আজকের আলোচনা রোজার নিয়ত বিষয়ক। মাহে রমজান মাসে রোজা রাখতে অনেকেই আরবিতে নিয়ত করতে পছন্দ করেন, আবার অনেকে নিজের মাতৃভাষায় নিয়ত করার পক্ষে। যেভাবে হোক, নিয়ত করা আগে সবকিছু থেকে বেশি জরুরি। আজ আমরা রমজান মাসের রোজা রাখার নিয়ত আরবি ভাষায় এবং তার বাংলা উচ্চারণসহ নিচে তুলে ধরব।

রোজা পালনে সেহরি ও ইফতারের পাশাপাশি রোজার নিয়তেরও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সেহরি খাওয়ার পর রোজার নিয়ত করা অত্যন্ত জরুরি।
রোজার নিয়ত আরবি ভাষায়:
نَوَيْتُ اَنْ اُصُوْمَ غَدًا مِّنْ شَهْرِ رَمْضَانَ الْمُبَارَكِ فَرْضًا لَكَ يَا اللهُ فَتَقَبَّلْ مِنِّى إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
রোজার নিয়তের বাংলা উচ্চারণ:
নাওয়াইতু আন আছুম্মা গাদাম মিন শাহরি রমাজানাল মুবারাকি ফারদাল্লা ইয়া আল্লাহু ফাতাকাব্বাল মিন্নি ইন্নিকা আনতাস সামিউল আলিম।
রোজার নিয়ত বাংলায় অর্থ:
“হে আল্লাহ! আমি আজকের পবিত্র রমজান মাসের ফরজ রোজা রাখার নিয়ত করলাম। অতএব, তুমি আমার এই নিয়ত কবুল কর, কারণ তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।”
সেহরির পর রোজার নিয়ত এভাবেও করা যায়:
উচ্চারণ: বিসাওমি গাদিন নাওয়াইতু মিন শাহরি রমাদান।
অর্থ: আমি রমজান মাসের আগামীকালের রোজা রাখার নিয়ত করছি।

Table of Contents
কিছু জরুরি কথা-
রোজা সঠিক ও স্বীকৃত হওয়ার জন্য নিয়ত করা শর্তসাপেক্ষ। নিয়ত অর্থ হলো অন্তরে কোনো কাজ করার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ। রোজাদারের জন্য সেহরি খাওয়া এবং ইফতার করা সুন্নত; তবে বিশেষ কোনো খাদ্যের ব্যবস্থা না থাকলে সামান্য পানি পান করলেও সেহরির সুন্নত পূরণ হয়।
নিয়ত মুখে আরবি বা বাংলায় উচ্চারণ করা বাধ্যতামূলক নয়। আল্লামা শামি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ফাতাওয়ায়ে শামিতে উল্লেখ করেছেন, ‘আভিধানিক অর্থে নিয়ত হলো ‘আজম’ — অর্থাৎ মনের দৃঢ় সংকল্প।’
অনেকেই জানেন না যে, রোজা রাখার জন্য নিয়ত ফরজ। ফলে অনেকে নিকট সময় পর্যন্ত রোজার নিয়ত মুখে বলেন না কিংবা মনের দৃঢ় সংকল্পও করেন না। আবার কেউ কেউ মুখে প্রচলিত নিয়ত উচ্চারণ করলেও অন্তরে দৃঢ় সংকল্প না থাকলে সেটি নিয়ত হবে না। তাই রোজা রাখার ক্ষেত্রে অন্তরের দৃঢ় সংকল্প অপরিহার্য।
সারমর্ম — রোজার নিয়ত করা ফরজ, এবং তা অন্তরে দৃঢ়ভাবে থাকতে হবে। মুখে উচ্চারণ করার পাশাপাশি মনের একনিষ্ঠ সংকল্প থাকলে রোজা আদায় সম্পূর্ণ হবে।

রোজার নিয়ত করার সময়:
ফরজ রোজার নিয়ত সাধারণত সাহরির পর, অর্থাৎ রাত বাকি থাকতেই করার চেষ্টা করা উত্তম। হজরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফজরের আজানের আগেই রোজা রাখার নিয়ত করবে না, তার রোজা সম্পূর্ণ হবে না।” (আবু দাউদ)
অনেক ইসলামী স্কলারদের মতে, “দিনের দ্বিপ্রহরের আগে রোজার নিয়ত না হলে সেই রোজা বিশুদ্ধ হবে না। তার পরেও যদি রোজাহীন অবস্থায় দিনের বাকি সময়ে পানাহার করা হয়, তা রমজানের মর্যাদার বিরুদ্ধে এবং জায়েজ নয়।” (ইমদাদুল ফাতাওয়া)
সুতরাং, রমজানের ফরজ রোজা, নির্দিষ্ট মানতের রোজা এবং নফল রোজাসমূহের নিয়ত রাতের বেলা কিংবা শরিয়তের ঘোষিত দ্বিপ্রহরের আগ পর্যন্ত করা গেলেও, সব ধরনের রোজার জন্য রাতেই নিয়ত করে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। (ফাতাওয়া দারুল উলুম)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সাহরির পর রোজা রাখার জন্য অন্তরের দৃঢ় সংকল্প ও নিয়ত করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

রোজার নিয়ত করা কি ফরজ ?
রোজার নিয়ত করা রোজা পালন করার পূর্বে ফরজ। অর্থাৎ, রোজা শুরু করার আগে সঠিক নিয়ত করা আবশ্যক। কেউ যদি নিয়ত না করে রোজা পালন করেন, তবে তার রোজা শুদ্ধ বা সঠিক হবে না। এছাড়াও, আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতিটি আমলের সওয়াব নিয়তের ওপর নির্ভর করে প্রদান করেন। তাই প্রতিটি কাজের জন্য নিয়ত সঠিক এবং সুন্দর হওয়া প্রয়োজন।

নফল রোজার নিয়ত:
আমরা অনেকেই বিভিন্ন নফল ইবাদত করি, যার মধ্যে অন্যতম হলো সিয়াম পালন বা রোজা রাখা। অনেকেই জানতে চান, নফল রোজার জন্য আলাদা কোনো নিয়ত করার প্রয়োজন আছে কি না। বাস্তবে নিয়ত অর্থ হলো ইচ্ছা পোষণ করা। অর্থাৎ, আপনি সিয়াম পালন করার ইচ্ছা করেছেন, এটাই নিয়ত। অতএব, আলাদা কোনো নিয়মকানুন মেনে বিশেষ কোনো নিয়ত শেয়ার করার প্রয়োজন নেই।
তবে কিছু নফল রোজার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় ও নিয়ম রয়েছে, অর্থাৎ সেগুলো নির্দিষ্ট সময়ে পালন করতে হয়। অন্যদিকে, এমন নফল রোজাও রয়েছে যা ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে পালন করে। এমন ক্ষেত্রে, যদি নফল রোজাটি সুনির্দিষ্ট হয়, তবে রোজা রাখার পূর্বেই নিয়ত করা উত্তম। যেমন ফজরের আগে নিজেকে নিয়ত দিয়ে রাখা ভালো যাতে রোজার ইবাদত সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।


জেনে নেবো রোজা ভাঙ্গার কারণসমূহ-
১. পানাহার বা স্ত্রীসহবাস করলে রোজা ভেঙে যায়, যদি রোজাদার সচেতন থাকে যে সে রোজা রেখেছে। তবে কেউ ভুলবশত রোজার কথা ভুলে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া বা সহবাস করলে রোজা ভাঙবে না, তবে স্মরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিরত থাকতে হবে। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড ৩, পৃ. ৩৬৫)
২. হুক্কা, সিগারেট, চুরুট ইত্যাদি ধোঁয়া গ্রহণ করলেও রোজা ভেঙে যায়, যদিও মনে করা হয় ধোঁয়া গলদেশ পর্যন্ত পৌঁছায়নি। (বাহারে শরীয়ত, খণ্ড ৫, পৃ. ১১৭)
৩. পান বা তামাক খেলে রোজা ভাঙবে, যদিও বারবার পিক ফেলে দেওয়া হয়, কারণ গলদেশে সামান্য অংশ পৌঁছতেই রোজা ভঙ্গ হয়। (বাহারে শরীয়ত, খণ্ড ৫, পৃ. ১১৭)
৪. মুখে রেখে গলে যাওয়া চিনি জাতীয় খাবার থুথু গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে। (বাহারে শরীয়ত, খণ্ড ৫, পৃ. ১১৭)
৫. দাঁতের মধ্যে ছোট বা বড় কোন খাদ্য বস্তু আটকে থেকে তা খেয়ে ফেললে, অথবা মুখ থেকে বের করে পুনরায় খেলে রোজা ভঙ্গ হবে। (দুররে মুখতার, খণ্ড ৩, পৃ. ৩৯৪)
৬. দাঁত থেকে রক্ত বের হয়ে গলদেশে নেমে গেলে এবং রক্তের পরিমাণ ও স্বাদ গলদেশে অনুভূত হলে রোজা ভেঙে যাবে। কম রক্ত ও স্বাদ অনুভূত না হলে রোজা ভঙ্গ হয় না। (দুররে মুখতার, খণ্ড ৩, পৃ. ৩৬৮)
৭. নাক দিয়ে ঔষধ প্রবেশ করালে রোজা ভেঙে যাবে। (আলমগীরী, খণ্ড ১, পৃ. ২০৪)
৮. কুলি করার সময় অনিচ্ছায় পানি গলদেশে নেমে গেলে বা নাক দিয়ে পানি গেলে রোজা ভাঙবে; তবে রোজাদার ভুলে গেলে ভাঙবে না। অন্য কেউ কণ্ঠে কিছু নিক্ষেপ করলে তাও রোজা ভেঙে যায়। (আল জাওয়াতুন নাইয়ারাহ, খণ্ড ১, পৃ. ১৭৮)
৯. ঘুমন্ত অবস্থায় পানি পান করা, কিছু খেয়ে ফেলা, অথবা মুখ খোলা থাকায় পানির ফোটা বা বৃষ্টি গলদেশে গেলে রোজা ভঙ্গ হয়। (আল জাওয়াতুন নাইয়ারাহ, খণ্ড ১, পৃ. ১৭৮)
১০. অন্য কারো থুথু গিলে ফেলা বা নিজের থুথু মুখ থেকে বের করে পুনরায় গিলে ফেলা রোজা ভাঙাবে। তবে মুখে থুথু বা কফ থাকলে তা গিলে ফেললেও রোজা ভঙ্গ হয় না। (আলমগীরী, খণ্ড ১, পৃ. ২০৩)
১১. মুখে রঙিন সুতা বা অনুরূপ কিছু থাকার ফলে থুথু রঙিন হয়ে গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যায়। (আলমগীরী, খণ্ড ১, পৃ. ২০৩)
১২. চোখের পানি মুখে চলে গেলে এবং তা গিলে ফেললে, দু-তিন ফোটা হলে রোজা ভাঙবে না, বেশি হলে এবং মুখে লবণাক্ত স্বাদ অনুভূত হলে রোজা ভাঙে। ঘামের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য। (আলমগীরী, খণ্ড ১, পৃ. ২০৩)
১৩. ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ ভর্তি বমি করলে রোজা ভেঙে যায়, অনিচ্ছাকৃত হলে ভাঙে না। (দুররে মুখতার, খণ্ড ৩, পৃ. ৩৯২)
১৪. রক্তদান করলে রোজার ক্ষতি নেই; তবে রক্ত গ্রহণ করলে রোজা ভেঙে যায়। (ফতোয়ায়ে ফয়জুর রসুল)
এই নিয়মাবলী মেনে চললে রোজা পালন সঠিক ও সাবলীল হবে।
যে কারণে রোজা মাকরুহ হয়
রমজান মাসে রোজা পালন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। পবিত্র কুরআনে ‘كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ’ আয়াতে রোজাকে ফরজ করা হয়েছে যেন মানুষ তাকওয়ার পথে চলে — ‘لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ’। আর হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ তাআলা বলেন, “রোজা আমার জন্য, এবং আমিই এর প্রতিদান দেব।” অতএব, রোজাদারের জন্য রোজার পবিত্রতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
রোজা ভঙ্গ না করলেও কিছু কাজ আছে, যা রোজাকে মাকরুহ (অপ্রীতিকর) করে তোলে এবং তার পূর্ণতা ও ফজিলত থেকে বঞ্চিত করে। যেমন:
মিথ্যা বলা, গীবত, চোগলখোরি, গালাগাল ও অশ্লীল কথা বলা— এসব আচরণ রোজার আত্মিক মূল্য নষ্ট করে দেয় এবং তা মাকরুহ হয়ে যায়।
বিনা প্রয়োজন জিহ্বার মাধ্যমে কোনো জিনিসের স্বাদ নেওয়া বা চিবানো— এটি মাকরুহ; যদিও প্রয়োজন হলে স্বাদ পরীক্ষা করা যেতে পারে, তবে তা যেন কণ্ঠনালি অতিক্রম না করে। করলে রোজা ভেঙে যাবে (দুররে মুখতার ৩/৩৯৫)।
স্বামী-স্ত্রীর চুম্বন— সাধারণ চুম্বন মাকরুহ নয়, তবে ঠোঁট ও জিহ্বা শোষণের মাধ্যমে মুখে কিছু চলে গেলে রোজা ভেঙে যাবে (রদ্দুল মুখতার ৩/৩৯৬)।
অতিরিক্ত পরিশ্রম বা ক্লান্তিকর কাজ— যার ফলে রোজা রাখায় অসুবিধা হয়, যেমন রক্তদান ইত্যাদি, তা মাকরুহ বিবেচিত হয় (দুররে মুখতার ৩/৪০০)।
রোজা ভঙ্গ ও তার প্রতিকার
রোজা ইচ্ছাকৃতভাবে ভঙ্গ করলে কেবল কাজা নয়, বরং ৬০ দিন একটানা কাফফারাও ওয়াজিব হয়। তবে অনিচ্ছাকৃত বা বৈধ কারণবশত রোজা ভঙ্গ হলে শুধুমাত্র কাজা আদায় যথেষ্ট।
রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য আত্মসংযম অর্জন ও নৈতিক উৎকর্ষ সাধন। এজন্য মহানবী (সা.) বলেছেন,
“রোজা ঢালের মতো। তাই কেউ যেন রোজার দিনে অশ্লীলতা, ঝগড়া বা গালি-গালাজে লিপ্ত না হয়। কেউ গালি দিলে সে যেন বলে, ‘আমি রোজাদার।’”
সতর্কতা রোজার অপরিহার্য অংশ। এজন্য ফকিহগণ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে রোজা ভঙ্গ ও মাকরুহ হওয়ার নির্দিষ্ট কারণগুলো নির্ধারণ করেছেন। মুসলমানের উচিত এসব বিষয়ে সচেতন থাকা, যাতে রোজার পূর্ণ ফজিলত লাভ করা যায়।