ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় | ওহুদের যুদ্ধ-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় | ওহুদের যুদ্ধ-১,  ১. এই ঘটনা থেকে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যদের সঙ্গে পরামর্শ (‘শুরা’) করার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি। নবি করিম (সা) প্রথমে মদিনাতেই থাকার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের মত অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাননি। আল্লাহ পবিত্র কোরানের সুরা শুরার ৩৮ নম্বর আয়াতে পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেছেন:

“আসলে তোমাদের যা কিছু দেওয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ, কিন্তু আল্লাহর কাছে যা আছে তা আরও ভালো ও আরও স্থায়ী-তাদের জন্য যারা  ইমান আনে ও তাদের প্রতিপালকের ওপর নির্ভর করে, যারা গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে, আর রাগ করেও ক্ষমা করে দেয়, যারা তাদের প্রতিপালকের ডাকে সাড়া দেয়, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে কর্মসম্পাদন করে ও তাদেরকে যে-জীবনের উপকরণ আমি দিয়েছি তার থেকে ব্যয় করে; আর যারা অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ নেয়।” [সুরা শুরা, ৪২:৩৬-৩৯] নবিজির (সা) যখন মনে হলো যে, বেশির ভাগ সাহাবিই মদিনার বাইরে গিয়ে যুদ্ধ করতে আগ্রহী, তখন তিনি তাঁদের মত মেনে নিলেন।

 

ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় | ওহুদের যুদ্ধ-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় | ওহুদের যুদ্ধ-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

২. এখানে প্রবীণ সাহাবিদের বিচক্ষণতার দিকটিও লক্ষ করার মতো। প্রথমত, তাঁরা নবিজির (সা) পরামর্শ মেনে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা নবিজির (সা) উপস্থিতিতে তরুণ সাহাবিদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করেননি। এখানে তাঁদের উন্নত শিষ্টাচারের নমুনা দেখতে পাই। তাঁরা তো প্রথমেই তরুণদের বলতে পারতেন, “তোমরা কি একটু থামবে? নবিজি (সা) তাঁর মতটা জানিয়েছেন, এবং আমরা ইতিমধ্যে আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।” কিন্তু একজন নেতার সামনে, বিশেষ করে নবিজির (সা) সামনে, নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক করা অভদ্রতা বলে তাঁদের মনে হয়েছিল ।

৩. তরুণরা সাধারণত বেশি উৎসাহী ও কৌতূহলী হয়ে থাকে। বয়স্কদের চেয়ে তাদের সাহস থাকে বেশি, সেইসঙ্গে থাকে কিছুটা অহংবোধ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এসব বৈশিষ্ট্য দিয়েই তরুণদের মনোজগৎ গঠন করেছেন। তারুণ্যের এই স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে:

তারা ভালো পথে যেতে পারে; উদাহরণ: আসহাবে কাহাফ {১} । আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানের সুরা কাহাফে তাঁদের কথা উল্লেখ করেছেন: “আমি তোমার কাছে ওদের বৃত্তান্ত সঠিকভাবে বয়ান করছি। ওরা ছিল কয়েকজন যুবক । ওরা ওদের প্রতিপালকের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল।” [১৮:১৩] – কখনও তারা ভালো উদ্দেশ্য নিয়েও ভুল পথে যেতে পারে; উদাহরণ: ওহুদের যুদ্ধের আগের এই ঘটনায় তরুণ সাহাবিরা।

আবার কখনও তারা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েই ভুল পথে পা বাড়াতে পারে; উদাহরণ: সামুদের নয়জন তরুণ। আল্লাহ পবিত্র কোরানের সুরা নামলে তাদের কথা উল্লেখ করেছেন: “আর সেই শহরে ছিল এমন নয় (তরুণ) ব্যক্তি যারা দেশে অশান্তি সৃষ্টি করত, কোনো ভালো কাজ করত না।” [২৭:৪৮] অনেক তরুণ ধর্মের ব্যাপারে অতিউৎসাহী হয়ে পড়ে ধর্মবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ে, আবার কেউ কেউ ভালো উদ্দেশ্য সত্ত্বেও ধর্মানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

আজকের দিনে বিশ্বজুড়ে চলমান চরমপন্থী জঙ্গিবাদী কার্যক্রমের দিকে লক্ষ করলে দেখতে পাই, ইসলামের নামে যেসব কাজ করাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি তার বেশিরভাগের পেছনেই রয়েছে অতিউৎসাহী তরুণরা। যারাই তাদের সমালোচনা করে, ক্ষোভ ও উৎসাহের আতিশয্যে তাদেরই তারা ‘মুনাফেক’ কিংবা ‘দালাল’ তকমা লাগিয়ে দেয়। কোনো বিষয়ে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ছাড়াই অতিরিক্ত উৎসাহের কারণে এ রকম হয়। তারা মনে করে, এভাবেই এগিয়ে যেতে হবে এবং এটিই সঠিক জেহাদ। কিন্তু আমরা জানি, এটি সঠিক পথ নয়। তরুণদের উচিত ধৈর্যধারণ করা এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের কথা শোনা; কারণ বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদের মতো একই রকম তরুণ বয়স পার করে এসেছেন।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

৪. নবি বর্ম পরলে তা যুদ্ধ শেষ করার আগ পর্যন্ত না খোলা তাঁদের (নবিদের) জন্য একটি বিশেষ শরিয়তি বিধান। আল্লাহর পক্ষ থেকে নবিদের জন্য বিশেষ কিছু বিধান ছিল যা তাঁদের মেনে চলতে হতো। পবিত্র কোরানের অন্যান্য আয়াত ও কিছু হাদিস থেকেও আমরা এ বিষয়টি জানতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, নবিজির (সা) জন্য প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া ওয়াজিব ছিল, কারণ আল্লাহ পবিত্র কোরানের সুরা মুজাম্মিলে বলেছেন, “তুমি রাত্রিতে প্রার্থনার জন্য দাঁড়াও রাত্রির কিছু অংশ বাদ দিয়ে।” [93:2] ইবনে তাইমিয়ার মতে, আমাদের বাকিদের জন্য তাহাজ্জুদ নামাজ ওয়াজিব নয়। প্রশ্ন জাগতে পারে, বর্ম বিষয়ে নবিদের জন্য এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে কী কারণ থাকতে পারে? এ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা হতে পারে, বর্ম পরিধান করে তা খুলে ফ্লোকে পরাজয়, দ্বিধাগ্রস্ততা ও কাপুরুষতা মনে হতে পারে ।

৫. ওহুদের যুদ্ধে কী ঘটতে চলেছে তা আমরা সবাই জানি। আমরা দেখতে পাব, তরুণ সাহাবিদের পরামর্শটি সঠিক ছিল না। তবে এখানে লক্ষণীয়, সিদ্ধান্তের ফল খারাপ হওয়ার পরেও তরুণ সাহাবিদের সমালোচনা করা হয়নি। কেউ তাদের এমন কিছু বলেনি, ‘দেখলে? আগেই বলেছিলাম না?’ আল্লাহ পবিত্র কোরানেও বলেছেন: “… আর কাজেকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করো। আর তুমি কোনো সংকল্প গ্রহণ করলে আল্লাহর প্রতি নির্ভর করবে।”

[সুরা আলে ইমরান, ৩:১৫৯] নবিজি (সা) বলেছেন, “তোমাদের এ কথা বলা উচিত নয়, ‘আমি যদি এমনটা করতাম, তাহলে অমনটা হতো।’ বরং বলো, ‘আল্লাহ যা চেয়েছিলেন তা-ই হয়েছে।’ কারণ ‘যদি এমন হতো’ ধরনের কথাবার্তা শয়তানের কুমন্ত্রণার (‘ওয়াসওয়াসা’) দরজা খুলে দেয়।” অতএব কোনো বিষয়ে একবার ‘সঠিকভাবে’ মনস্থির করার পরে আর কাউকে দোষারোপ করা ঠিক নয়।

 

ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় | ওহুদের যুদ্ধ-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

এই ‘সঠিকভাবে’ মনস্থির করা বলতে আমরা কী বুঝব? এ বিষয়ে ইসলাম

আমাদের দুটি কাজ করতে বলে:

(১) ইস্তেখারার নামাজ পড়া; এবং

(২) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করা।

যে কোনো ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনি এই দুটি কাজ করতে পারেন। ধরুন, এ দুটি কাজ করার পরও আপনার নেওয়া সিদ্ধান্তের ফল ভালো বা আশানুরূপ হয়নি। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। আপনি যা সবচেয়ে ভালো বলে মনে করেছিলেন, তা-ই করেছেন। এরপর আল্লাহর উপর এই ভরসা রাখুন, তিনি নিশ্চয়ই আপনার জন্য আরও ভালো কিছুর পরিকল্পনা করেছেন, যা হয়তো আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন না। ওহুদের যুদ্ধেও ঠিক এমনটিই ঘটেছিল, যা আমরা পরবর্তী সময়ে জানতে পারব।

৬. ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, যুদ্ধের সময় নবিজি (সা) একসঙ্গে দুই সেট বর্ম পরতেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তো তাঁকে রক্ষা করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁর তো বর্মের দরকার ছিল না। তবু তিনি বর্ম পরেছিলেন তাঁর উম্মতকে দেখানোর জন্য। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, কোনো কাজ করলে তা যথাযথভাবে করতে হবে। তার মানে হলো, আপনাকে যুদ্ধে যেতে হলে তার জন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হতে হবে, যেমনটি নবিজি (সা) করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালাও যুদ্ধের ব্যাপারে পবিত্র কোরানের সুরা নিসায় বলেছেন: “হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সতর্কতা অবলম্বন করো।” |৪:৭১]

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment