ‘পাঠ করুন।” আমি আবার উত্তর দিলাম, ‘আমি তো পড়তে জানি না।’ তিনি আমাকে তৃতীয়বার জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন।

তারপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘পাঠ করুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পাঠ করো, আর (জেনে রাখো) আপনার প্রতিপালক অতিশয় দয়ালু।” [সুরা আলাক, ৯৬:১-৩]। অতঃপর আল্লাহর রসুল (সা) মনের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আন্তঃপ্রেরণা নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন। সে সময় তাঁর বুক থরথর করে কাঁপছিল। তিনি ঘরে ফিরে খাদিজাকে (রা) বললেন, ‘আমাকে ঢেকে দাও, আমাকে ঢেকে দাও।’ খাদিজা তাঁকে চাদর দ্বারা আবৃত করার পর তাঁর ভয় কিছুটা কাটল। তখন তিনি খাদিজার (রা) কাছে পুরো ঘটনা জানিয়ে বললেন, ‘আমার নিজেকে নিয়ে ভয় লাগছে।’

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

খাদিজা (রা) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ্ আপনাকে কখনোই অবমাননা করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের পাশে দাঁড়ান, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন। সযত্নে অতঃপর তাঁকে নিয়ে খাদিজা (রা) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফেল ইবনে আসাদ ইবনে আবদ আল-উজ্জার কাছে গেলেন। ওয়ারাকা জাহেলি যুগে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি হিব্রু ভাষায় লিখতে পারতেন এবং ‘ইনজিল’ (গসপেল)’ অনেকটা পর্যন্ত হিব্রুতে লিখেছিলেন।

সেই সময় ওয়ারাকার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিল, তিনি চোখে দেখতে পেতেন না। খাদিজা (রা) তাঁকে পুরো ঘটনাটি শোনার জন্য অনুরোধ করলেন। রসুল (সা) ওয়ারাকার জিজ্ঞাসার জবাবে যা যা ঘটেছে তার সবই বর্ণনা করলেন। সব শুনে ওয়ারাকা বললেন, ‘এ হচ্ছে সেই বার্তাবাহক (অর্থাৎ ফেরেশতা জিব্রাইল) যাকে আল্লাহ মুসার (আ) কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমার বয়স যদি কম হতো এবং আমি যদি সেদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতাম, যেদিন তোমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তোমাকে বের করে দেবে।’

রসুল (সা) বললেন, ‘তারা আমাকে বের করে দেবে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, তুমি যা নিয়ে এসেছ, সে রকম বার্তা (অর্থাৎ ওহি) এর আগে যারাই নিয়ে এসেছে, তাদের সবার সঙ্গেই বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করা হয়েছে। সেদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকলে তোমাকে আমি ভালোভাবেই সাহায্য করব।’
এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা মারা যান। আর ওহির আগমনেও কিছু সময়ের জন্য বিরতি ঘটে।”

 

ওহি নাজিলের সূচনা | জায়েদ বিন হারিসা এবং ওহি নাজিলের শুরু | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আয়েশা (রা) জানিয়েছেন, নবি করিম (সা) জাবল আল-নূরের (আলোর পর্বতের) হেরা গুহায় জনমানব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। এই গুহাটি ছিল একটু অন্য রকমের, যে কোনো গুহার মতো নয়। এটা ছিল এক ধরনের গর্ত। গুহার ভেতরে মাত্র একজন মানুষের বসার মতো জায়গা ছিল। বসতে গেলে কাবার দিকে মুখ করে বসতে হবে এবং সেখান থেকে কাবাঘর দেখাও যায়। সেখানে বসলে চমৎকার মৃদুমন্দ বাতাসও গায়ে লাগে। ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে, গুহাটি আবিষ্কার করেছিলেন আবদুল মুত্তালিব। নবিজি (সা) কিছু খাবার ও পানি নিয়ে সেখানে যেতেন এবং মাঝে মাঝেই বেশ কয়েক রাত ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। খাবার ও পানি ফুরিয়ে গেলে তিনি বাড়ি ফিরে আসতেন। কিছু দিনের জন্য পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে কিছু খাবার ও পানি নিয়ে আবার গুহায় ফিরে যেতেন।

সেই সময়ের কথা স্মরণ করে রসুল (সা) বলেছেন, ‘ওহি আসার আগের দিনগুলোতে আমি গুহায় যাতায়াতের পথে পাথরের শব্দ শুনতে পেতাম। মনে হতো পাথরগুলো যেন আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে। সেখানে একটি নির্দিষ্ট পাথর আমাকে সব সময় সালাম জানাত; আমি আজও ওই পাথরটি দেখে চিনতে পারি।’ আয়েশা (রা) আরও বর্ণনা করেছেন, ‘আল্লাহর রসুল (সা) যেসব স্বপ্ন দেখতেন সেগুলো বাস্তবের মতোই ছিল, অর্থাৎ বাস্তবে পরিণত হতো। তিনি স্বপ্নের ব্যাপারে জানতে চাইলে খাদিজা (রা) বলেছিলেন, ‘এটা অবশ্যই আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা ভালো নিদর্শন। এখান থেকেও আমরা খাদিজার (রা) বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার প্রমাণ পাই। সহিহ বুখারিতে উল্লেখ রয়েছে, রসুল (সা) পুরো ছয় মাস ধরে এরকম স্বপ্ন দেখেছিলেন।

মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবনের ওই সময়টাতেই বা কেন এসব ঘটনা ঘটছিল? ১) আশ্চর্যজনক একটা কিছু যে ঘটতে চলেছে তার কিছু লক্ষণ প্রকাশের মাধ্যমে তাঁকে প্রস্তুত করে তোলা। ২) নবি-রসুল হওয়ার জন্য আধ্যাত্মিক ও মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন । জীবনের এ পর্যায়ে মুহাম্মকে (সা) নবি হিসাবে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়া চলছিল। তিনি যে ছয় মাস ধরে স্বপ্ন দেখছিলেন, পাথরের সালাম শুনছিলেন, এসবই তাঁকে নবির ভূমিকায় উন্নীত হওয়ার (অর্থৎ ওহি নাজিলের আগে আধ্যাত্মিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করার বিভিন্ন পদ্ধতি ।

প্রথম ওহি নাজিল হওয়ার সময়টাতে নবিজি (সা) নিজেকে সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছিলেন। [মাঝে মাঝেই দৈনন্দিন কাজকর্ম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে একাকী আল্লাহর প্রার্থনায় মনোনিবেশ করাটা অবশ্যই আধ্যাত্মিকতা বিকাশের জন্য মঙ্গলময়। কিন্তু প্রার্থনার জন্য সারা জীবনের জন্য সংসার ত্যাগ করাকেও ইসলাম সমর্থন করে না।

কিছু বর্ণনায় উল্লেখ আছে, রমজান মাসের কোনো এক শনিবারে নবি করিম (সা) একটি আলো দেখতে পান এবং সেই সঙ্গে একটি শব্দ শুনতে পান। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে তিনি তেমন কিছুই দেখতে পাননি। পরের দিন রোববারও একই ঘটনা ঘটে, অর্থাৎ আলো ও শব্দ পেলেও কিছুই দেখতে পাননি। তারও পরের দিন সোমবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে: জিব্রাইল (আ) তাঁর কাছে আসেন। সহিহ মুসলিমের হাদিসে আছে, নবিজি (সা) বলেছেন, “আমি সোমবার জন্মগ্রহণ করেছি এবং সোমবার প্রথম ওহি নাজিল হয়েছিল।” কদরের রাতও ওই একই দিনে, অর্থাৎ সোমবারে।

আরো পড়ুনঃ

প্রথম পর্যায় | ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের দাওয়াত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

মুহাম্মাদ

Leave a Comment