যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল | ওহুদের যুদ্ধ-৩, ওহুদের যুদ্ধের প্রথম অংশে মুসলিমরা জয়ী হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানের সুরা আল ইমরানে (৩:১৫২) এ সম্পর্কে বলেন, যখন মুসলিমরা তাঁর প্রতি আন্তরিক ও মনের দিক থেকে খাঁটি ছিল, তিনি তখন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাঁদের দিয়েছেন। কিন্তু যখন তাঁরা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং লোভী হয়ে উঠেছে, তখন তাঁদের ওপর বিপর্যয় নেমে এসেছে।
যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল | ওহুদের যুদ্ধ-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

মুশরিকরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানো শুরু করলে মুসলিম যোদ্ধারা ভাবেন যে তাঁরা যুদ্ধে জিতে গেছেন। তাঁদের মধ্যে আত্মতুষ্টি পেয়ে বসে। একপর্যায়ে তাঁরা নিজেদের অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যাওয়া শত্রুদের সম্পদ সংগ্রহে নেমে পড়েন। সেই সময় আরবদের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছিল ভালো মানের অস্ত্র ও বর্ম। কারণ তারা সে সময় অস্ত্র তৈরিতে পারদর্শী ছিল না। তাদের বাইরে থেকে অস্ত্র আমদানি করতে হতো, তাই দাম পড়ত অনেক বেশি। অস্ত্র ছাড়াও উট, তাঁবু ইত্যাদি তাদের কাছে ছিল অত্যন্ত মূল্যবান।
তাই কুরাইশরা পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সৈন্যরা গনিমত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) একবার সংগ্রহ করে তাঁবুতে রেখে আবারও সংগ্রহ করতে ময়দানে ফিরে যান। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, যাঁরা যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, তাঁরা সম্পদের কোনো কিছুই পাননি। বরং এ কাজ করতে গিয়ে তাঁরা মহাবিপর্যয় ডেকে আনেন।
নবি করিম (সা) বুঝতে পেরেছিলেন যে যুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। মুসলিম পক্ষের পদাতিকরা কুরাইশদের ফেলে যাওয়া সম্পদ সংগ্রহে ব্যস্ত। ওদিকে তিরন্দাজরা দেখলেন কুরাইশরা পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তত ২০ মিনিট পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তাঁদের কাছে কোনো সংবাদ আসছে না। এ অবস্থায় তাঁরা অবহেলিত বোধ করলেন এবং নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্ক শুরু করলেন। একদল বললেন, “চলো যাই, এখন আমাদের সম্পদ সংগ্রহ করার পালা।”
অন্যদল বললেন, “না, না। আমাদের এখন এখান থেকে যাওয়া ঠিক হবে না।” আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা) বললেন, “নবিজি (সা) যা বলেছিলেন, তোমরা কি তা ভুলে গেছ? তিনি বলেছেন, ‘আমি তোমাদের কিছু না বলা পর্যন্ত তোমরা তোমাদের জায়গাতেই থাকবে।’ আল্লাহর কসম, নবিজির (সা) হুকুম আমার কাছে না আসা পর্যন্ত আমি এ জায়গা থেকে সরব না।”

আল্লাহ এই বিষয়টিই পবিত্র কোরানে উল্লেখ করেছেন: “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের যে (সাহায্য দেওয়ার) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,
তা তিনি পালন করেছেন। (যুদ্ধের প্রথম দিকে) তোমরা আল্লাহর অনুমতি নিয়ে তাদের নির্মূল করে যাচ্ছিলে! এমনকি তোমরা যখন সাহস হারিয়ে ফেললে এবং (আল্লাহর রসুলের বিশেষ একটি) আদেশ পালনের ব্যাপারে মতভেদ শুরু করে দিলে, আল্লাহর রসুল যখন তোমাদের ভালোবাসার সেই জিনিস (তথা আসন্ন বিজয়) দেখিয়ে দিলেন, তারপরও তোমরা তাঁর কথা অমান্য করে (তাঁর বলে দেওয়া স্থান ছেড়ে) চলে গেলে। তোমাদের কিছু লোক বৈষয়িক ফায়দা হাসিল করতে চাইল (অপরদিকে) তখনও তোমাদের কিছু লোক পরকালের কল্যাণই চাইতে থাকল।
তারপর আল্লাহ তায়ালা (এর দ্বারা তোমাদের ইমান) পরীক্ষা নিতে চাইলেন এবং তা থেকে তোমাদের অন্যদিকে ফিরিয়ে দিলেন। তবু আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ক্ষমা করে দিলেন। আর আল্লাহ তো মুমিনদের অনুগ্রহ করেন।” [সুরা আল-ইমরান, ৩:১৫২] আমরা অনুমান করতে পারি, তিরন্দাজদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলেছিল। সম্ভবত প্রথম দিকে ৫০ জনের মধ্যে এক বা দুই জন গনিমত সংগ্রহে যাওয়ার পক্ষে কথা বলেছিলেন। তারপর ক্রমে তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং হয়তো ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ৫০ জনের মধ্যে ৪০ জনই গনিমত সংগ্রহের পক্ষে দেন। এভাবে একপর্যায়ে ১০ জন ছাড়া বাকি সবাই পাহাড় থেকে নিচে নেমে যান ।
ওদিকে কুরাইশ পক্ষের খালিদ ইবনে ওয়ালিদ দেখল যে এ এক সুবর্ণ সুযোগ। সে প্রাণ বাঁচানোর জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে যেতেই সুযোগ খুঁজছে, কিছু করা যায় কি না। এ থেকে তার সামরিক জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। বয়স মাত্র বিশের কোঠায়, কিন্তু তার বুদ্ধির প্রখরতা দেখুন। পুরো সিরাহে মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে বড় সামরিক ক্ষতির কারণ ছিল এই খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ।
৪০ জন তিরন্দাজকে পাহাড় থেকে নেমে আসতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে খালিদের মাথায় চট করে এক বুদ্ধি খেলে যায়। একটি মত অনুসারে, খালিদ তার দলবল নিয়ে ওহুদ পর্বত পুরোটা ঘুরে এসে আবার আক্রমণ করে। চিত্রে এটিকে প্রথম বিকল্প (‘অপশন ১’) হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে এই মতটি একাডেমিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ পুরো পর্বতটি ঘুরে এসে আক্রমণ করতে অন্তত ছয় ঘণ্টা সময় লাগার কথা। আর ততক্ষণে মুসলিমদের সবকিছু গুছিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে পারার কথা।
আরেকটি পথ দিয়ে খালিদের আক্রমণ করাকেই বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হয়, যা চিত্রে দ্বিতীয় বিকল্প (‘অপশন ২’) হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই বিকল্প অনুসারে, খালিদ দূর থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে। তারপর সে একটু ডানদিকে ঘুরে সেখানকার একটি নিচু গর্তের আড়ালকে ব্যবহার করে। সেই পথ দিয়ে গিয়ে সে পাহাড়ের উপরে থাকা বাকি ১০ জন তিরন্দাজকে অতর্কিতে আক্রমণ করে কাবু করে ফেলে। তখন তার সঙ্গে কতজন কুরাইশ যোদ্ধা ছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না । তবে মোটামুটিভাবে অনুমান করা যায় যে সংখ্যাটি ১০০-১৫০।
খালিদ ইবনে ওয়ালিদ আক্রমণের উদ্দেশ্যে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলে মুসলিম বাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। খালিদের ডানদিকে ছিল মুসলিমদের শিবির, যেখানে নবিজি (সা) অবস্থান করছিলেন, আর বামদিকে ছিলেন গনিমত সংগ্রহে ব্যস্ত মুসলিমরা। শিবিরে অবস্থানকারী ডানদিকের মুসলিমরা প্রাথমিক পর্যায়ে ওহুদ পর্বতের জন্য যে সুবিধা পাচ্ছিলেন, তা এখন তাঁদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল; তাঁদের এখন পালানোর আর কোনো জায়গা নেই। অন্যদিকে বামদিকের মুসলিমরা এখন ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় এবং মূল রসদ সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন। অবস্থা এমন যে, কিছু মুসলিম শিবিরের ভেতরে, অন্য মুসলিমরা যুদ্ধের ময়দানে, আর মাঝখানে শতাধিক শত্রুসেনা নিয়ে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ।
অনুমান করা যায়, মুসলিমরা যখন সম্পদ সংগ্রহে ব্যস্ত তখন তাঁদের হাতে তলোয়ারও ছিল না। কুরাইশদের পালিয়ে যাওয়ার পরে প্রায় দেড় ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। মুসলিমরা ধরে নিয়েছিলেন যে, এই যুদ্ধে তাঁরা চূড়ান্তভাবে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু ওই দেড় ঘণ্টার মধ্যেই খালিদ তার দল নিয়ে ফিরে এসে আবার আক্রমণ করে বসে।
খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ও তার দলকে প্রথম ফিরে আসতে দেখেছিলেন স্বয়ং নবিজি (সা)। আমরা বুঝতে পারি, সাহাবিরা আত্মতুষ্ট হয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন, নবিজি (সা) তাতে মোটেও স্বস্তি পাননি। তাই তিনি যতটা সম্ভব। সতর্কভাবে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলেন। নবিজির (সা) পক্ষে নিজের অবস্থান জানিয়ে দেওয়াও ছিল খুব বিপজ্জনক, কারণ তিনি জানতেন যে তিনিই শত্রুপক্ষের মূল লক্ষ্য। এরকম পরিস্থিতিতে আমরা যে কেউ অবিলম্বে সরে পড়তাম, কারণ মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হলো, শত্রুকে আসতে দেখলে উল্টোদিকে ঘুরে পালাবার চেষ্টা করা। কিন্তু নবিজি (সা) তখন অত্যন্ত সাহসী একটি কাজ করলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সর্বশক্তি দিয়ে মুসলিমদের উদ্দেশে চিৎকার করে বললেন, “হে মুসলিমগণ! তোমাদের পেছনে দেখো! তোমরা সাবধান হয়ে যাও। তারা পেছন থেকে আসছে!”
তিনি চিৎকার করে এই ঘোষণা দেওয়া ফলে শত্রুরা তাঁর অবস্থান জেনে গেল বটে, কিন্তু তিনি যদি এভাবে সতর্ক না করতেন, তাহলে হয়তো ওহুদের যুদ্ধে মুসলিমদের হতাহতের সংখ্যা দ্বিগুণ বা তিনগুণ হতো। এই সতর্কবার্তা পেয়ে কিছু মুসলিম বর্ম পরে অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন। আল্লাহ কোরানে উল্লেখ করেছেন: “(স্মরণ করো) তোমরা কেমনভাবে পালিয়ে যাচ্ছিলে ও পেছনে কারও প্রতি লক্ষ করছিলে না, যদিও রসুল তোমাদের পেছন দিক থেকে ডাকছিলেন।”
[সুরা আলে ইমরান ৩:১৫৩) আকস্মিক আক্রমণে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত মুসলিমদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তাঁরা একত্র হতে পারছিলেন না। তদুপরি তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন নিরস্ত্র। উপায়ান্তর না দেখে তাঁরা উল্টোদিকে ঘুরে পালিয়ে যেতে শুরু করেন। চরম বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তির মধ্যে কিছু মুসলিম অন্য মুসলিমদের তলোয়ারের আঘাতে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান। সেসব মৃত্যু ছিল অত্যন্ত করুণ ও দুর্ভাগ্যজনক ।
আরও পড়ুনঃ