বদরের যুদ্ধবন্দি | বদরের যুদ্ধ-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

বদরের যুদ্ধবন্দি | বদরের যুদ্ধ-৫, যুদ্ধের পরে বদরে অবস্থানকালে কুরাইশ পক্ষের ৭৩-৭৪ জন বন্দির বিষয়টি সামনে আসে। মুসলিমরা এই প্রথমবারের মতো কাউকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে পেয়েছে। এদের নিয়ে এখন কী করবে সে বিষয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না।

সহিহ বুখারিতে উল্লেখ আছে, নবি করিম (সা) বলেছিলেন, “যদি মুতিম ইবনে আদি এখনও বেঁচে থাকতেন এবং এই নোংরা প্রকৃতির মানুষদের মুক্ত করে দিতে বলতেন, তাহলে আমি শুধু তাঁর কথায় তাদের সবাইকে মুক্তি দিতাম।” এই ৭০ জনেরও বেশি বন্দির মুক্তিপণ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাওয়া সম্ভব ছিল, যা আমাদের সময়ের হিসেবে কয়েক মিলিয়ন ডলারের মতো। তবু নবিজি (সা) মুতিম বেঁচে থাকলে তাঁর অনুরোধে সব বন্দিকে ছেড়ে দিতেন—এই কথার গভীর তাৎপর্য রয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মুত্তিম বদরের যুদ্ধের কয়েক মাস আগে মারা যান । নবিজির এভাবে মুতিমের কথা স্মরণ করার একটি বিশেষ কারণ ছিল। মুতিম বয়কটের সময় বনু হাশিমকে খাবার সরবরাহ করেছিলেন, বয়কট ভাঙতেও সাহায্য করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে নবিজিকে (সা) সুরক্ষা দিয়েছিলেন । নবিজি (সা) তাই তাঁর এই কথার মাধ্যমে মুর্তিম ইবনে আদির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এ যেন আমাদের সময়ে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে কাউকে সম্মান জানানো!

 

বদরের যুদ্ধবন্দি | বদরের যুদ্ধ-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

বদরের যুদ্ধবন্দি | বদরের যুদ্ধ-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

যা-ই হোক, যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে কী করা উচিত সে বিষয়ে ফিরে আসি। বিষয়টি ছিল কঠিন, কারণ এই লোকগুলোই মুসলিমদের হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। নবিজি (সা) আবু বকর (রা) ও উমরসহ (রা) কয়েকজন সাহাবিকে জিজ্ঞেস করলেন, এর সমাধান কী হতে পারে। আবু বকর বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, তারা যেহেতু আমাদেরই আত্মীয় এবং রক্তের সম্পর্কের লোক, তাই তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করুন।” অন্যদিকে উমর বললেন, “আমি মনে করি আপনি আলিকে দায়িত্ব দিন আকিলের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার, আমাকে দায়িত্ব দিন অন্য কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার, যাতে আমরা তাদের কাউকেই রেহাই না দেই। যেহেতু তারা আমাদের লোকদের হত্যা করার চেষ্টা করেছে, আমাদেরও তাদের সঙ্গে একই রকম আচরণই করা উচিত।”

আবু বকর ও উমরের দুটি ভিন্নধর্মী মতের প্রেক্ষিতে নবিজি (সা) মন্তব্য করেন, “আল্লাহ কিছু মানুষের মনকে দুধের চেয়েও নরম করে তৈরি করেছেন, আবার কিছু মানুষের মনকে পাথরের চেয়েও কঠোর করে তৈরি করেছেন। ও আবু বকর, তোমার সাথে ইব্রাহিম (আ) ও ইসার (আ) সাদৃশ্য আছে। ইব্রাহিম (আ) আল্লাহকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘যে আমাকে অনুসরণ করবে, সেই আমার দলভুক্ত হবে; কিন্তু কেউ আমার অবাধ্য হলে আপনি নিশ্চয়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

[১৪:৩৬] ইসা (আ) বলেছিলেন, “তুমি যদি তাদের শাস্তি দাও তবে তারা তো তোমারই বান্দা, আর যদি তাদের ক্ষমা কর তবে তুমি তো শক্তিমান, সর্বজ্ঞানী।’ [৫:১১৮] ও উমর, তুমি হলে নুহ (আ) ও মুসার (আ) মতো। নুহ (আ) বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, পৃথিবীতে কোনো কাফেরকে তুমি অব্যাহতি দিও না।’ [৭১:২৬| আর মুসা (আ) বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক,  ওদের ধনসম্পদ নষ্ট করে দাও, ওদের হৃদয়ে মোহর করে দাও; ওরা তো কঠিন শাস্তি না দেখা পর্যন্ত ইমান আনবে না।” [১০:৮৮) শেষ পর্যন্ত নবিজি আবু বকরের পরামর্শই গ্রহণ করেন।

উমর (রা) বর্ণনা করেছেন, বদরের যুদ্ধের পরে শিবিরে অবস্থানের দ্বিতীয় দিনে তিনি একটি গাছের নিচে নবি করিম (সা) ও আবু বকরকে (রা) কান্নারত অবস্থায় দেখতে পান। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘হে আল্লাহর রসুল, আপনারা কাঁদছেন কেন? আমাকে বলুন, আমি যদি কারণটি বুঝতে পারি তবে আমিও আপনাদের সঙ্গে কাদব। যদি কারণ বুঝতে না পারি, তবু শুধু আপনাদের পাশে থাকার জন্য জোর করেই কাঁদব।’ উমরের মুখে এ কথা শোনার পর নবিজি (সা) সুরা আনফালের সেই আয়াত তেলাওয়াত করেন, যেখানে আল্লাহ বলেছেন: “দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে শত্রুনিপাত না করা পর্যন্ত বন্দি রাখা কোনো নবির পক্ষে সমীচীন নয়।” [৮:৬৭]

 

বদরের যুদ্ধবন্দি | বদরের যুদ্ধ-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আল্লাহ এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন কয়েকজন সাহাবির (আবু বকর (রা) নন, অন্য কয়েকজন সাহাবি) পার্থিব লাভের আশায় মুক্তিপণ চাওয়ার কথা। একই আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ বলেছেন, “তোমরা চাও পার্থিব সম্পদ আর আল্লাহ চান পরলোকের কল্যাণ।” [৮:৬৭] ঠিক পরের আয়াতেই তিনি আরও বলেছেন, “আল্লাহর পূর্ববিধান না থাকলে (যা ঘটেছে আল্লাহ তা ঘটতে না দিলে) তোমরা যা গ্রহণ করেছ তার জন্য তোমাদের ওপর মহাশাস্তি পতিত হতো।” [৮:৬৮] এটিই ছিল নবিজির (সা) কান্নার কারণ।

যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার খলিফার ওপর অর্পণ করার বিধান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল হয়। কিন্তু বদরের পরাজিত শত্রুদের বন্দি করে রাখার সিদ্ধান্তটি সবচেয়ে সঠিক না হলেও আল্লাহ বলছেন যে, সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েই গিয়েছে তবে তা-ই থাক। এটি একটি গভীর ধর্মতাত্ত্বিক ও ফিকহ বিষয় যা নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনার করার সুযোগ আমাদের নেই। আমরা সংক্ষেপে কিছুটা আলোকপাত করব।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment