রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা | বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা | বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি, মক্কায় সামরিক ব্যবস্থার কোনো বালাই ছিল না। মক্কায় মুসলিমদেরকে যে কোনো ধরনের সংঘাত এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছিল, যা পবিত্র কোরানেও বেশ কয়েকটি আয়াতে এসেছে: “সুতরাং তুমি তাদের উপেক্ষা করো আর প্রতীক্ষা করো।” [32:30] “সুতরাং তুমি ধৈর্য ধরো, সুন্দর করে ধৈর্য ধরো।” [৭০:৫] “ওরা যদি তোমার অবাধ্য হয়, তুমি বলবে, ‘তোমরা যা করো আমি তার জন্য দায়ী নই।’ তুমি পরাক্রমশালী ও দয়াময়ের ওপর ভরসা করো।” [২৬:২১৬-২১৭|

ইয়াসির, সুমাইয়া, বেলাল প্রমুখ সাহাবি আক্ষরিক অর্থেই অত্যাচারে জর্জরিত হতে হতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছেন। একবার ভাবুন, নবিজি (সা) তো কোনো একজন সাহাবিকে বেলালের ওপর অত্যাচারকারী উমাইয়া ইবনে খালাফকে হত্যা করার জন্য বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, তা করলে ফল ভালো হতো না। আমরা জানি, বেলালকে অসহ্য যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। কিন্তু উমাইয়া ইবনে খালাফকে হত্যা করা হলে অত্যাচার-নিপীড়নের মাত্রা যেভাবে বেড়ে যেত, নবীন উম্মাহ তা সহ্য করতে পারত না।

 

রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা | বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা | বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

মক্কায় প্রথম দিকে কিছু সাহাবি, বিশেষ করে তরুণরা, অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই ও প্রতিরোধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ সুরা নিসায় তাদের সমালোচনা করেছেন: “তুমি কি তাদের দেখনি (মক্কার দিনগুলোতে) যাদের বলা হয়েছিল, ‘তোমরা তোমাদের হাতকে সংযত করো আর নামাজ কায়েম করো ও জাকাত দাও।” [৪:৭৭] লক্ষ করুন, মক্কায় জাকাত ছিল একটি ঐচ্ছিক দান, বাধ্যতামূলক নয়।

মক্কার সময়ে মুসলিমদের সাধারণ কিছু নৈতিক নির্দেশ পালন করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু দিনে পাঁচবার দুই রাকাত করে নামাজ পড়া ছাড়া আর কোনো বাধ্যতামূলক বিধিবিধান তখন নাজিল হয়নি। সেই অবস্থায় নবিজি (সা) তাঁর সাহাবিদের কোনো রকম সংঘাতে না জড়িয়ে শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতার চর্চায় মনযোগী হতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এই একই সাহাবিরা যাঁরা যুদ্ধ করার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, তাঁদের ব্যাপারে সুরা নিসায় (উপরে উল্লিখিত আয়াতের ঠিক পরের অংশেই) আল্লাহ বলেছেন:  “তারপর যখন তাদের যুদ্ধের বিধান দেওয়া হলো তখন তাদের একদল আল্লাহকে ভয় করার মতো বা তার চেয়েও বেশি মানুষকে ভয় করেছিল।” [৪:৭৭] অর্থাৎ অবশেষে আল্লাহ যখন (মদিনার সময়ে) তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দিলেন তখনই তারা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। দেখা যাচ্ছে, যারা সবচেয়ে বেশি কথা বলেছে, তারা সবচেয়ে কম কাজ করেছে। সুতরাং আল্লাহ তায়ালা মদিনায় তাদের দ্বিধা এবং উৎসাহের অভাবের জন্য সমালোচনা করেছেন। কারণ ততদিনে ‘জেহাদ’ এবং ‘কিতাল’-এর ওপর আয়াত নাজিল হয়ে গিয়েছে।

জেহাদ ও কিতাল সম্পর্কে কথা বলতে গেলে নবিজির (সা) সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলোকে ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে দেখতে হবে। আমরা এখানে বিষয়কে ‘ডেসক্রাইব’ (বর্ণনা) করছি, তা ‘প্রেসক্রাইব’ (বিধান দান করছি না। আমরা অতীতের ঘটনা নিয়ে কথা বলছি, বর্তমানের কোনো বিষয়ে নয়, কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদকে উসকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। এই কথাটি বলে নিতে হচ্ছে এ জন্য যে, আমাদের এই বিপজ্জনক সময়ে যে কোনো কথাকে প্রসঙ্গ বিবেচনায় না নিয়ে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে জেলে ঢোকানোর ঘটনাও ঘটছে।]

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

জেহাদ সম্পর্কে কোরানে প্রথম যে আয়াত নাজিল হয়েছিল, তা থেকে আল্লাহ কেন এটির অনুমতি দিয়েছিলেন তার দর্শনগত ধারণা পাওয়া যায়। সুরা হজের ৩৯ ও ৪০ নম্বর আয়াত ছিল জেহাদের ব্যাপারে প্রথম অনুমতি । আল্লাহ বলেন: “যারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হলো, কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার/অবিচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম।” [২২:৩৯]

“তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করে দেওয়া হয়েছে শুধু এ জন্য যে তারা বলে, “আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ।’ আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে আরেক দল দিয়ে বাধা না দিতেন তাহলে বিধ্বস্ত হয়ে যেত (খ্রিষ্টানদের) মঠ ও গির্জা, ধ্বংস হয়ে যেত (ইহুদিদের) ভজনালয়, আর মসজিদ – যেখানে আল্লাহর নাম বেশি করে স্মরণ করা হয় ।” [২২:৪০] প্রথম (৩৯ নাম্বার) আয়াতটিতে আল্লাহ বলছেন, ‘অনুমতি দেওয়া হলো।’ ব্যবহৃত এই বাক্যাংশটি লক্ষ করুন। এর অর্থ জেহাদ ইসলামের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।

এর আগে যারা প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল আল্লাহ তাদের নিবৃত্ত করেছিলেন। আর এখন অনুমতি দেওয়া হলো, ‘কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার/অবিচার করা হয়েছে। যাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে তাদের পক্ষে অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা এখানে বলা হয়েছে। যখন অত্যাচারিতের পক্ষে তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা থাকে না, তখনই কেবল যুদ্ধ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পরে আল্লাহ বলছেন, ‘আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম।’ তারপরে আল্লাহ বলছেন, ‘তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বের করা হয়েছে শুধু এজন্য যে তাঁরা বলে যে তাদের প্রতিপালক আল্লাহ।’

লক্ষ করুন, এখানে জেহাদের অনুমতি দেওয়ার পেছনে যুক্তি ও দর্শনটি খুব স্পষ্ট: তারা তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছে, তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, তারা তোমার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে; সুতরাং এখন আমি তোমাকে পাল্টা লড়াইয়ের অনুমতি দিচ্ছি। পৃথিবীর যে কোনো সমাজই এটিকে পাল্টা যুদ্ধ করার ন্যায্য কারণ হিসেবে গ্রহণ করবে। আমেরিকা যুদ্ধে নেমেছিল ব্রিটিশরা চায়ের ওপর কর বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে। এটি যদি একটি যুক্তিযুক্ত কারণ হয়, তাহলে ইসলামের দৃষ্টিতে জেহাদের কারণ (অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া) অনেকগুণ বেশি যুক্তিযুক্ত।

আল্লাহ যদি ন্যায়সংগত কারণে যুদ্ধের অনুমতি না দিতেন, তাহলে পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতো। সমাজে সত্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াই করার জন্য মানুষের প্রয়োজন আছে। এমনকি খুব শান্তিবাদী মানুষও মানতে বাধ্য হবে যে, সময়মতো হিটলারের বিরোধিতা না করলে বিশ্ব আজ এক ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতো। অতএব আপনাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়াতে হবে।

 

রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা | বদরের যুদ্ধের প্রস্তুতি | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

সুরা হজের ৪০ নম্বর আয়াতের মতো সুরা বাকারার ২৫১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলছেন: “আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দিয়ে দমন না করতেন (অর্থাৎ আল্লাহ যুদ্ধের অনুমতি না দিতেন), তবে নিশ্চয়ই পৃথিবী ফ্যাসাদে পূর্ণ হয়ে যেত।” | 2:201) ইসলামি শরিয়ত অনুসারে যুদ্ধে যাওয়ার মূল কারণ হলো ‘জুলম’ (অবিচার/নিপীড়ন) এবং ফ্যাসাদের (দুর্নীতি) বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।

সব সমাজেই কিছু কিছু কারণে যুদ্ধ করার অনুমতি আছে। আমাদের ধর্মেও জেহাদের অনুমতি আছে, যদিও অধিকাংশ অমুসলিমই তা ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে। যখন কোনো জনগোষ্ঠীর মানবিক অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা হরণ করা হয়, তখন সেই অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি উপযুক্ত কারণ।

আবু বকর (রা) বলেছেন, “যখন আল্লাহ সুরা হজ্ব নাজিল করেন, তখনই আমি জানতাম যে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হবে।” অনেকের ধারণা, সুরা হজ মক্কার সময়ের একেবারে শেষের দিকে অবতীর্ণ হয়েছিল। আবার কারও কারও ধারণা অনুসারে সুরাটি মদিনা যুগের শুরুতে অবতীর্ণ হয়েছিল। তবে বেশিরভাগের মত অনুসারে এটি মক্কী সুরা।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment