মুনাফেকদের দচ্যুত হওয়া | ওহুদের যুদ্ধ-১, মদিনা থেকে ওহুদ যাওয়ার পথেই আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল ও তার সহযোগীরা ধীরে ধীরে পিছু হটতে শুরু করে। তারা প্রথমে মুসলিম বাহিনীর পেছনের দিকে যেতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে সেই বাহিনী থেকে আক্ষরিকভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাদের পেছনের দিকে যেতে সাহাবি জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” জবাবে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বলে, “সে (মুহাম্মদ) কিছু যুবকের কথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমার পরামর্শ গ্রহণ করেনি।
সে যখন আমাদের কথা শোনেনি তখন আমরা কেন আমাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলব?” এই ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রথম তার চরিত্রের আসল রূপ জনসমক্ষে উন্মোচিত হয়। ওহুদের যুদ্ধের একটি প্রধান সুফল হলো, আল্লাহ এর মধ্য দিয়ে মুনাকেফদের স্বরূপ পুরোপুরি উন্মোচিত করে দিয়েছেন। তারা কত খারাপ হতে পারে তা এর আগ পর্যন্ত মুসলিমদের জানা ছিল না। মুসলিমরা যেন আর মুনাকেকদের চক্রান্তে না পড়েন সেজন্য তাঁদের কাছে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন ।

মুনাফেকদের দচ্যুত হওয়া | ওহুদের যুদ্ধ-১ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেছেন:
“অসৎকে সৎ থেকে পৃথক না করা পর্যন্ত তোমরা যে অবস্থায় রয়েছ আল্লাহ সে অবস্থায় বিশ্বাসীদের ছেড়ে দিতে পারেন না।” [সুরা আলে ইমরান, ৩:১৭৯] সাহাবিদের মধ্যে প্রথমে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে হারাম মুনাফেকদের চলে যেতে দেখেন। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ঘোড়ার কাছে গিয়ে বলেন, “আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আল্লাহকে ভয় করুন। আজ যখন শত্রু আক্রমণ করতে আমাদের দ্বারপ্রান্তে, এই বিপদের সময়ে আপনি নবিজি (সা) এবং নিজ দলের লোকদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন না।
আপনি কি এই প্রতিশ্রুতি দেননি যে, আপনি নিজের পরিবারকে যেভাবে রক্ষা করেন ঠিক সেভাবেই নবিজিকে (সা) সবসময় রক্ষা করবেন?” তিনি মদিনার সংবিধানের ধারার কথা উল্লেখ করে আল্লাহকে ভয় করা এবং নৈতিক মূল্যবোধের কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। জবাবে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বলে, “যদি আমরা জানতাম যে তারা (কুরাইশরা) যুদ্ধ করবে, তাহলে আমরাও তোমাদের সঙ্গে যেতাম (অর্থাৎ আমরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে চলে যেতাম না)।
কিন্তু আমাদের মনে হয় না তারা আদৌ আক্রমণ করবে।” আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে এ বিষয় স্পষ্ট করে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং তাকে মিথ্যাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন: “যেদিন দুদল পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিল সেদিন তোমাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল, তা আল্লাহর অনুমতিক্রমেই ঘটেছিল, যাতে তিনি মুমিনদের জানতে পারেন ও মুনাফেকদেরও জানতে পারেন।

আর তাদের বলা হয়েছিল, ‘এসো, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করো বা রুখে দাঁড়াও। তারা বলেছিল, ‘যদি আমরা যুদ্ধ হবে জানতাম তবে তো নিশ্চয়ই তোমাদের অনুসরণ করতাম।’ সেদিন তারা ইমানের চেয়ে কুফরির বেশি কাছাকাছি ছিল। তারা মুখে যা বলে তা তাদের অন্তরে নেই। আর তারা যা গোপন করে সে সম্পর্কে আল্লাহ অধিক অবগত।” [সুরা আল ইমরান, ৩:১৬৬-১৬৭] মুসলিমরা যখন নিজেদের দলের প্রায় ৩০০ জনের একটি বড় অংশকে চলে যেতে দেখেন, তখন দুটি ব্যাপার ঘটে:
১. চলে যাওয়া এই ৩০০ জনের ব্যাপারে কী করা উচিত তা নিয়ে মুসলিমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে। একদল বলে, “আমাদের মদিনায় ফিরে গিয়ে ওই লোকদের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য শায়েস্তা করে তারপর আবার ওহুদে ফিরে আসা উচিত।” অন্যদল বলে, “আমরা প্রথমে কুরাইশদের বিরুদ্ধে লড়াই করব, তারপর ফিরে গিয়ে তাদের বিষয়ে যা করার তা করব।”
মুসলিমদের মধ্যেকার এই মতপার্থক্যের বিষয়টিকে আল্লাহ কিছুটা তিরস্কার করে বলেছেন: “কীভাবে মুনাফেকদের ব্যাপারে তোমরা দুদলে বিভক্ত হয়ে গেলে, যখন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের ঘুরিয়ে দিয়েছেন?” [সুরা নিসা, ৪:৮৮] অর্থাৎ ‘মুনাফেকদের ব্যাপার নিয়ে তোমাদের নিজেদের একতা বিসর্জন দিয়ো না।’ যদিও এখানে কোনো ঝগড়াবিবাদের ব্যাপার ছিল না, ছিল যুক্তিতর্ক সহকারে আলোচনা, তবু আল্লাহ সাহাবিদের তা থামাতে বলেছিলেন।
২. আবদুল্লাহ ইবনে উবাইসহ অনেককে চলে যেতে দেখে আনসারদের কিছু লোক দ্বিধায় পড়ে যান। আউসের বনু হারিসা গোত্র এবং খাজরাজের বনু সালামা গোত্র তো প্রায় চলেই যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যেকার শক্ত ইমানের মুসলিমদের চেষ্টায় এই দুই গোত্র নবিজির (সা) সঙ্গে থেকে যায়। আল্লাহ তাদের কথাও পবিত্র কোরানে উল্লেখ করেছেন “যখন তোমাদের মধ্যে দুই দলের সাহস হারাবার উপক্রম হয়েছিল তখন আল্লাহই ছিলেন উভয়ের সহায়ক। আর মুমিনদের উচিত আল্লাহর ওপর নির্ভর করা।” [সুরা আল ইমরান, ৩:১২২] উপরের আয়াতে আল্লাহ বলছেন, বনু হারিসা ও বনু সালামা পথভ্রষ্ট হতে চলেছিল, কিন্তু আল্লাহ তাদের সহায়ক ছিলেন। অন্য অর্থে, আল্লাহ তাদের রক্ষা করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই দুটি দল পরবর্তী সময়ে এই বিষয়টি নিয়ে গর্ব করত: কারণ আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ তাদের সহায়ক ছিলেন।’
৭০০ জন মুসলিম
অবশেষে ৭০০ জন মুসলিম ওহুদে পৌঁছে শিবির স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, সেই সময়ে পুরো বিশ্বে মুসলিম পুরুষের সংখ্যা কোনোক্রমেই এক হাজারের বেশি ছিল না। মুসলিম বাহিনী পাহাড় পেছন রেখে মদিনা শহরের দিকে মুখ করে অবস্থান নেয়। মুসলিমদের নাগাল পাওয়ার জন্য কুরাইশ বাহিনীকে পুরো মদিনা শহরকে ঘুরে আসতে হয়।
শহরের দক্ষিণে যাওয়ার পরিবর্তে উত্তর দিকে ওহুদে যাওয়া ছিল নবি করিমের (সা) কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। বলা হয়, এভাবে কুরাইশদের আরো বেশি ক্লান্ত করে ফেলা হয়েছিল, কারণ তাদের আরও আধাদিনের অতিরিক্ত পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল। ওহুদের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের কাছে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া ও অন্যান্য যুদ্ধসরঞ্জাম ছিল না। কিন্তু তাঁদের ছিল একনিষ্ঠ তাওয়াক্কুল এবং মজবুত ইমান।
আরও পড়ুনঃ