সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা | সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাক-ইসলামি আরব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা | সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাক-ইসলামি আরব, ‘সিরাহ’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ পথ পাড়ি দেওয়া বা ভ্রমণ করা। আমরা যখন কোনো ব্যক্তির জীবনী জানতে চাই, তখন আসলে আমরা ওই ব্যক্তির জীবন চলার পথ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। এ কারণে ব্যক্তির জীবনীকে সিরাহ বলা হয়। একইভাবে মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবনীকে বলা যেতে পারে “সিরাতে মুহাম্মদ’, অর্থাৎ ‘মুহাম্মদের সিরাহ’। তবে মুসলিম স্কলাররা সিরাহ বলতে কেবলমাত্র মহানবি হজরত মুহাম্মদের (সা) জীবনীকেই বুঝিয়েছেন ।

আমরা কেন সিরাহ, অর্থাৎ মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবনী, অধ্যয়ন করব? এই কারণে যে, এর মাধ্যমে আমরা অসংখ্য উপকারিতা পেতে পারি: ১) পবিত্র কোরানে ৫০টিরও বেশি আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসুলকে (সা) মানবজাতির জন্য উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য বলেছেন। যেমন: “তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে বেশি করে স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রসুলের মধ্যে এক উত্তম আদর্শ রয়েছে।”

 

সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা | সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাক-ইসলামি আরব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা | সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাক-ইসলামি আরব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

[সুরা আহজাব, ৩৩:২১] সুতরাং আমাদের অবশ্যই নবিজির (সা) জীবন ও সময় সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে হবে। আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমাদের সামনে রয়েছে এক নিখুঁত, পরিপূর্ণ এবং অনুসরণযোগ্য উদাহরণ। তাঁর জীবনী (সিরাহ) অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে আমরা নানা বিষয় শিখতে পারি এবং নানাভাবে উপকৃত হতে পারি:

  • (ক) ধর্ম—আমরা কীভাবে আল্লাহর ইবাদত করব;
  • (খ) শিষ্টাচার এবং নৈতিকতা;
  • (গ) ক্ষমাশীলতা এবং কোমলতা;
  • (ঘ) নেতৃত্ব—মহানবি মুহাম্মদ (সা) কীভাবে মুসলিম সমাজকে নেতৃত্ব দিয়ে সফলতায় পৌঁছেছিলেন;
  • (ঙ) পিতা ও স্বামী হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন; (চ) বন্ধু ও প্রতিবেশীর সঙ্গে তিনি কেমন ছিলেন, ইত্যাদি।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা পৃথিবীতে যুগে যুগে নবি-রসুল পাঠিয়েছেন যাতে মানুষ অনুসরণ করার মতো উদাহরণ খুঁজে পায়। তাই আল্লাহ তায়ালা আমাদের মতোই রক্ত-মাংসের মানুষদের নবি হিসেবে পাঠিয়েছেন। একই সঙ্গে আল্লাহ মধিদেরকে ‘রোল মডেল’ হিসেবে অনুসরণ করতে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেছেন, তিনি চাইলে নবি হিসেবে মানুষের বদলে ফেরেশতা পাঠাতে পারতেন। আল্লাহ যদি ফেরেশতাদের নবি হিসেবে পাঠাতেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই কাফেররা তাদের প্রত্যাখ্যান করত।

২) নবিজির (সা) প্রতি আমাদের ভালোবাসা বাড়ানোর অন্যতম কার্যকর পন্থা হচ্ছে তাঁর সিরাহ অধ্যয়ন করা। যে ব্যক্তি নবিজিকে (সা) ভালোবাসে বলে দাবি করে কিন্তু সিরাহ অধ্যয়ন করে না, সে সত্যিই তাঁকে ভালোবাসে কি না। সেটা নিয়ে সংশয় থেকে যায় । কিন্তু আমরা সিরাহ অধ্যয়নের বিষয়টিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেই না। এটি সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের বেশিরভাগই, বিশেষ করে আমাদের ছেলেমেয়েরা, সিরাহ সম্পর্কে তেমন একটা জানে না। অথচ আমরা চলচ্চিত্র-তারকা, গায়ক, কিংবা খেলোয়াড়দের সম্পর্কে অনেক খবরই রাখি। কিন্তু যাঁর সম্পর্কে আমাদের সবচেয়ে বেশি জানা প্রয়োজন, তাঁর সম্পর্কেই জানছি না।

৩) পবিত্র কোরান ভালোভাবে বোঝার ক্ষেত্রে সিরাহ আমাদের অনেকভাবে সহায়তা করতে পারে। কোরান একটি গভীর জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ যা বুঝতে গেলে বিষয়গুলোর পূর্বাপর সম্বন্ধ বা প্রসঙ্গ বুঝতে পারা খুবই প্রয়োজন । উদাহরণস্বরূপ, সুরা দোহাতে আছে, “তোমার প্রতিপালক তোমাকে ছেড়ে যাননি এবং তোমার ওপর অসন্তুষ্টও হননি।” [৯৩:৩) এই আয়াতটি কখন ও কেন নাজিল (অবতীর্ণ) হয়েছিল তা না জানা পর্যন্ত আয়াতটি আমাদের পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব নয়।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

আমরা সিরাহ থেকেই তা জানতে পারি । [প্রসঙ্গটি হলো, কয়েক সপ্তাহ ধরে ওহি না আসার ফলে নবিজি (সা) অত্যন্ত চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহ কি তাহলে তাঁকে ত্যাগ করেছেন? এ রকম ভাবনাও তাঁর মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। সময়টা ছিল নবুয়তের প্রথম বছর। আল্লাহ তায়ালা তাঁর রসুলকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এই সুরাটি নাজিল করেছিলেন।]

৪) সিরাহ অধ্যয়ন আমাদেরকে যেমন একদিকে উজ্জীবিত করে, তেমনি অন্যদিকে আশান্বিতও করে। আজকের সময়ে বিশ্বব্যাপী ইসলামফোবিয়া’র বিস্তারের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টি আরও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিমদের কত দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল, তা আমরা সিরাহ অধ্যয়নের মাধ্যমে জানতে পারি। তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলেই বুঝতে পারি আমাদের এখনকার অবস্থা কত সহজ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে পূর্ববর্তী নবিদের কাহিনি বর্ণনা করেছেন, যার মাধ্যমে নবিজির (সা) ইমান বৃদ্ধি পেয়েছিল। আল্লাহ বলেছেন, “আর আমি পূর্ববর্তী রসুলদের কাহিনি তোমার কাছে বর্ণনা করেছি, যাতে তোমার হৃদয় হয় দৃঢ়।” [সুরা হুদ, 11:120/

৫) মহানবির (সা) জীবনে অলৌকিক বিষয়গুলোর প্রসঙ্গ এলে আমরা উদাহরণ হিসেবে চাঁদের বিভাজনের কথা উল্লেখ করে থাকি। আসলে নবিজির (সা) পুরো জীবনটাই এর চেয়েও অনেক বড় একটি অলৌকিক ব্যাপার। পিছিয়ে থাকা এক পৌত্তলিক সমাজে জন্ম নিয়ে মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে তিনি যেভাবে ইসলামকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, সেটাই তো অবিশ্বাস্য। ওই অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় সাফল্য অর্জনের প্রক্রিয়ায় তিনি যে মেধা, প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও নেতৃত্বের গুণাবলির স্বাক্ষর রেখেছেন, তা-ও কম অলৌকিক ব্যাপার নয়। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি যেমন সরল ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন করেছেন, তেমন ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল।

প্রখ্যাত আন্দালুসিয়ান স্কলার ইবনে হাজম এভাবে বর্ণনা করেছেন, “আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদকে (সা) কোনো রকম ‘মিরাকল’ (আরবিতে ‘মোজেজা’) না- ও দেওয়া হতো, তবুও তিনি যে আল্লাহর নবি তা প্রমাণ করার করার জন্য শুধুমাত্র তাঁর জীবন ও সময়পঞ্জিই যথেষ্ট।” তিনি যেভাবে আরব বিশ্বে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সমগ্র বিশ্বকে বদলে দিয়েছিলেন সেটাই তো একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার। কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে, মাত্র বিশ বছরের মধ্যে অনগ্রসর আরব অঞ্চল থেকে আগত একদল মানুষ শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে? এটিও কি কেউ ভেবেছিল যে, অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত কম সভ্য একদল মানুষ একটি নতুন ধর্মকে পুঁজি করে শক্তিশালী সাম্রাজ্যগুলোর সেনাবাহিনীদের বিরুদ্ধে একের পর এক যুদ্ধে বিজয়ী হবে?

 

সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা | সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাক-ইসলামি আরব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন

 

৬) আজকের পৃথিবীতে মুসলিমরা বিভিন্ন মত ও পথের কারণে নানা দল ও উপদলে বিভক্ত। আমরা যদি হারানো সেই গৌরব ও সম্মান ফিরে পেতে চাই, তাহলে আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মদের (সা) জীবনী ভালো করে পড়তে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, কীভাবে তিনি শূন্য অবস্থা থেকে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সফল হয়েছিলেন।

৭) সহিহ মুসলিমের বর্ণনা অনুসারে, নবিজি (সা) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে তারাই সেরা যারা আমার প্রজন্মের (অর্থাৎ সাহাবিরা), তারপরের সেরা তাদের পরের প্রজন্ম (অর্থাৎ তাবেয়িনরা), এবং তারপরের সেরা তাদের পরের প্রজন (অর্থাৎ তাবেয়ি তাবেয়িনরা)।” সাহাবিদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “… আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট।” (সুরা তওবা, ৯:১০০) ইবনে মাসউদ (রা) বলেছেন, “আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তরের দিক বিবেচনা করে সবচেয়ে মাটি ও পবিত্রতম হিসেবে মুহাম্মদকে (সা) ছে নিয়েছিলেন, এবং তারপরের মাটিদের মধ্য থেকে তাঁর রসুলের সারাদি বানিয়েছিলেন।”

সিরাহ অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারব ইসলামের প্রথম যুগের কিংবদন্তি, যেমন আৰু বকর, উমর, আনাস, জাবির, সান ইবনে মুজান, তালহা ও জুবায়ের প্রমুখ ব্যক্তিদের জীবনের ত্যাগ, সংগ্রাম, ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের বিভিন্ন ঘটনা। এঁরাই আমাদের জন্য ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন।

৮) আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মহলও নবিজিকে (সা) আ করেছে এবং অসম্মান করে কথা বলেছে, এবং এখনও কেউ কেউ তাকে অসম্মান করে কথা বলছে। কুরাইশরা তো তাঁকে পাগল, জানুকর, কবি ইত্যাদি আধ্যা দিয়েছিল। এখনকার সময়েও কেউ কেউ তাকে ‘রক্তপিপাসু সন্ত্রাসী ‘নারীলোলুপ’ ইত্যাদি অসত্য বিশেষণ ব্যবহার করে অবমাননা করার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু আমরা যদি তাঁর জীবন, সেই সময়ের ঘটনাবলি ও কার্যকারণ সম্পর্কে ভালোভাবে জানি তবেই তো এসব অসত্য ও অসৌজন্যমূলক অভিযোগগুলো খণ্ডন করে নবিজির (সা) সম্মান রক্ষা করতে পারব। মুহাম্মদের (সা) জীবন ও সময় সম্পর্কে জানা আমাদের ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে জানারই সমার্থক।

আরো পড়ুনঃ

 

Leave a Comment