কুরাইশদের পরাজয় | বদরের যুদ্ধ-৫, যুদ্ধের একপর্যায়ে কুরাইশরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। আধুনিক যুগের কিছু সামরিক বিশ্লেষক মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে লক্ষ করেছেন, বদর থেকে মক্কায় ফিরে যাওয়ার জন্য একটাই মাত্র ভালো রাস্তা ছিল। নবি করিম (সা) চাইলে সেটি বন্ধ করে দিতে পারতেন যেন কুরাইশরা পালিয়ে যেতে না পারে। কিন্তু তিনি তা করেননি। অতএব ধারণা করা যায়, তিনি কুরাইশদের পালানোর সুযোগ দিয়েছিলেন। আধুনিক সামরিক বিশ্লেষকদের ভাষায় এটিকে বলে ‘প্রেসার ভাল্ভ আউটলেট’ রেখে দেওয়া।
অর্থাৎ তিনি কুরাইশদের পিছু হটে পালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি পরিষ্কার পথ খোলা রেখেছিলেন। যখন যুদ্ধরত কেউ জানে যে হেরে গেলে মৃত্যু ছাড়া পালাবার আর কোনো পথ খোলা নেই, তখন সে মরণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। কিন্তু যদি সে জানতে পারে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে যাওয়ার পথ খোলা আছে, তাহলে ভাববে, ‘দরকার হলে তো আমি পালিয়ে যেতেই পারি’। ফলে সে যুদ্ধে সুবিধা করতে না পারলে আর মরিয়া হয়ে লড়বে না। ঠিক ওই খোলা পথটি দিয়েই কুরাইশরা পিছু হটে চলে যায় ।
যুদ্ধের সর্বশেষ ফলাফল: এক হাজারেরও বেশি কুরাইশ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের মধ্যে মারা গিয়েছিল ৭০ জন এবং প্রায় ৭৩-৭৪ জনকে যুদ্ধবন্দি করা হয়েছিল। অর্থাৎ, কুরাইশ বাহিনীর প্রায় ১৫ শতাংশ হয় মারা গেছে নয়তো যুদ্ধবন্দি হয়েছে। আর মুসলিমদের পক্ষ থেকে কেউ যুদ্ধবন্দি হয়নি, শহিদ হয়েছিলেন ১৫ জন। মুসলিমদের এই সংখ্যাটি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের ৫ শতাংশেরও চেয়েও কম।

কুরাইশদের পরাজয় | বদরের যুদ্ধ-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
কুরাইশরা পালিয়ে যাওয়ার পর নবিজি (সা) সাহাবিদের আবার নতুন করে বিভিন্ন দলে ভাগ করেন । তিনি তাঁদের জানিয়ে দেন যে তাঁরা তিন দিন বদরেই অবস্থান করবেন ।
অতিরিক্ত তিন দিন থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে যে কারণগুলো থাকতে পারে:
১. যুদ্ধে যাঁরা শহিদ হয়েছেন তাঁদের কবর দেওয়া। উল্লেখ্য, শহিদদের নিয়ে করণীয় বিষয়ে এই প্রথম শরিয়তের কিছু বিধান জারি হয়। সেগুলো হলো:
(ক) শহিদের লাশকে গোসল করানোর প্রয়োজন নেই । (খ) শহিদের জন্য জানাজার নামাজ পড়ার প্রয়োজন নেই ।
(গ) শহিদ যে স্থানে মৃত্যুবরণ করবেন সেখানেই তাঁকে দাফন করতে হবে। সুতরাং বদরের যুদ্ধে যারা শহিদ হয়েছিলেন তাঁদের সবাইকে সেখানেই দাফন করা হয়েছিল।
(ঘ) শহিদদের দেহের ক্ষত পরিষ্কার করার দরকার নেই। নবিজি (সা)
বলেছেন, যখন একজন শহিদকে পুনরুত্থিত করা হবে তখন তাঁর রক্ত থেকে
কম্ভরীর গন্ধ বের হবে। (ঙ) শহিদদের সেই পোশাকেই দাফন করতে হবে, যে পোশাকে তিনি
মৃত্যুবরণ করেছেন। ২. কুরাইশরা যেন পাল্টা আক্রমণ করতে না পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া।
৩. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, যুদ্ধে কে জিতেছে আর কে হেরেছে তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেওয়া। অতিরিক্ত যে তিন দিন নবিজি (সা) ও সাহাবিরা বদরে অবস্থান করেছিলেন, সেই সময়ের মধ্যে কুরাইশরা ফিরে এসে প্রতি-আক্রমণ করার সাহস পায়নি। সুতরাং মুসলিম বাহিনী যে যুদ্ধে জয়লাভ করেছিল তা ছিল দিবালোকের মতই স্পষ্ট।
যুদ্ধে যে ১৫ জন সাহাবি শহিদ হন তাঁদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা কবরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। অন্যদিকে কুরাইশদদের যে ৭০ জনের বেশি লোক মারা গিয়েছিল, তাদের মৃতদেহগুলো একটি কূপে ফেলে বালু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং বলা যায়, শরিয়ত অনুসারে মুসলিম বাহিনীর হাতে নিহত শত্রুপক্ষের মৃতদেহের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করার প্রয়োজন রয়েছে। তাদের মৃতদেহগুলো মুসলিম শহিদদের মতো দাফনের ব্যবস্থা না করা হলেও রোদে পুড়ে পচে যেতে দেওয়া হয়নি। অবশ্য শুধু একটি লাশ দাফন করা হয়নি, সেটি
ছিল উমাইয়া ইবনে খালাফের, যা আমরা গত পর্বে উল্লেখ করেছি। বদরের প্রান্তরে তিন দিন অবস্থান করার পর নবিজি (সা) মদিনার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। শুরুতেই তিনি কাফেলা নিয়ে থামলেন সেই কূপটির কাছে, যেখানে যুদ্ধে নিহত কুরাইশদের মৃতদেহগুলো ফেলে রাখা হয়েছিল। তিনি সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুশরিক নেতাদের একে একে নাম ধরে ডাকলেন, “হে উতবা ইবনে রাবিয়া হে ওয়ালিদ ইবনে উতবা, হে আবু জেহেল ইত্যাদি। তারপর তিনি বললেন, “তোমরা কি তোমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতির সত্যতা খুঁজে পেয়েছ? আমি কিন্তু (আমাকে দেওয়া) আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রমাণ পেয়েছি।”
তা দেখে উমর (রা) বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, আপনি কীভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন যাদের দেহে আত্মা বা প্রাণ নেই?” জবাবে নবিজি (সা) বললেন, “যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম খেয়ে বলছি, এই মূহুর্তে তারা আমার কথা যতটা শুনতে পাচ্ছে, তুমি তার চেয়ে ভালো শুনতে পাচ্ছ না (অর্থাৎ তারা আমার কথা খুব স্পষ্টভাবেই শুনতে পাচ্ছে), কিন্তু তারা আমাকে সাড়া দিতে পারছে না।”
এই হাদিস সহিহ মুসলিমে বর্ণিত আছে। বর্ণনাকারীদের মধ্যে কাতাদা এই হাদিসটি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন: “(সেই সময়) আল্লাহ তাদের পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন যেন তারা নবিজির (সা) কথাগুলো শুনতে পায়, যেন তারা আরও লাঞ্ছিত ও অপমানিত বোধ করে, এবং যেন তাদের নিজেদের প্রতি অনুশোচনা ও অপরাধবোধ জন্মায়।”

আনুষঙ্গিক বিষয়: কবরস্থ মৃতরা কি জীবিতদের কথা শুনতে পারে?
কবর থেকে মৃতরা কি জীবিতদের কথা শুনতে পায়? তারা কি জানতে পারে জীবিত কোন ব্যক্তি তার কবরের কাছে এসেছে? এটি একটি ধর্মতাত্ত্বিক বিষয় যা নিয়ে সাহাবিদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। বদরের যুদ্ধের পরবর্তী এই ঘটনা এ বিষয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যপ্রমাণ। ঘটনার সত্যতা নিয়ে কোনো মতভেদ নেই, সবাই জানে তা ঘটেছিল। তবে সাহাবি, তাবেয়িন ও পণ্ডিত-গবেষকেরা বিষয়টি নানাভাবে ব্যাখ্যা করেন।
ইবনে উমরসহ (রা) একদল বলেন, মৃত ব্যক্তিরা কবরে থাকা অবস্থায় সেখানে আসা জীবিত ব্যক্তিদের কথা শুনতে পায়। কিন্তু আয়েশাসহ (রা) অন্য দলের মত অনুসারে, মৃতরা জীবিত ব্যক্তির কথা শুনতে পায় না। ‘আথারি’ {১} ও ‘আশআরি’ [২] পণ্ডিতেরাও এই ইস্যুতে দুই ভাগে বিভক্ত।
এ বিষয়ে কোরানের কয়েকটি আয়াত:
“যারা কবরে রয়েছে তাদের তো তুমি শোনাতে পারবে না।” [সুরা ফাতির, 35:22]
“তুমি তো মৃতকে কথা শোনাতে পারবে না, বধিরকেও না। ওরা যখন তোমার ডাক শোনে তখন মুখ ফিরিয়ে নেয়।” [সুরা রুম, ৩০:৫২] “তুমি তো মৃতকে তোমার কথা শোনাতে পারবে না, বধিরকেও না। ওরা যখন তোমার ডাক শোনে তখন ওরা মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সুরা নামল, 29:80] এই আয়াতগুলো থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, মৃতেরা জীবিতদের কথা শুনতে পায় না ।
কয়েকটি হাদিস:
এখন আমরা দেখব, হাদিসে এ সম্পর্কে কী বলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি হাদিস অনুসারে, মৃতরা জীবিতদের কথা শুনতে পায় বলে ধারণা করা যায়; এ থেকেই পণ্ডিত-গবেষকদের মধ্যে ভিন্নমত ও বিতর্কের সূত্রপাত ।
১. মানুষ মারা গেলে তার আত্মা কী অবস্থায় থাকে তা নিয়ে সহিহ বুখারিতে একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত আছে। হাদিসটির একটি বাক্য এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক, যেখানে নবিজি (সা) বলেছেন: “কাউকে কবর দিয়ে চলে যাওয়ার সময় কবরে থাকা ব্যক্তি সেই সকল জীবিত লোকদের পায়ের শব্দ শুনতে পায়।”
২. সহিহ বুখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আরেকটি বিখ্যাত হাদিসও এক্ষেত্রে তথ্যপ্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেটি হলো, নবি করিম (সা) বাকি আল- ঘরকাদ’ জিয়ারত করার সময় সেখানকার সব কবরবাসীর উদ্দেশে সালাম জানিয়ে বলেছিলেন, “আসসালামু আলাইকুম।”
৩. একটি মুতাওয়াতির হাদিসের মাধ্যমে বিষয়টির পক্ষে আরেকটি প্রমাণ
দেওয়া হয়, যেখানে নবিজি (সা) বলেছেন, “যে-ই আমাকে সালাম প্রেরণ করবে,
আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠিয়ে সালাম দেবার বিষয়টি আমাকে জানিয়ে
দেবেন।”
৪. আরেকটি হাদিস অনুসারে নবিজি (সা) বলেছেন, “যখন কেউ কোনো পরিচিত ব্যক্তির কবরের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে সালাম জানায়, তখন কবরে থাকা ব্যক্তিটিও সালাম প্রদানকারী ব্যক্তিটিকে চিনতে পারে এবং তাকে উত্তরে পাল্টা সালাম জানায়।” কিন্তু এটি একটি দুর্বল হাদিস, ছয়টি বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থের কোনোটিতেই এর উল্লেখ নেই। ইবনে হিব্বান, ইবনে আসাকির, তারিখ দিমাস্ক প্রমুখের লেখা কিছু অখ্যাত বইয়ে এই হাদিসটি পাওয়া যায় ।
মৃতরা জীবিতদের কথা শুনতে পায়—এই মতে পক্ষে আরও একটি ঘটনা তথ্যপ্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা কোনো হাদিস নয়। তা হলো সাহাবি আমর ইবনুল আসের মৃত্যুর সময়ের একটি ঘটনা। আমর ছিলেন মক্কা বিজয়ের আগে হিজরত করা শেষ তিন সাহাবির মধ্যে একজন। তিনি যখন মৃত্যুপথযাত্রী তখন সন্তানদের ডেকে বলেছিলেন, “আমাকে কবর দেবার পর তোমরা আমার কবরের পাশে ততক্ষণ পর্যন্ত থাকবে যতক্ষণ না একটি প্রাণীকে জবাই করে তার মাংস অন্যদের মাঝে বিতরণ করা হয়।” (অর্থাৎ, ‘একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমরা সেখানে থাকবে।’) তাঁর সন্তানেরা এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার পাশে সেই সময় তোমাদের উপস্থিতি আমাকে শান্ত রাখবে, ফলে আমি আমার প্রতিপালকের বার্তাবাহকদের (মুনকার ও নাকির) প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব।”
আরও পড়ুনঃ