কুরাইশ পক্ষের অবস্থা | বদরের যুদ্ধ-৩, এবার দেখা যাক, কুরাইশদের দিকে তখন কী অবস্থা বিরাজ করছিল। রমজানের ১৭ তারিখের সকাল । কুরাইশরা এখনও মুসলিম বাহিনীর আকার কীরকম হতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি। তারা ফজরের পরে তাদের সবচেয়ে অভিজ্ঞ স্কাউট উমায়ের ইবনে ওয়াহাব আল-জুমাজিকে খবর নিতে পাঠাল। উমায়ের বদরের সমভূমির আশেপাশে অনেকদূর পর্যন্ত ঘুরে ফিরে দেখল। তারপর সে ফিরে গিয়ে কুরাইশদের বলল, “ওরা সংখ্যায় আনুমানিক ৩০০ জন।
তবে আমার মনে হচ্ছে, এখানে একটি বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে চলেছে। ওদের পক্ষে ইয়াসরিবের বেশ কিছু যুবক আছে, তাদের কাছে তলোয়ার ছাড়া আর কিছুই নেই (অর্থাৎ যুদ্ধের অস্ত্রশস্ত্র বলতে যা বোঝায় যেমন বর্ম, বর্শা, বল্লম ইত্যাদি, তাদের কাছে তেমন কিছুই নেই), কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকেই যেন মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। সুতরাং তারা মরিয়া হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আল্লাহর কসম, আমি মনে করি তোমরা তাদের একজনকে হত্যা করতে চাইলে তারাও তোমাদের মধ্যে অন্তত একজনকে হত্যা করতে সক্ষম হবে।

কুরাইশ পক্ষের অবস্থা | বদরের যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
যদি তোমাদের মধ্যে ৩০০ জন মারা যায়, তাহলে সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে তোমরা কী আনন্দ পাবে? (অর্থাৎ যদি তোমাদের তিন ভাগের এক ভাগ মানুষই মারা যায় তাহলে এই যুদ্ধ করে কী লাভ?) । এখন তোমরা যা খুশি তা করতে পার।” উমায়ের আসলে মুসলিম বাহিনীর মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় লক্ষ করেছিল। কিন্তু আৰু জেহেল তাকে বলল, “আমরা তো তোমার কাছ থেকে কোনো পরামর্শ চাইনি।” হাকিম ইবনে হিজাম নামের আরেকজন ব্যক্তিও যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করছিল।
উল্লেখ্য, তার পুত্র হিজাম ইবনে হাকিম ইবনে হিজাম ছিলেন একজন সাহাবি, যিনি মুসলিম পক্ষে অবস্থান করছিলেন। হাকিম উতবা ইবনে রাবিয়ার কাছে গেল । আমরা জানি, উতবা প্রথম দিন থেকেই যুদ্ধ চায়নি। হাকিম উতবাকে এ ব্যাপারে একটি মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ করে বলল, “তোমরা কেন আল- হাদরামির রক্তঋণ গ্রহণ করছ না?” উল্লেখ্য, আমর আল-হাদরামি ছিল সেই ব্যক্তি যে পবিত্র মাসে ছয় সাহাবির দ্বারা আক্রান্ত কাফেলায় মারা গিয়েছিল। কুরাইশরা বারবার বলছিল, “এরা আল-হাদরামিকে হত্যা করেছে। আমাদের তার প্রতিশোধ নেওয়া দরকার।
উতবা কুরাইশ নেতাদের বলল, “ঠিক আছে। প্রাণহানি রোধ করতে যদি রক্তঋণ শোধ করতে হয়, তবে আমি সেই টাকা দেব।” এটি ছিল অনেক টাকার ব্যাপার। উতবা আল-হাদরামির আত্মীয়দের উদ্দেশ করে বলল, “টাকাটা আমি দেব।” অর্থাৎ যুদ্ধের কারণ হিসেবে আল-হাদরামির নাম আর ব্যবহার করো না। উতবা আরও বলেছিল, “যদি কেউ তোমাদের কাপুরুষ বলে অভিযুক্ত করে তাহলে তোমরা আমার নাম ব্যবহার করে সবাইকে বলো যে উতবাই কাপুরুষের মতো আচরণ করেছে; যদিও তোমরা জানো যে আমি মোটেই কাপুরুষ নই । এই লোকটির (মুহাম্মদ (সা)) সাথে যুদ্ধ করে তোমরা কী অর্জন করবে? যুদ্ধে যদি তাকে পরাস্ত করতে সক্ষমও হও, তাহলেও তোমরা হারাবে নিজেদেরই পিতা, ভাই, চাচাতো ভাই, ভাতিজা, ভাগ্নে ইত্যাদিকে।

নিজেদের বাবা কিংবা ভাইয়ের হত্যাকারীদেরকে নিজেদের মধ্যে দেখতে পেলে তোমাদের কেমন লাগবে?” (অর্থাৎ ‘তোমরা নিজেরা তাদের হত্যা না করলেও তোমাদের বাহিনীরই কেউ তোমাদের পিতা কিংবা পুত্রকে হত্যা করবে, এবং সেটা নিজের চোখের সামনে দেখতে কি তোমাদের ভালো লাগবে?’) উতবা আরও বলল, “এসো, আমরা ফিরে যাই এবং মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের সাথে বোঝাপড়ার ভার বাকি আরবদের ওপর ছেড়ে দিই। তারা যদি তাকে পরাজিত করে, তবে তোমরা যা চাও তা তো হয়েই গেল এবং আমাদের হাত আত্মীয়দের রক্তে রঞ্জিত করতে হলো না। কিন্তু যদি এর অন্যথা হয় (অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা) তাদের পরাজিত করেন), তাহলে অবশ্যই তাঁর সম্মানের মধ্যে আমাদের সম্মানও নিহিত রয়েছে, কারণ শেষ পর্যন্ত সে তো একজন কুরাইশ। তখন তো আমাদের ক্ষমা করার জন্য তাঁর কাছে একটি অজুহাত থাকবে।”
উতবা এসব কথা বলছিল তার লাল উটের পিঠে চড়ে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে করতে। নবিজি (সা) তাকে সেই সময় মুসলিম শিবির থেকে দেখতে পেয়েছিলেন। উতবাকে এভাবে বলতে দেখে হাকিম খুব খুশি হয়ে আবু জেহেলের কাছে ছুটে গিয়ে বলল, “উতবা হাদরামির রক্তের অর্থ দিতে রাজি হয়েছে, এখন তো আমরা এই সম্ভাব্য রক্তপাত এড়াতে পারি।” কিন্তু আবু জেহেল তৎক্ষণাৎ বিদ্রুপের সঙ্গে হাকিমকে জিজ্ঞেস করল, “হে হাকিম, উত্তরা কি তোমাকে ছাড়া আর কোনো বার্তাবাহক পেল না? (অর্থাৎ, ‘তুমি কি এখন উতবার চাকর হয়ে গিয়েছ?”)” হাকিম জবাবে বলল, “আমি মোটেই তার বার্তাবাহক নই। তবে আমি এই বার্তার সঙ্গে একমত। আমি কোনো রক্তপাত চাই না।”
আবু জেহেল যখন জানতে পেল যে তার দলের লোকেরা মন পরিবর্তন করছে, তখন সে আল-হাদরামির ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলল, “তুমি কি তোমার ভাইয়ের জন্য কিছু সোনাদানা পেলেই খুশি হবে? তোমার কি মানসম্মান বলতে কিছু নেই?” আল-হাদরামির ছোট ভাইকে এভাবে বোঝানোর পর সে উঠে দাঁড়িয়ে কুরাইশ বাহিনীর সামনে যুদ্ধ করার পক্ষে এক আবেগময় বক্তব্য রাখল ।
এরপর আবু জেহেল বলল, “হে উতবা, তুমি তো মুসলিম বাহিনীকে দেখে কাপুরুষ হয়ে গেছ।” এ পর্যায়ে উতবা তার অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলল । লক্ষ করুন, উতবা নিজেই বলেছিল, “আমাকে তোমরা কাপুরুষ বলতে চাইলে বলো।” কিন্তু আবু জেহেল তাকে সত্যি সত্যি ‘কাপুরুষ’ বলে অভিহিত করার পর সে আর তার আগের অবস্থানে স্থির থাকতে পারল না। উতবা বলল, “এই লোকটি (আবু জেহেল) আমার প্রতি অবমাননাকর মন্তব্য করেছে, আমাকে কাপুরুষ বলে অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু এবার সে দেখতে পাবে আসল কাপুরুষ কে।” এই কথা বলে সে নিজের ভাই এবং ছেলেকে ‘মুবারাজা’য় অংশ নিতে তার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকল ।
লক্ষ করুন, নবি করিম (সা) এখানে উতবার প্রজ্ঞার প্রশংসা করেছেন, যদিও তা ইসলামি মূল্যবোধ থেকে আসেনি, এসেছে জাহেলি ভাবধারা থেকে। উতবা কিন্তু এমনটি বলছে না, “তারা সত্যের উপরে রয়েছে এবং আমরা বাতিলের উপর আছি।” বরং সে গোষ্ঠীতন্ত্রের ধারণা থেকেই চেয়েছিল, যুদ্ধটি যাতে না হয়।কুরাইশ বাহিনী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে গেলে আৰু জেহেল উঠে উচ্চস্বরে আল্লাহর কাছে দোয়া করল, “হে আল্লাহ, এই দুই বাহিনীর মধ্যে সমাজে যারা বেশি অমঙ্গল ডেকে এনেছে, যারা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছে এবং অপরিচিত ধর্মীয় মতবাদ চালু করেছে, আজ তারা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করুক।” সে বিন্দুমাত্র বুঝতে পারল না যে সে আসলে নিজেদের (কুরাইশদের) বিরুদ্ধেই দোয়া করছে.
কারণ এই তিনটি বিষয়েই কুরাইশরা মুসলিমদের চেয়ে বেশি দোষী:
(১) যারা অধিকতর অমঙ্গল এনেছে,
(২) যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, এবং
(৩) যারা নতুন মতবাদ নিয়ে এসেছে। নবি করিম (সা) ইব্রাহিমের (আ) এর মতবাদ অর্থাৎ তওহিদ নিয়ে এসেছেন, যা ছিল আরবদের মূল ধর্মতত্ত্ব। অন্যদিকে কুরাইশরা নতুন মতবাদ অর্থাৎ পৌত্তলিকতা অনুসরণ করছে।
কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করতে নিষেধ
নবিজি (সা) মুসলিম বাহিনীকে এই দুই ব্যক্তিকে হত্যা করতে নিষেধ করেছিলেন:
১. তাঁর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব,
২. আবু আল-বুখতুরি ইবনে হিশাম, যিনি মক্কায় বয়কট ভাঙার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
নবিজি (সা) আরও কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন, “এই ব্যক্তিরা যুদ্ধে এলেও তারা আসলে যুদ্ধ করতে চায়নি। তারা এখানে আসতে বাধ্য হয়েছে।”
আরও পড়ুনঃ