মুসলিমদের পক্ষে চুক্তিটি কাজ করেছিল | হুদায়বিয়ার সন্ধি ( চুক্তি )-৫, সাহাবিরা মদিনায় ফিরে এলেন। আল-ওয়াকিদি ও ইবনে সাদের মতে তাঁরা হুদায়বিয়াতে প্রায় ২০ দিন অবস্থান করেছিলেন। সে হিসেবে পুরো সফরটির স্থায়িত্বকাল ছিল আনুমানিক দেড় মাস। তাঁরা ফিরে আসার পর এমন একটি ঘটনা ঘটে যা থেকে হুদায়বিয়ার চুক্তির সরাসরি প্রয়োগ দেখা যায়। ঘটনাটি আবু বাসির নামের একজন মুসলিমকে কেন্দ্র করে ।
মুসলিমদের পক্ষে চুক্তিটি কাজ করেছিল | হুদায়বিয়ার সন্ধি ( চুক্তি )-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

আবু বাসির মক্কায় বসবাস করতেন। তাঁর গোত্র খুজা মক্কার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। হুদায়বিয়ার ঘটনার পর তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মদিনায় হিজরত করেন। চুক্তির শর্ত অনুসারে, তাঁকে মক্কাবাসীর কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আবু বাসির আসার পর নবি করিম (সা) তাঁকে প্রথমে কিছু বললেন না। দু-তিন দিনের মধ্যেই খুজা গোত্র দূত পাঠিয়ে চুক্তি অনুসারে আবু বাসিরকে ফেরত চাইল। এবার নবিজি (সা) আবু বাসিরকে ডেকে বললেন, “এই দুজন লোক তোমাকে নিতে এসেছে।
আমরা যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছি তা জেনেই তুমি এখানে এসেছ। আমি তো বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। তাই তুমি তোমার লোকদের কাছে ফিরে যাও।”
চুক্তির বিষয়টি আবু বাসিরের অজানা ছিল না। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন নবিজি (সা) হয়তো এর প্রয়োগ করবেন না। তাই তিনি একটু ঝুঁকি নিয়ে (সুযোগ নিতে চেয়ে) মক্কা ছেড়ে মদিনায় আসেন। কিন্তু তিনি আসার সঙ্গে সঙ্গেই নবিজি (সা) তাঁকে ফিরে যেতে বলেননি। কারণ, তিনি চুক্তির কথাগুলো আক্ষরিকভাবে অনুসরণ করছিলেন, চুক্তির মর্ম নয়। চুক্তিতে তো বলা হয়নি, কেউ মদিনায় গেলেই তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। চুক্তি প্রয়োগ করা তো নবিজির (সা) দায়িত্ব নয়, মদিনায় কে এল, কে মদিনা ছেড়ে চলে গেল এসব দেখার জন্য তিনি তো টহল করে বেড়াবেন না। মক্কার লোকেরা যখন চুক্তির শর্ত প্রয়োগের জন্য এল, কেবল তখনই তিনি বললেন, ঠিক আছে। তোমরা তাকে নিয়ে যেতে পার। যদি তারা না আসত, তাহলে তা প্রয়োগ করার দায়িত্ব তিনি নিতেন না ।
আবু বাসিরকে যখন মক্কার লোকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন তিনি নবিজিকে (সা) একই কথা বলেন যা আবু জান্দাল বলেছিলেন: “আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে আনার পর আপনি কি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন?” তাঁকেও একই জবাব দেওয়া হয়েছিল: “আল্লাহ তোমার জন্য একটি পথ করে দেবেন।”
জানা যায়, আবু বাসির ওই দুই ব্যক্তির সঙ্গে মক্কা ফিরে যাওয়ার পথে গল্পগুজব শুরু করেন। একপর্যায়ে তাদের সম্পর্ক সহজ হয়ে এলে তারা পরস্পরের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ শুরু করে। কথা প্রসঙ্গে আবু বাসির তাদের একজনের তরবারির প্রশংসা করে বলেন, “এত সুন্দর তরবারি আমি কখনো দেখিনি। আমাকে বলো, তুমি এটা দিয়ে কী করেছ?” লোকটি বলে, আমি অমুক অমুক যুদ্ধে গিয়েছি, তমুক তমুককে হত্যা করেছি ইত্যাদি ।

আবু বাসির তাকে বলে, “আমাকে এই কিংবদন্তির তলোয়ারটি দেখতে দেবে?” লোকটি সরল মনে তলোয়ারটি দেখতে দিলে আবু বাসির তৎক্ষণাৎ তা দিয়ে তার মাথা কেটে ফেলেন। তারপর তিনি অন্য ব্যক্তির দিকে ফিরলে সে খালি পায়ে দৌড়ে মদিনায় ফিরে যায়। আবু বাসিরকে হস্তান্তর করার পর দুই ঘণ্টা সময়ও পার হয়নি। এর মধ্যেই ওই দ্বিতীয় ব্যক্তি মসজিদে এসে চিৎকার করে বলতে থাকে, “আমার সঙ্গীকে হত্যা করা হয়েছে । এখন আমাকেও হত্যা করবে। আমাকে রক্ষা করুন।”
কিছুক্ষণের মধ্যে আবু বাসির এসে বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, (আমাকে হস্তান্তর করে) আপনি আপনার দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু আল্লাহ আমাকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছেন!” নবিজি (সা) অন্যদিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, “অন্য কেউ আসার আগেই তুমি আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাও। তুমি এখানে থাকতে পারবে না, কারণ চুক্তিতে তা স্পষ্টভাবে বলা আছে।” অর্থাৎ আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারব না ।
আবু বাসির নবিজির (সা) কথার অর্থ বুঝতে পেরে অতি সত্ত্বর মদিনা থেকে পালিয়ে যান। তারপর তিনি বেশ দূরে এক স্থানে, যা এখনকার জেদ্দার কাছাকাছি, গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। সেখান থেকে তিনি মক্কার মুসলিমদের কাছে খবর পাঠান, “আমি অমুক জায়গায় আছি।” আবু জান্দালের কাছে এই খবর পৌঁছলে তিনি আবার মক্কা থেকে পালিয়ে আবু বাসিরের কাছে চলে যান। ওদিকে মক্কার মুসলিমদের কাছে এই বার্তা ছড়িয়ে পড়ে: “তোমরা যেহেতু মদিনায় যেতে পারছ না, তাই আমাদের কাছে এসো।”
তারপর একে একে অনেকেই তাঁদের (আবু বাসির ও আবু জান্দাল) সঙ্গে যোগ দিতে থাকেন। এক সময় তাঁদের সংখ্যা ৮০-তে পৌঁছায় এবং সেখানে একটি পরিপূর্ণ বসতি গড়ে ওঠে।
তারপর যা ঘটতে থাকে তার জন্য মক্কার কুরাইশরা মোটেই প্রস্তুত ছিল না । জীবিকা নির্বাহের তাগিদে এই ৮০ জনের দল কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণ করা শুরু করল। বাণিজ্য কাফেলা আক্রমণের ব্যাপারটি তাঁদের দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে ন্যায়সংগত। কারণ, কুরাইশরা তাঁদের মক্কায় শান্তিতে থাকতে দেয়নি, আবার মদিনায় যেতেও বাধা দিয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই এখন তারা (কুরাইশরা) পাল্টা আক্রমণের স্বীকার হচ্ছে। আবার যেহেতু চুক্তির ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে ১০ বছরের জন্য শান্তি বলবত থাকবে, তাই এই দলটির সঙ্গে নবিজির (সা) কোনো চুক্তি করার সুযোগ নেই। আর যেহেতু তারা (আবু বাসির ও আবু জান্দাল) আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিমদের সঙ্গে জোটবদ্ধ নয়, তাই ৬ নং ধারা অনুযায়ী চুক্তিটি তাদের জন্য প্রযোজ্য নয় ।
আবু বাসির ও আবু জান্দালের দল সিরিয়াগামী মক্কার প্রতিটি কাফেলা আক্রমণ করতে থাকল। মরুভূমিতে বসবাসকারী যোদ্ধা পুরুষদের বিরুদ্ধে ৭০- ৯০ উটের একটি কাফেলাকে রক্ষা করা ছিল মক্কার কুরাইশদের জন্য প্রায় অসম্ভব, কারণ মরুভূমিতে কোথা থেকে আক্রমণ আসবে তা বোঝা সম্ভব না। তাই হুদায়বিয়ার চুক্তির মাত্র দেড় বছরের মধ্যে কুরাইশরা নবিজির (সা) কাছে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে ওই ৮০ জনকে মদিনায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। তারা আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে নবিজির (সা) কাছে মিনতি করে বলে, “আপনি যদি সত্যিই আমাদের রক্তের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের প্রতি একটু দয়া করুন। এই লোকদের মদিনায় নিয়ে গিয়ে আপনার কাছে রাখুন।”
নবিজি (সা) আৰু বাসিরের কাছে একজন বার্তাবাহক পাঠিয়ে সবাইকে নিয়ে মদিনায় চলে আসতে বললেন। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা সবাই মদিনায় এসে মুসলিমদের সঙ্গে জীবনযাপন করতে শুরু করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আবু বাসির অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মদিনায় পৌঁছার আগেই মারা যান ।
আরও পড়ুনঃ