মদিনায় হিজরত প্রস্তুতি | মদিনায় হিজরত, নবিজির (সা) হিজরতের ঘটনাটি বুঝতে হলে এর আগের কিছু ঘটনা একত্র করতে হবে। যেমনটি আমরা আগে বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছি, সিরাহের কাহিনিগুলো সময়ের ক্রমানুসারে লিখিত হয়নি। একই কারণে হিজরতের বিভিন্ন ঘটনার সঠিক ক্রম আমরা জানি না। হিজরতের বর্ণনার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য উৎস নবিপত্নী আয়েশা (রা); তাঁর বর্ণনা সহিহ বুখারিতে লিপিবদ্ধ আছে। তিনি আনুমানিক ৬-৭ বছর বয়সের বালিকা হিসেবে সেই সময়ের স্মৃতি থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমার বাবা-মাকে মুসলিম ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের মধ্যে দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না।” অর্থাৎ তাঁর জন্মের আগেই তাঁর বাবা আবু বকর (রা) ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

মদিনায় হিজরত প্রস্তুতি | মদিনায় হিজরত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
[প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, আয়েশা ও আসমা ছিলেন পরস্পরের বোন, কিন্তু তাঁরা সহোদরা ছিলেন না। তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। বড় বোন আসমার মা ইসলাম গ্রহণ করেননি, সেজন্য আবু বকর (রা) তাঁকে তালাক নিয়ে আয়েশার মাকে বিয়ে করেন। তখন আসমা ছিলেন প্রাপ্তবয়স্কা; আয়েশার থেকে কমপক্ষে ১০-১৫ বছরের বড়।] আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন: “আমার এমন কোনো দিনের কথা মনে পড়ে না যেদিন নবিজি (সা) আমাদের বাড়িতে আসেননি।”
নবিজি (সা) যে প্রতিদিন তাঁদের বাড়িতে কখনও সকালে, কখনও সন্ধ্যায় আসতেন, তা তাঁর প্রথম জীবনের স্মৃতিতে জাগরুক হয়ে আছে। তিনি বর্ণনা করেছেন, “নবিজিকে (সা) হিজরতের অনুমতি দেওয়ার পর তিনি প্রথমে অন্য মুসলিমদের হিজরত করতে নির্দেশ দিলেন। ওই নির্দেশের পর আবু বকর (রা) যাত্রার জন্য একটি উট প্রস্তুত করলেন এবং নবিজির (সা) কাছ থেকে হিজরত করার অনুমতি চাইলেন।”
নবিজি (সা) আৰু বকরকে (রা) বললেন, “অপেক্ষা করুন। আশা করি আল্লাহ আমাদেরকে অনুমতি দান করবেন।” এই কথা থেকে আবু বকর (রা) অনুমান করতে পারছিলেন, নবিজির (সা) হয়তো হিজরতের সময় তাঁকে (আৰু বকর) সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য আল্লাহর অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছেন। তাই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আমার সাহচর্যের প্রত্যাশা করছেন? (অর্থাৎ আমি কি আপনার সঙ্গে যেতে পারি)? নবিজি (সা) উত্তরে জানালেন, “হ্যাঁ, আমি তা-ই আশা করছি।”
এই কথোপকথন থেকে বোঝা বোঝা যায়, নবিজি (সা) আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কখনোই কিছু করেননি। নবিজির (সা) মুখ থেকে এই কথা শোনার পর আবু বকর (রা) একটির পরিবর্তে দুটি উট প্রস্তুত করলেন। এখানে উট প্রস্তুত করা বলতে আমরা কী বুঝব? আমরা শুনে এসেছি, ‘উট মরুভূমির জাহাজ।’ চলাচলের সময় উট পিঠে খাবার ও পানি বহন করতে পারে। তবে তা করার জন্য উটকে একটি বিশেষ “ডায়েটিং’ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিতে হয়; যেমন অধিক পরিমাণে লবণ মিশ্রিত পানি পান করানো, নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ করে রাখা যাতে তার শরীরের মেদ অক্ষত থাকে, ইত্যাদি।
এই প্রস্তুতির কাজ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে। আবু বকরের (রা) ভাষা অনুযায়ী, তিনি চার মাস ধরে উট দুটিকে প্রস্তুত করছিলেন। [নবিজি (সা) অন্য মুসলিমদের হিজরত করার ঘোষণা দেওয়ার সাড়ে তিন মাস পরে নিজে হিজরত করেন। এখানে আবু বকর (রা) সম্ভবত সাড়ে তিন মাসকে ‘রাউন্ড আপ’ করে চার মাস বলেছেন। নবিজির (সা) হিজরতের দিনটি ছিল দাওয়াতের ১৩তম বছরের ২৬ সফর, সোমবার। সহিহ মুসলিমে উল্লিখিত ইবনে আব্বাসের বর্ণনার ভিত্তিতে আমরা এই তারিখটি ধরে নিতে পারি।

আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন, “একদিন দিনের বেলায় খুব গরম পড়েছে (এমন গরমে কারও পক্ষে রাস্তায় বের হওয়া দুষ্কর)। সেই সময় এক ব্যক্তিকে আমাদের বাড়ির দিকে আসতে দেখলাম। ব্যক্তিটির মাথা ও মুখমণ্ডল পাগড়ি দিয়ে প্যাচানো ছিল, ফলে আমরা তাঁকে প্রথমে চিনতে পারিনি। কাছে আসার পর আমরা চিনতে পারলাম, ইনি নবি করিম (সা)। তাঁকে দেখে আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলাম, ‘তাঁর আসার একমাত্র কারণ হতে পারে, খুব মারাত্মক (জরুরি) কিছু একটা ঘটেছে।
নবিজি (সা) আবু বকরের (রা) অনুমতি নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে তাঁকে বললেন, ‘সবাইকে ঘর থেকে সরিয়ে দাও।’ আবু বকর (রা) বললেন, ‘এরা তো আপনার পরিবার (আয়েশা ও তাঁর বোন)। [প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আয়েশা (রা) ইতিমধ্যে নবিজির (সা) সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন, কারণ তাঁদের বিয়ে (নিকাহ) হয়ে গিয়েছিল, যদিও তখন পর্যন্ত তাঁরা একত্রে থাকা শুরু করেননি।]
আয়েশা (রা) আরও বলেন: “নবিজি (সা) বললেন, ‘আল্লাহ আমাকে হিজরতের অনুমতি দিয়েছেন।’ আবু বকর (রা) জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! আল্লাহ কি আমাকে আপনার সহযাত্রী হতে অনুমতি দিয়েছেন? আপনার দোহাই লাগে, আমার মা-বাবার কসম, তিনি কি অনুমতি দিয়েছেন? নবিজি (সা) জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ। আপনাকে আমার সঙ্গে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এর পরের অংশটি ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় পাওয়া যায়। আয়েশা (রা) বলেন, “আমি আবু বকরকে (রা) কাঁদতে দেখলাম।
কোনো মানুষ যে সুখেও কাঁদতে পারে তা আমি সেদিনের আগ পর্যন্ত কখনোই বিশ্বাস করতাম না। আবু বকর (রা) বললেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! আমি দুটি উট প্রস্তুত করে রেখেছি। তার মধ্যে একটি আপনার জন্য। লক্ষ করুন, নবিজির (সা) তখন পর্যন্ত একটি উটও ছিল না। নবিজি (সা) বললেন, ‘আমি উটটি নের যদি আমি আপনাকে এর দাম পরিশোধ করি।” অর্থাৎ তিনি উটটি বিনামূল্যে নিতে চাচ্ছেন না। আল্লাহর রসুল হওয়া সত্ত্বেও তিনি মানুষের কাছ থেকে বিনামূল্যে সুবিধা নিচ্ছেন না। ফলে আবু বকর (রা) অনেকটা বাধ্য হয়েই উটটির জন্য নবিজির (সা) কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেন।
আসমা তাঁদের দুজনের জন্য জন্য খাবার তৈরি করে রেখেছিলেন। যাবার থলিতে ভরার পর তিনি দেখলেন, থলির মুখ বাঁধার জন্য হাতের কাছে কিছু নেই। তখন তিনি নিজের পোশাকের ফিতা খুলে দাঁত দিয়ে অর্ধেক করে ছিঁড়লেন। ফিতার অর্ধেকটা নিজের পোশাকের জন্য রেখে বাকি অর্ধেক দিয়ে খাবারের থালির মুখ বেঁধে দিলেন। এ কারণে তাকে ‘দুই ফিতার নারী’ বলেও ডাকা হতো।
সেই সময় আবু বকরের (রা) কাছে পাঁচ হাজার দিরহাম অর্থ জমা ছিল। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, আবু বকর যখন ইসলাম গ্রহণ করেন (অর্থাৎ দাওয়াতের প্রথম বছরে) তখন তিনি ছিলেন মক্কার একজন অন্যতম ধনী ব্যক্তি; তাঁর কাছে ছিল ৪০ হাজার দিরহাম। তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদের প্রায় ১০ শতাংশ ব্যয় করেছিলেন ইসলামের বিভিন্ন কাজে। যেমন, মুসলিম দাসদের মুক্ত করা, নবিজিকে (সা) সহায়তা করা ইত্যাদি।
হিজরতের জন্য যাত্রার সময় আবু বকর অবশিষ্ট পুরো অর্থই (পাঁচ হাজার দিরহাম) নিজের সঙ্গে নিলেন। তিনি যখন তা করছিলেন, তখন তাঁর বাবা আৰু কাহাফা আসমার কাছে এসে নিজের ছেলে সম্পর্কে বিদ্রুপ করে বলেন, ‘এ কেমন বাবা যে দুটি ছোট মেয়েকে কোনো টাকাপয়সা ছাড়াই একলা অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যাচ্ছে?’ উল্লেখ্য, সেই সময় বৃদ্ধ আৰু কাহাফা মুসলিম ছিলেন না। তিনি তিক ও তীক্ষ্ণ ভাষায় কথা বলতেন।
তাঁর কথা শুনে আসমা তাড়াতাড়ি একটি কাপড়ের খলি নুড়ি দিয়ে ভর্তি করে আবু কাহাফার কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, “না, দাদা! তিনি আমাদের জন্য কিছু টাকা রেখে গেছেন।” আসমা নুড়িপূর্ণ থলিটি বৃদ্ধ আৰু কাহাফার হাতে দিলেন, তিনি ছিলেন অন্ধ। থলিটির ভেতরে মুদ্রার মতো ভারী কিছু আছে এটা অনুভব করে তিনি বললেন, “ওহ, ঠিক আছে। আমি ভুল করছিলাম। তোমাদের জন্য এই পরিমাণ অর্থ রেখে গিয়ে থাকলে অসুবিধার কিছু নেই।”
আসমা পরবর্তীকালে বর্ণনা করেছেন, “আবু বকর (রা) আমাদের জন্য এক কানাকড়িও রেখে যাননি।” তবে আবু বকরের (রা) আশা ছিল, কেউ না কেউ আসমা ও আয়েশাকে খাবার ও পানি সরবরাহ করবে। তিনি জানতেন, মক্কায় তাঁরা অনাহারে মারা যাবেন না। তা ছাড়া মক্কা তো একটি শহর, আর তাঁরা যাচ্ছেন মরুভূমির মাঝখান দিয়ে অনিশ্চিত পথে। তাঁদের কোথায় অর্থের প্রয়োজন হতে পারে তা তো আগে থেকে জানা সম্ভব ছিল না। অবশ্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আসমা ও আয়েশাকে দেখভাল করেছেন। কিছুদিন পরে তাঁরা ভালোভাবেই মদিনায় পৌঁছেন।