এই ঘটনা থেকে ফিকহ বিধান | বনু কুরায়জা উপজাতি, নবিজির (সা) আদেশ শহরের আনাচে-কানাচে ঘোষণা করা হলেও সাহাবিদের সবাই তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন সম্ভবত ইতিমধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন; আবার কেউ কেউ ঘোষণাটি একটু দেরিতে শুনতে পেয়েছিলেন। তাই সাহাবিরা বনু কুরায়জার দুর্গের কাছে পৌঁছেন এক সঙ্গে নয়, পর্যায়ক্রমে। কেউ কেউ আগেই পৌঁছে গিয়ে যথাসময়ে সেখানে আসরের নামাজ আদায় করতে পেরেছিলেন।
এই ঘটনা থেকে ফিকহ বিধান | বনু কুরায়জা উপজাতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

কেউ কেউ সূর্যাস্তের সময় যাত্রার মাঝপথে ছিলেন; তাই দ্বিধায় পড়েন: আমাদের কি এখনই আসরের নামাজ পড়ে নেওয়া উচিত যাতে তা বাদ না পড়ে যায়? নাকি নবিজির (সা) আদেশ হুবহু পালন করা উচিত? অর্থাৎ বনু কুরায়জার কাছে না পৌঁছা পর্যন্ত আসরের নামাজ পড়তে পারব না, এমনকি তা যদি বাদ পড়েও যায়? তাঁরা এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিলেন না।
কেউ কেউ সূর্য ডোবার আগে মাঝপথেই নামাজ পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু অন্যরা আসরের ওয়াক্ত পেরিয়ে গেলেও বনু কুরায়জার কাছে না পৌঁছা পর্যন্ত নামাজ না পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন (তাঁরা পরে ‘কাজা’ নামাজ পড়েছিলেন)। সবাই পৌঁছার পর সাহাবিরা তাঁদের দ্বিধা এবং দুই রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা নবিজিকে (সা) জানালেন। তিনি কোন পক্ষেরই সমালোচনা করেননি। বরং তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। কিছু দুর্বল হাদিস অনুসারে, তিনি বলেছিলেন, “তোমাদের দুই পক্ষই ঠিক কাজ করেছ।” সঠিক ভাষ্যটি হলো, তিনি কোনো পক্ষেরই সমালোচনা করেননি।

এই ঘটনাটি থেকে আমাদের জন্য লক্ষণীয়
১. যখন সমান যোগ্যতাসম্পন্ন মুজতাহিদরা একটি ইজতেহাদের মাধ্যমে দুই রকমের সিদ্ধান্তে উপনীত হন, তখন কোনো একটি পক্ষ অন্য পক্ষের ইজতেহাদ থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত অনুসরণ করতে বাধ্য নয়। সাহাবিরাও নিজেদের মধ্যে মতভিন্নতা সত্ত্বেও অবশেষে নিজেদের ইজতেহাদ অনুসরণ করেছিলেন, কিন্তু একে অপরের সমালোচনা করেননি। তবে ইজতেহাদের জন্য আপনাকে যোগ্য হতে হবে।
২. যখন নবিজি (সা) আদেশ দিয়েছিলেন, বনু কুরায়জার কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত কেউ আসরের নামাজ পড়বে না, কোনো সন্দেহ নেই যে তখন তিনি একটি অর্থ মনে রেখেই আদেশটি দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সাহাবিরা পরিষ্কার দুটি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন।
কিছু পণ্ডিতের ধারণা অনুসারে, নবিজির (সা) কথার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ থাকতে পারে। কিন্তু এই ধারণার সঙ্গে একমত হওয়া যায় না। চূড়ান্ত সত্য তো শুধু একটাই। কিন্তু কেউ যদি আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ভুল করে, তাহলে তার পাপ হবে না, বরং সে পুরস্কৃত হবে। সুতরাং আমাদের ‘সত্য’ এবং ‘পুরস্কারের’ মধ্যে পার্থক্যটি বুঝতে হবে। সহিহ বুখারিতে আছে, নবিজি (সা) বলেছেন, “একজন (যোগ্য) শাসক /বিচারক যখন বিচার করেন, তখন তার সিদ্ধান্ত যদি সঠিক হয় তবে তিনি দুটি পুরস্কার পাবেন, আর তা যদি ভুল হয় তাহলে তিনি একটি পুরস্কার পাবেন।”
লক্ষ করুন, নবিজি (সা) কিন্তু বলেননি যে সাহাবিদের উভয় দলই ঠিক। উভয়ই সঠিক হতে পারে না। দুইজন পণ্ডিত দুটি ভিন্ন ফতোয়া দিতে পারেন, কিন্তু আল্লাহ আজ্জা ওয়াজালের চোখে তাদের মধ্যে একজনই সঠিক হবেন। বনু কুরায়জার এই ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গিয়েছে, এটির পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা আর নেই। এ জন্যই হয়তো তিনি বিষয়টি আর স্পষ্ট করেননি।
৩. কোরান ও সুন্নাহর ভাষাকে আমরা কতটা আক্ষরিকভাবে নেব, কিংবা আমরা এর মধ্যে কিছুটা যুক্তির ব্যবহার করতে পারি কি না, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে মতভিন্নতা (‘ইখতিলাফ’) চলে এসেছে। কেউ তা আক্ষরিক অর্থে মেনে চলতে চাইতে পারেন, আবার কেউ যুক্তি সহযোগে বিবেচনা করতে চাইতে পারেন। তবে এই মতভিন্নতা শুধু ফিকহের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, আকিদার ক্ষেত্রে নয়। আকিদার বিষয় এলে যেভাবে আছে সেভাবেই আমরা পুরোটাই গ্রহণ করি। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ যখন ফেরেশতাদের বর্ণনা দেন, আমরা নির্দ্বিধায় তা বিশ্বাস করি। আমরা তা শুনি এবং মেনে চলি ।
ফিকহের বিষয়ে সাহাবিদের সময় থেকেই মতভিন্নতা ছিল, তা এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মাজহাব এবং আধুনিক মুজতাহিদদের মাধ্যমে অব্যাহত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মাহরাম ছাড়া নারীদের চলাফেরার বিষয়টি দেখা যায়। হাদিসে খুব স্পষ্ট করে বলা আছে, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও কেয়ামতের দিনে বিশ্বাস রাখে, সে যেন কোনো নারীকে তিন (অন্য বর্ণনায়, এক) দিনের বেশি মাহরাম ছাড়া ভ্রমণের অনুমতি না দেয়।” এ ক্ষেত্রে আমরা কি বলতে পারি, ‘দেখুন, সেই সময় এবং সেই জায়গা নারীদের জন্য নিরাপদ ছিল না এবং আল্লাহ জানতেন নারীদের একা চলাফেরা করলে কী অসুবিধা হতে পারে।
কিন্তু বর্তমানে যদি আপনি আপনার স্ত্রী বা আপনার বোনকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়ে আসেন এবং অন্য কেউ তাঁকে পরের বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে যায়, তবে তো তা যথেষ্ট নিরাপদ। এটা তো মরুভূমির অনিশ্চিত পথে চলাচল করার মতো বিষয় নয়। সুতরাং এই বিষয়ে কি আমরা অতটা আক্ষরিক না হয়ে কিছুটা যুক্তির প্রয়োগ করতে পারি?’ এর উত্তরে কিছু পণ্ডিত বলবেন, হ্যাঁ; আবার কেউ কেউ বলবেন, না ।
বনু কুরায়জার এই ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারি, সাহাবিদের সময় থেকেই মুসলিমদের মধ্যে যৌক্তিকতা (‘র্যাশনালিটি’) বনাম আক্ষরিকতা (‘লিটারালিজম’)—এই দুটি ধারাই বিদ্যমান ছিল। উভয় ফতোয়াই গ্রহণযোগ্য, যতক্ষণ পর্যন্ত তা যোগ্য আলেমদের কাছ থেকে আসছে। তাই আমাদের কোনো পক্ষেরই সমালোচনা করা উচিত নয়, যদিও শুধু একটি পক্ষই সঠিক।
সাহাবিদের প্রতি নবিজির (সা) ওই আদেশের বিষয়ে আমার (ইয়াসির কাদি) মত হলো, যখন তিনি বলেছিলেন, “বনু কুরায়জার কাছে না পৌঁছা পর্যন্ত আসরের নামাজ পড়বে না”, তখন তা ছিল কেবল একটি অভিব্যক্তি। অর্থাৎ তিনি বলছেন, “তাড়াতাড়ি করো, শীঘ্রই সেখানে পৌঁছতে হবে।” সুতরাং তাঁর এই কথা আক্ষরিকভাবে বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
আরও পড়ুনঃ