বনু কুরায়জার লোকদের মৃত্যুদণ্ড | বনু কুরায়জা উপজাতি, রায় ঘোষণার পর বনু কুরায়জার পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী একটা পরিখাও খনন করা হয়। পরিখাটি ছিল বনু নাজ্জার গোত্রের এক নারীর মালিকানাধীন বিস্তৃত এক জমিতে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের বেঁধে পর্যায়ক্রমে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এটি ছিল তাদের ওপর আল্লাহ তায়ালার রায়।
আতিয়া আল-কুরাজি নামের এক তরুণ বয়স কম হওয়ার কারণে বেঁচে যান। তিনি পরে ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে আতিয়া সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বলেন, “আমি ছিলাম একটা বালক। আমার চুল ছিল না বলে তারা আমাকে রেহাই দিয়েছিল।” এ থেকে বোঝা যায়, শুধু প্রাপ্তবয়স্কদেরই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল।
বনু কুরায়জার লোকদের মৃত্যুদণ্ড | বনু কুরায়জা উপজাতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

হুয়ায় ইবনে আখতাব সম্পর্কেও বেশ কয়েকটি কাহিনি বর্ণিত আছে। সে দুর্গ থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় তার সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটি পরে ছিল। পোশাকটি তার দেহে ফিতা দিয়ে বাঁধা ছিল, কারণ সে চায়নি কেউ তার মৃত্যুর পর তার শরীর থেকে সেটি খুলে নিয়ে যাক। সে নবিজির (সা) পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে, “আল্লাহর কসম, তোমার প্রতি আমার শত্রুতা নিয়ে আমি কখনও অনুশোচনা করিনি। কিন্তু আল্লাহ যাকে অপমান করেন, সে-ই প্রকৃত অপমানিত।” তার এই কথা থেকে বোঝা যায়, সে ভালো করেই জানত আল্লাহ কার পক্ষে আছেন ।
একপর্যায়ে সে তার লোকদের দিকে ফিরে বলে, “হে আমার সম্প্রদায়, দুঃখ করো না । এটা বনি ইসরাইলের প্রতি আল্লাহর ফয়সালা ।” কোরানেও এর উল্লেখ আছে [৭:১৬৭]।
তারপর সে ঘাড় নিচু করলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কাব ইবনে আসাদকে বের করে আনা হলে নবিজি (সা) তাকে বললেন, “হে কাব, তুমি কেন ইবনে খারাশের পরামর্শ গ্রহণ করলে না? তাহলে তো তুমি উপকৃত হতে। সে তো আমার প্রতি বিশ্বাস এনেছিল এবং তোমাকে বলেছিল। আমাকে অনুসরণ করতে। সে তো তোমার মাধ্যমে আমাকে সালাম জানিয়ে বলেছিল, আমাকে দেখলে তার সালাম আমাকে পৌঁছে দিতে।”
ইবনে খারাশ ছিলেন ইহুদিদের একজন রাবাই, তিনি নবিজির (সা) আগমনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। তিনি নবিজির (সা) আগমনের আগেই মারা যান। জবাবে কাব বলল, “আমি তাওরাতের শপথ করে বলছি, হে আবুল কাসিম, এটা (তোমার ধর্ম) সত্য। এমন যদি না হতো যে ইহুদিরা আমার সমালোচনা করে বলবে যে মৃত্যুর ভয়ে আমি ধর্মান্তরিত হয়েছি, তাহলে হয়তো আমি তোমাকে এমনকি এখনও অনুসরণ করতাম। কিন্তু আমি ইহুদি ধর্মবিশ্বাস নিয়েই মরতে চাই।”

কোনো অপ্রাপ্তবয়স্ককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। নারীদের মধ্যে মাত্র একজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আমরা তার নাম জানি না। আয়েশা (রা) বর্ণনা করেছেন, তিনি যখন বন্দিদের সঙ্গে বসে ছিলেন, তখন তাদের মধ্যে একজন নারীকে হাসাহাসি ও ব্যঙ্গবিদ্রুপ করতে দেখেছেন। সেই সময় তার লোকদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হচ্ছিল। এক সময় কেউ তার নাম ধরে ডাকলে সে উঠে দাঁড়ায়। আয়েশা (রা) তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন?”
নারীটি: মৃত্যুদণ্ডের জন্য ।
আয়েশা (রা): মৃত্যুদণ্ড কেন?
নারীটি: কারণ আমি কিছু একটা করেছি।
পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পারি, সে অবরোধের সময় উঁচু থেকে একটি বড় পাথর নিক্ষেপ করে একজন সাহাবিকে হত্যা করেছিল। হত্যার অপরাধেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আয়েশা পরে এক সময় মন্তব্য করেছিলেন, “ওই মহিলা নিজের আসন্ন মৃত্যুদণ্ডের কথা জেনেও হাসাহাসি করছিল, তা দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না।”
আরেকটি চমকপ্রদ কাহিনি আছে সাবিত ইবনে কায়েস ইবনে শাম্মাস (রা) নামের এক আনসারকে নিয়ে। হিজরতের আগে আউস ও খাজরাজের মধ্যে বুআতের যুদ্ধের সময় জুবায়ের ইবনে বাত্তা নামে বনু কুরায়জার এক লোক সাবিতকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল। বন্দিদের মধ্যে সেই জুবায়েরও ছিল। সে এতদিনে অনেক বুড়ো হয়ে গেছে। সাৰিত বন্দিদের মধ্যে জুবায়েরকে দেখতে পেয়ে বললেন, “আপনার কি আমার কথা মনে আছে?”
জুবায়ের বলল, “অবশ্যই। তুমি তো সেই ব্যক্তি যাকে আমি প্রাণে বাঁচিয়েছিলাম।” সাবিত বললেন: “এখন আমার সেই ঋণ শোধ করার সময় এসেছে। আপনি কি চান, আমি সেই ঋণ শোধ করি?” জুবায়ের বলল, “অবশ্যই। একজন উদার ব্যক্তির উদারতা সব সময়ই প্রশংসনীয়।” সাবিত নবিজির (সা) কাছে গিয়ে) বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, দয়া করে জুবায়েরকে মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি দিন।”
নবিজি (সা) বললেন, “তাকে তোমার জন্য অব্যাহতি দিলাম।” সাবিত জুবায়েরের কাছে ফিরে গিয়ে তাকে এই খবরটি দিলে সে বলল, “পরিবার ছাড়া এ জীবনের আর কি প্রয়োজন আছে?” সাবিত আবার নবিজির (সা) কাছে ফিরে গিয়ে জুবায়েরের পরিবারের মুক্তির জন্য অনুমতি চান। এবারও নবিজি (সা) বলেন, “তাদেরও তোমার জন্য অব্যাহতি দিলাম।”
এবার জুবায়ের আবদার করল, “টাকা না থাকলে এ জীবনের আর কি প্রয়োজন আছে?” সাবিত আবারও নবিজির (সা) কাছে ফিরে এলে তিনি এবারও বললেন, “সেটাও তোমার জন্য দিলাম।” সব নিশ্চয়তা পাওয়ার পর জুবায়ের জিজ্ঞেস করল, “অমুক কোথায়? তমুক কোথায়?” সে তার সব বন্ধুদের নামের তালিকা করা শুরু করে দিল। কিন্তু তাদের সবাইর মৃত্যুদণ্ড ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়ে গেছে, নয়তো সেই প্রক্রিয়া চলছে। তখন জুবায়ের বলল, “বন্ধু ও স্বগোত্রের লোকজন ছাড়া এ জীবনের কি কোনো মানে আছে? আমাকে বরং মৃত্যুদণ্ডই দিয়ে দাও।” তারপর তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। জানা যায়, বনু কুরায়জার কিছু লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং মৃত্যুদণ্ড থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল।
আরও পড়ুনঃ