এই পর্ব থেকে শিক্ষণীয় | বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি, ১. মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অসীম ন্যায়বিচারের বিষয়টি লক্ষ করুন। তাঁর চেয়ে উত্তম বিচারক আর কে হতে পারে? আল্লাহ মুসলিমদের ভুল ক্ষালন করেননি; অর্থাৎ তাঁদের ভুল থেকে রেহাই দেননি। কিন্তু তিনি বলেন যে কুরাইশদের অপরাধ আরও ভয়াবহ। এটিই আল্লাহর শরিয়তের নমুনা, তাঁর সীমাহীন ন্যায়বিচারের প্রকাশ।
২. কোনো বিজয়ই সহজে আসে না। এমনকি আল্লাহর নবিদেরও বিজয় হাতে তুলে দেওয়া হয় না, তাঁদেরও কষ্ট করতে হয়, পরিবার ও প্রিয়জনদের ত্যাগ করতে হয়। নবিজি (সা) নিজেও কোনো কোনো অভিযানে আহত হয়েছেন। পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং আন্তরিকতা প্রদর্শন করলেই কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কাউকে সাফল্য দান করবেন।

এই পর্ব থেকে শিক্ষণীয় | বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
৩. নবিজি (সা) সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিযানগুলোতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর নিকটতম আত্মীয়দের বেছে নিয়েছিলেন। যেমন: তাঁর চাচাতো ভাই উবাইদা ইবনুল হারিস, চাচা হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, মায়ের দিক থেকে আত্মীয় সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, ফুপাতো ভাই আবদুল্লাহ ইবনে জাহশ প্রমুখ। মূল কথাটি হলো, কেউই অভিযোগ করতে পারবে না যে, নবিজি (সা) তাঁর পরিবারকে নিরাপদে রাখতে চেয়েছিলেন। কারণ, অন্য ব্যক্তিকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার আগে নেতা এবং নবি হিসেবে তিনি নিজে তাঁর প্রিয়জনদের নিয়ে এগিয়ে আসতে চেয়েছেন। এ কারণেই গাজওয়াগুলোতে নবিজি (সা) সবার সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন আর সারিয়াগুলোতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিজের আত্মীয়দের পাঠাতেন।
৪. এখন পর্যন্ত কেবল মুহাজিররাই অভিযানে অংশ নিচ্ছেন, আনসাররা নন। কারণ, প্রথমত মুহাজিররা যেন মক্কার কথা ভুলে না যান। আনসারদের অংশ না নেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ আকাবার দ্বিতীয় অঙ্গীকারনামা, যা ছিল প্রোটেকশন বা সুরক্ষা দেওয়ার অঙ্গীকার, আক্রমণাত্মক কোনো কিছু করার ধারা সেখানে ছিল না। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাব, বদরের প্রধান যুদ্ধে আনসাররা স্বেচ্ছায় যোগ দেবেন।
৫. এই প্রাথমিক পর্যায়ে জেহাদ বাধ্যতামূলক ছিল না, ছিল সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক বিষয়। এমনকি সারিয়া আল-নাখলার জন্য নবিজি (সা) যে আটজন মুহাজিরকে বেছে নিয়েছিলেন, তাঁদেরকেও তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা যদি ফিরে যেতে চাও তবে ফিরে যেতে পারো।’ এটি ছিল বাধ্যতামূলক জেহাদের পথে একটি ধাপ। নবিজি (সা) এভাবে সাহাবিদেরকে তৈরি করেছেন।
৬. মধ্যযুগ থেকে শুরু হয়ে আধুনিক যুগের অমুসলিমরা ঘটনা বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে নবিজি (সা) ও প্রথম যুগের মুসলিমদের ‘হাইওয়ে রবার’ বা রাস্তার ডাকাত হিসেবে অভিযুক্ত করে থাকে। তাদের অভিযোগ এই যে, মুসলিমরা এইসব ‘ডাকাতি’ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই চলত।
নবিজি (সা) সেই সময় কুরাইশ ছাড়া অন্য কোনো গোত্রকে আক্রমণ করেননি। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কেউ যদি দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে আপনাকে নির্যাতন করে, আপনাকে হত্যার চেষ্টা করে, আপনাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে আপনার সম্পত্তি ও জমি দখল করে নেয়, তাহলে তাদের আক্রমণ করার মধ্যে দোষের কী আছে? তারা যা করেছে তার প্রতিদান এর চেয়ে কম আর কীই বা হতে পারে?
ইতিহাস থেকে আমরা জানি, এই আমেরিকান ভূখণ্ডে মানুষেরা চায়ের ওপর কর বাড়ানোর কারণে তাদের সরকারকে আক্রমণ করেছিল। এই কারণে তারা ব্রিটিশ সৈন্যদের মেরে ফেলেছিল এবং জাহাজ উল্টে ফেলে দিয়েছিল। মুসলিমদের ওপর কুরাইশরা যা কিছু করেছিল, এখন নবিজি (সা) তার একটি ক্ষুদ্র অংশই শুধু ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এখানে অনৈতিক কিছু দেখলে সেটা হবে একটি পরিষ্কার ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ (দ্বিচারিতা)। যাদের অন্তর ঘৃণায় পরিপূর্ণ, তারাই কেবল যে কোনো ঘটনার প্রেক্ষাপটকে উপেক্ষা করে ইচ্ছামতো সেটিকে বিকৃত করতে পারে।

ম্যালকম এক্স {৪} গত শতকের ষাটের দশকে বলেছিলেন, “আপনি যদি সাবধান না হন তবে সংবাদপত্রগুলো তাদেরই ঘৃণা করতে শেখাবে যারা নিপীড়িত, এবং তাদের ভালোবাসতে শেখাবে যারা নিপীড়ন করে।” অন্য কথায়, আপনি যদি মিডিয়াতে যা বলছে তা খুব বেশি বেশি করে শোনেন, তাহলে আপনি
বিশ্বাস করতে শুরু করবেন যে নিপীড়িতরাই নিপীড়নকারী আর নিপীড়নকারীরাই নিপীড়িত। একটি ছোট্ট ফিলিস্তিনি শিশু হয়তো একটি সামরিক ট্যাংকের দিকে পাথর ছুড়ল, সঙ্গে সঙ্গে প্রচার হয়ে গেল যে শিশুটিই নিপীড়নকারী আর ট্যাংকটি নিপীড়িত। এটিই আমাদের বর্তমান বিশ্বের বাস্তবতা।
আমরা কুরাইশদের মধ্যে ভন্ডামিরও প্রকাশ দেখতে পাই। তারা বলছে যে মুসলিমরা পাপ করেছে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে অভিযোগ করার কে? এটি তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে, তারা যে বড় অপরাধ করেছে তার সঙ্গে মুসলিমদের অপরাধ মোটেই তুলনা করা চলে না। এটি আমাদের সময়েও অনেকটাই সত্য। হ্যাঁ, এটি ঠিক যে আমাদের সময়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটছে।
আমরা কেউই সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করি না। কিন্তু এই সন্ত্রাস কেন হচ্ছে? সন্ত্রাসীদের এতটা আক্রোশের কারণই বা কী? কেন এই সন্ত্রাসীরা বছরের পর বছর ধরে নিপীড়িত হতে হতে এখন নিজেরাই তাদের নিপীড়নকারীদের বিরুদ্ধে ছোটখাটো সন্ত্রাসে লিপ্ত হতে বাধ্য হচ্ছে? একটি সন্ত্রাস আরেকটি সন্ত্রাসের জন্ম দেয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পাল্টা সন্ত্রাস কোনো সমাধান দিতে পারে না। শুধু একটি বিশেষ দেশ’ যা কিছু করবে তা কখনই সন্ত্রাসবাদ নয়, সেটিও ঠিক নয়। খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তারা সব সময় মুসলিমদেরকেই সন্ত্রাসী বলে অভিযুক্ত করে। অথচ তাদের প্রবর্তিত নীতিই যে সন্ত্রাসবাদের আসল উৎস তা তারা মানতে চায় না ।
কিন্তু সব অমুসলিমই এরকম ভাবে না। নোয়াম চমস্কি, ক্রিস হেজেস, রবার্ট ফিল্ক, গ্লেন গ্রিনওয়াল্ড প্রমুখদের কেউই মুসলিমদের মূল সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করেননি। তাঁদের কেউই মুসলিমদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সমর্থন করেননি, তাঁরা সমগ্র বিষয়টিকে প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে বিবেচনা করেছেন।
আমরা যারা আধুনিক পৃথিবীতে বাস করি তাদের জন্য অতীতের কুরাইশদের এবং এখনকার সময়ের রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ভণ্ডামি থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কিছু শেখার বিষয় আছে। মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে আমাদের প্রার্থনা করতে হবে, আমরা যেন কোনো উগ্রবাদী চিন্তাধারায় না পতিত হই। আমরা যে কোনো মূল্যে সত্যকে সত্য বলব, তা যদি আমাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় তবুও।
এই পর্বে আমরা যেসব ছোট ছোট অভিযান নিয়ে আলোচনা করলাম সেগুলোই বদরের প্রধান যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে। ইসলামের ইতিহাসে বদরের প্রধান যুদ্ধ অন্যতম বড় অলৌকিক ঘটনা। আল্লাহ এটিকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ (নির্ণায়কের দিন) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যেদিন সত্যকে মিথ্যা থেকে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল, এবং যেদিন মুসলিমরা এমন একটি বিজয় লাভ করেছিলেন যা ইসলামের ইতিহাসে গভীর ও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
আরও পড়ুনঃ