মাথা মুণ্ডন করা এবং মদিনায় ফেরার প্রস্তুতি | হুদায়বিয়ার সন্ধি ( চুক্তি )-৫, যখন চুক্তির বিষয়টি শেষ হয়ে গেল তখন নবিজি (সা) একটি সভা ডেকে সাহাবিদের বললেন, “তোমরা সবাই মাথা মুণ্ডন করো (মাথা কামিয়ে নাও)। আমরা (মদিনায়) ফিরে যাব।” সাহাবিদের জন্য এ যেন উত্তেজনার চূড়ান্ত অবস্থা থেকে হঠাৎ করেই সবকিছু স্তিমিত হয়ে যাওয়া। কিছু সময় আগেই নবিজি (সা) তাঁদের বলেছিলেন, কাবায় তাওয়াফ করার বিষয়টি সুহায়েল সহজ করে দেবে। কিন্তু এখন তাঁদের তল্পিতল্পা গুটাতে বলা হচ্ছে। এ এক বিশাল ছন্দপতন। পুরো ব্যাপারটিতে সাহাবিরা এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, সমগ্র সিরাহে এই প্রথমবারের জন্য তাঁরা নবিজির (সা) নির্দেশ বাস্তবায়ন করার মতো মানসিক অবস্থায় ছিলেন না ।
মাথা মুণ্ডন করা এবং মদিনায় ফেরার প্রস্তুতি | হুদায়বিয়ার সন্ধি ( চুক্তি )-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা হজ ও ওমরা সংক্রান্ত শরিয়ার বিধান নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করব। আপনি নানা কারণে (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক) কাবাঘরে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারেন। আপনি যেখানেই বাধা পাবেন, সেখানেই মাথা মুণ্ডন করবেন, প্রাণী কুরবানি করবেন, ইহরাম অবস্থা থেকে তখনই বের হয়ে যাবেন, এবং পরবর্তী কোনো এক সময়ে হজ বা ওমরাটি আদায় করবেন। এটি এখন আমাদের শরিয়ার অংশ। তবে সাহাবিদের জন্য এ ছিল এক নতুন বিধান যা তাঁদের কাছে যথেষ্ট ‘উদ্ভট’ বলে মনে হচ্ছে। দেখা গেল, সভায় সবাই চুপ করে আছে, এমনকি কেউ নড়াচড়াও করছে না ।
যা-ই হোক, নবিজি (সা) একই কথা দ্বিতীয়বার বললেন, তবু কেউ নড়লেন না। তিনি তৃতীয়বার পুনরাবৃত্তি করলেন, এবারও কেউ নড়লেন না। স্বাভাবিকভাবেই সবার মনে টান টান উত্তেজনা। আরেকটি বিষয় হলো, যখন কোনো নির্দেশ নির্দিষ্ট কোনো একজন ব্যক্তিকে না দিয়ে সামষ্টিকভাবে দেওয়া হয়, তখন সবার জন্যই সেই নির্দেশ তৎক্ষণাৎ না মেনে চুপচাপ থেকে অপেক্ষা করার সুযোগ তৈরি হয়।

নবিজি (সা) বিফল মনোরথে নিজের তাঁবুতে ফিরে এলেন। সেই সময় উম্মে সালামা তাঁবুতে ছিলেন। নবিজি (সা) তাঁর কাছে পরামর্শ চাওয়ার মতো করে বললেন, “আমি তাদের মাথা কামানোর নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের একজনও আমার কথায় সাড়া দেয়নি।”
উম্মে সালামা: হে আল্লাহর রসুল, আপনি কি চান যে তারা আপনার কথা অনুসারে কাজ করুক?
নবিজি (সা): হ্যাঁ।
উম্মে সালামা: তাহলে আপনি বরং নিজে আগে এই কাজ করুন। যখন তারা আপনাকে এটা করতে দেখবে, তখন আপনাকে অনুসরণ করবে।
নবিজি (সা) এই পরামর্শ গ্রহণ করলেন। তিনি বাইরে গিয়ে নাপিতকে ডাকলেন এবং সবার সামনেই নিজের চুল কামানো শুরু করলেন। নবিজিকে (সা) মাথা মুণ্ডন করতে দেখে হঠাৎ সাহাবিদের বোধোদয় হলো। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে নিজ নিজ মাথা কামিয়ে দেওয়ার জন্য একে অপরকে ডাকতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, তাঁরা মাথা কামানোর প্রতিযোগিতায় নেমে গেছেন । সুবহানআল্লাহ! যেসব সাহাবি মাথা মুণ্ডন করেছিলেন, নবিজি (সা) তাঁদের জন্য দোয়া করেন: “হে আল্লাহ, যারা মাথা মুণ্ডন করেছে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন।”
যেসব সাহাবি শুধু চুল ছেঁটে নিয়েছিলেন তাঁরা দোয়ায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ারmঅভিপ্রায়ে নবিজিকে (সা) জিজ্ঞেস করলেন: আর যারা চুল ছেঁটেছে? নবিজি (সা) (দ্বিতীয়বার): যারা মাথা মুণ্ডন করেছে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন।
সাহাবিরা (আবার): আর যারা চুল ছেঁটেছে?
নবিজি (সা) (তৃতীয়বার): যারা মাথা মুণ্ডন করেছে তাদের প্রতি অনুগ্রহকরুন।
সাহাবিরা (আবার): আর যারা চুল ছেঁটেছে?
নবিজি (সা) (চতুর্থবার): যারা মাথা মুণ্ডন করেছে তাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন এবং যারা যারা চুল ছেঁটেছে তাদের প্রতিও।
এই ঘটনা থেকে আলেমগণ যে ফিকহ বিধান বের করেছেন তা হলো: হজ কিংবা ওমরার জন্য মাথা মুণ্ডন করার সওয়াব চুল ছাঁটার চেয়ে অনেক বেশি।
মাথা মুণ্ডন করার পর প্রাণী কোরবানি দেওয়া হলো। কোরবানির মাংস পুরোটাই মক্কায় পাঠানো হলো সেখানকার গরিব-দুস্থদের জন্য। জানা যায়, নবিজি (সা) প্রথম যে উটটি মক্কায় পাঠিয়েছিলেন সেটি ছিল আবু জেহেলের। বদরের যুদ্ধের পর সেটি মুসলিমদের করায়ত্ত হয়। উটটি মক্কার লোকদের কাছে সুপরিচিত ছিল । তারা সহজেই চিনতে পেরেছিল যে সেটি ছিল আবু জেহেলের। কুরাইশদের জন্য ব্যাপারটি ছিল বেদনাদায়ক । মুসলিমরা প্রাণী কোরবানি দেওয়ার পর মদিনায় অভিমুখে রওনা হন ।
আরও পড়ুনঃ