রাসুল সাঃ এর জীবনী- তাঁর সম্প্রদায়কে নির্যাতন- সীরাতুন্ নবী (সা.) [ সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

রাসুল (সাঃ) এর জীবনী – সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড – রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর তাঁর সম্প্রদায়ের নির্যাতন- সীরাতুন্ নবী (সা.) – ইবনে হিশাম (র.)

Table of Contents

আবূ লাহাব সম্পর্কে আল্লাহ্ যা নাযিল করেন

আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর রাসূল (সা) কে বরাবরই কুরায়শদের থেকে হিফাযত করেছেন। এই সামাজিক বয়কটকালে তাঁর চাচা এবং তাঁর গোত্র বনু হাশিম ও বন মুত্তালিবও যথারীতি তাঁর পক্ষে রুখে দাঁড়ায় এবং সার্বিক সহায়তা দান করে। কাফিররা যখনই তাঁর উপর কোন দৈহিক আক্রমণ চালানোর দুরভিসন্ধি করেছে, তখনই তারা ইস্পাত-কঠিন প্রাচীররূপে সম্মুখে ট্টো-উপহা দাঁড়িয়েছে। অনন্যোপায় হয়ে কুরায়শরা ঠাট্টা উপহাস ও কূট-তর্কের পথ বেছে নেয়। তাদের এসব অপতৎপরতা সম্পর্কে যুগপৎভাবে কুরআনের আয়াতও নাযিল হতে থাকে।

কুরআন তো পরিষ্কারভাবে অনেকের নামও উচ্চারণ করেছে, আবার অনেক সময় সাধারণভাবে কাফিরদের আলোচনাক্রমে তাদের উল্লেখ করে দিয়েছে। কুরআন মজীদে যাদের নাম উচ্চারিত হয়েছে, তাদের মধ্যে সবশেষে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চাচা আবূ লাহাব ইব্‌ন আবদুল মুত্তালিব এবং তার স্ত্রী উম্মু জামীল বিন্ত হারব ইব্‌ন উমাইয়া; যাকে আল্লাহ তা’আলা নাম দিয়েছেন ‘হাম্মালাতাল-হাতাব’ ‘‘ইন্ধন বহনকারিণী”। কারণ সে কাঁটা বহন করে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যাতায়াত পথে ছড়িয়ে দিত। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের উভয়ের সম্পর্কে নাযিল করেন:

تارا ذات لهب – وأمرائه تبت يدا أبي لهب وتب – ما أغنى عنه ماله وما

“ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দু’হাত এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও। তার ধন-সম্পদ ও তার উপার্জন তার কোন কাজে আসেনি। অচিরে সে দগ্ধ হবে লেলিহান আগুনে এবং তার স্ত্রীও যে ইন্ধন বহন করে, তার গলদেশে পাকান রজ্জু।” (১১১:১-৫)

রাসুল সাঃ এর জীবনী :- সীরাতে ইবনে হিশাম - ২য় খণ্ড - রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর তাঁর সম্প্রদায়ের নির্যাতন- সীরাতুন্ নবী (সা.) - ইবনে হিশাম (র.)
Sirat Un Nabi – Ibn Hisham

ইবন হিশাম বলেন অর্থ গলদেশ আশা ইব্‌ন কায়স ইবন সা’লাবা তার একটি কবিতায় বলেন :

“কুতায়লা যেদিন কণ্ঠহার পরে তার দীর্ঘ গ্রীবা নিয়ে আমাদের সামনে হাযির হয়েছিল।”

এক প্রকার গাছ, যা তুলার মত ধুনে রশি তৈরি করা হয়। নাবিগা যুবয়ানী তার একটি দীর্ঘ কবিতায় বলেন :

مقذوفة يدخيس التحض بازلها × له صريف صريف القعو باك

“সে এক হৃষ্টপুষ্ট গরু। তার গোশত কানায় কানায় পূর্ণ। তার দাঁত কাটার শব্দ যেন ঠিক রশি তৈরিকালে চরকা চালানোর আওয়ায ।”

শব্দটি একবচনে ব্যবহৃত হয়। নাবিগার আসল নাম যিয়াদ ইব্‌ন আমর ইবন মু’আবিয়া।

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

উম্মু জামীলের দুরভিসন্ধি এবং আল্লাহ্ কর্তৃক তার রাসূলের হিফাযত

ইব্‌ন ইসহাক বলেন : আমি শুনেছি, এই ইন্ধন বহনকারিণী উম্মু জামীল তার ও তার স্বামীর সম্পর্কে অবতীর্ণ কুরআনের আয়াত শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হল। সে তৎক্ষণাৎ একখণ্ড পাথর নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উদ্দেশ্যে ছুটে আসল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তখন আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-কে সংগে নিয়ে কা’বা শরীফের পাশে উপবিষ্ট ছিলেন। উম্মু জামীল তাঁদের সামনে এসে দাঁড়াতেই আল্লাহ্ তা’আলা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে তার দৃষ্টির আড়াল করে দিলেন। ফলে সে কেবল আবূ বকর (রা)-কেই দেখতে পেল। সে জিজ্ঞেস করল :

হে আবূ বকর ! তোমার সঙ্গী কই ? আমি শুনেছি, সে নাকি আমার কুৎসা করে। আল্লাহর কসম ! এই মুহূর্তে তাকে পেলে আমি এই পাথর তার মুখে ছুঁড়ে মারতাম। শোন, আমিও কিন্তু একজন কবি। তখন সে বলল:

“আমরা এক নিন্দিত ব্যক্তির নাফরমানী করেছি, আমরা তার নির্দেশ অমান্য করেছি এবং আমরা তার দীনকে ঘৃণা করি।”

এই বলে সে চলে গেল। আবূ বকর (রা) বললেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্ (সা) ! সেকি আপনাকে দেখেনি ? তিনি বললেন : না, সে আমাকে দেখেনি। আল্লাহ্ তার দৃষ্টি থেকে আমাকে আড়াল করে দেন।

ইবন হিশাম বলেন : লাইনটি ইব্‌ন ইসহাক ভিন্ন অপর সূত্রে প্রাপ্ত ।
ইবন ইসহাক বলেন : কুরায়শরা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে মুযাম্মাম (নিন্দিত) নাম দিয়ে গালমন্দ করত। তিনি বলতেন: তোমরা কি আশ্চর্যবোধ কর না যে, আল্লাহ্ তা’আলা আমার থেকে কুরায়শদের গালমন্দ কিভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। তারা গালমন্দ করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত)-কে, আর আমি হচ্ছি ‘মুহাম্মদ’ (প্রশংসিত)।

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

উমাইয়া ইব্‌ন খাল্‌ফ কর্তৃক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্যাতন প্রসঙ্গে

উমাইয়া ইবন খাল্‌ফ ইব্‌ন ওয়াহব ইবন হুযাফা ইব্‌ন জুমাহ রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দেখামাত্রই উচ্চঃস্বরে গালমন্দ ও নিম্নস্বরে নিন্দাবাদ করত। আল্লাহ্ তা’আলা তার সম্পর্কে নাযিল করেন :

ويل لكل همزة لمزة – – الذي جمع ما لا وعدده – يحسب أن ما له أخلدة – كلا ليسيدن في الحطمة – وما أدرك ما الحطمة – نار الله الموقدة التي تطلع على الأفئدة – انها عليهم مؤصدة –

في عمد ممددة –

“দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে; যে অর্থ জমায় ও তা বারবার গণনা করে, সে ধারণা করে যে, তার অর্থ তাকে অমর করে রাখবে; কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায় হুতামা কী, তা তুমি কি জান? তা আল্লাহর প্রজ্জ্বলিত হুতাশন, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে; নিশ্চয়ই তা তাদেরকে পরিবেষ্টন করে রাখবে দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে।” (১০৪:১-৯)

ইবন হিশাম বলেন : যে ব্যক্তি মানুষকে প্রকাশ্যে গালাগাল করে, চোখ পাকায় ও কটাক্ষ করে। এ প্রসংগে হাসসান ইব্‌ন সাবিত (রা) তাঁর একটি গীতি কবিতায় বলেন :

همزتك فاختضعت لذل نفس × بقافية تاجج كالشواظ

“আমি লেলিহান অগ্নিতুল্য ছন্দ দ্বারা তোমার প্রতি কটাক্ষ করি; ফলে, তুমি স্বীয় হীনতাবশত বশ্যতা স্বীকার করেছ।”

এর অর্থ এমন ব্যক্তি যে পশ্চাতে অন্যের দোষ চর্চা করে ও তাদের কষ্ট দেয়। রূ’বা ইব্‌ন আজ্জাজ তার একটি কবিতায় বলেন :

في ظل عصری باطلی ولمزي

“আমার অসার বাক্য এবং আমার নিন্দাবাদ, আমার সময়ের ছায়ায় লালিত হয়েছে।”

সূরা বাকারা আয়াত ১৮৪

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী :  সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

আস ইব্‌ন ওয়াইল কর্তৃক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপহাস এবং তার সম্পর্কে অবতীর্ণ আয়াত

ইব্‌ন ইসহাক বলেন এরূপ আরেকজন দূরাচার হচ্ছে ‘আস ইব্‌ন ওয়ায়ল সাহমী। রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অন্যতম সাহাবী খাব্বাব ইব্‌ন আরাত (রা) ছিলেন একজন কর্মকার। তিনি মক্কায় তরবারি বানাতেন। একবার তিনি ‘আস ইব্‌ন ওয়ায়লের কাছে কয়েকটি তরবারি বিক্রি করেন। তার নির্দেশেই তিনি সেগুলো তৈরি করেছিলেন। একদিন তিনি তার কাছে সে টাকার তাগাদা দিতে গেলে আস বলল:

হে খাব্বাব! তুমি যার দীনের অনুসারী, তোমার সেই সাথী মুহাম্মদ কি বলে না যে, যারা জান্নাতে যাবে, তারা সেখানে যত খুশি সোনা-রূপা, পোশাক-পরিচ্ছদ ও চাকর-বাকর লাভ করবে? খাব্বাব বললেন : বটেই তো। তখন সে বলল:

তা হলে তুমি হে খাব্বাব! আমাকে কিয়ামত পর্যন্ত সময় দাও। সেখানে গিয়ে আমি তোমার পাওনা শোধ করে দেব। আল্লাহর কসম, হে খাব্বাব! তুমি ও তোমার সাথী আল্লাহর নিকট আমার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পাবে না এবং সেখানেও আমার চেয়ে বেশি বেহেশতী নিয়ামত পাবে না। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেন :

وترثة ما يقول أفرأيت الذي كفر بأيتنا وقال لأوتين مالاً وولدا – أطلع الغيب

ويأتين فردا –

“তুমি কি লক্ষ্য করেছ তাকে, যে আমার আয়াতসমূহ প্রত্যাখ্যান করে এবং বলে, আমাকে ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি দেওয়া হবেই। সে কি অদৃশ্য সম্বন্ধে অবহিত হয়েছে অথবা দয়াময়ের নিকট হতে প্রতিশ্রুতি লাভ করেছে ? কখন-ই নয়, তারা যা বলে, আমি তা লিখে রাখব এবং তাদের শাস্তি বৃদ্ধি করতে থাকব। সে যে বিষয়ের কথা বলে, তা থাকবে আমার অধিকারে এবং সে আমার নিকট আসবে একা।” (১৯ : ৭৭-৮০ )

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী :  সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

আবূ জাহল কর্তৃক রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উৎপীড়ন এবং তার সম্পর্কে অবতীর্ণ আয়াত

আমি শুনেছি একবার আবূ জাহল ইবন হিশাম রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে বলল:

হে মুহাম্মদ! তুমি আমাদের দেবদেবীদের গালমন্দ করা বন্ধ কর, অন্যথায় আমরাও তোমার ইলাহের গালমন্দ করব, যার ইবাদত তুমি কর। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তার সম্পর্কে নাযিল করেন:

“আল্লাহকে ছেড়ে যাদের তারা ডাকে, তাদের তোমরা গালি দিও না, কেননা তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে।” (৬:১০৮)

বর্ণিত আছে, এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের দেবদেবীদের নিন্দা করা হতে বিরত হন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করতে থাকেন।

নাযর ইবন হারিস কর্তৃক রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নির্যাতন এবং তার সম্পর্কে অবতীর্ণ আয়াত

রাসূলুল্লাহ্ (সা)-কে উত্যক্তকারীদের মধ্যে আরেকজন হচ্ছে না ইবন হারিস ইবন ‘আলকামা ইবন কালুদা ইবন ‘আব্দ মানাফ ইবন ‘আবদুদ্দার ইবন কুসাই। রাসূলুল্লাহ্ (সা) যখনই কোন মজলিসে মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান জানাতেন, কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন এবং কুরায়শদের বিগত ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের ইতিহাস দ্বারা সতর্ক করে মজলিস ত্যাগ করতেন, তখন নাযর ইবন হারিস উঠে সে মজলিসের লোকদের পারস্য বীর রুস্তম, ইসফানদিয়ার ও ইরানী রাজা-বাদশাহদের কাহিনী বর্ণনা করে শোনাত। সে বলত,

আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ আমার চাইতে ভাল বর্ণনাকারী নয়। তার বর্ণনা তো অতীত যুগের উপকথা মাত্র। তার মত আমিও সেগুলো লিখে রেখেছি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেন :

“তারা বলে ‘এগুলো তো সেকালের উপকথা, যা সে লিথে নিয়েছে; এগুলো সকাল-সন্ধ্যা তার নিকট পাঠ করা হয়।’ বল, ‘এটা তিনিই অবতীর্ণ করেছেন, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সমুদয় রহস্য অবগত আছেন; তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (২৫ : ৫-৬)

আরও নাযিল হয় : “তার নিকট আমার আয়াত আবৃত্তি করা হলে সে বলে, এ তো সেকালের উপকথা মাত্র।”

“দুর্ভোগ প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী পাপীর, যে আল্লাহর আয়াতের আবৃত্তি শোনে অথচ ঔদ্ধত্যের সংগে অটল থাকে যেন সে তা শোনেনি। তাকে সংবাদ দাও মর্মন্তুদ শাস্তির (৪৫ : ৭-৮)

ইবন হিশাম বলেন : ঘোর মিথ্যাবাদী।

সূরা মুমিনূন

কুরআন মজীদে আছে :
“দেখ তারা তো মনগড়া কথা বলে যে, আল্লাহ্ সন্তান জন্ম দিয়েছেন। তারা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী।” (৩৭ : ১৫১-১৫২)

রু’বা ইবন ‘আজ্জাজ তাঁর এক কবিতায় বলেন: “কোন মানুষের মিথ্যা রটনায় কি লাভ”।

ইব্ন ইসহাক বলেন : আমি শুনেছি, একদা রাসূলুল্লাহ (সা) ওয়ালীদ ইবন মুগীরার সাথে মসজিদে বসে ছিলেন। এ সময় না ইবন হারিস সেখানে উপস্থিত হয় এবং মজলিসে তাদের সাথে বসে পড়ে। সেখানে কুরায়শ গোত্রের লোক উপস্থিত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাদের সাথে আলোচনা শুরু করলেন। নাযর ইবন হারিস আলোচনায় তাঁর সঙ্গে তর্ক শুরু করে দিলে রাসূলুল্লাহ্ (সা) তাকে নিরুত্তর করে দিতে সক্ষম হন। এরপর তিনি তাদের সকলের উদ্দেশ্যে তিলাওয়াত করেন

“তোমরা এবং আল্লাহর পরিবর্তে তোমরা যাদের ইবাদত কর, সেগুলো তো জাহান্নামের ইন্ধন; তোমরা সকলে তাতে প্রবেশ করবে। যদি তারা ইলাহ হত তবে তারা জাহান্নামে প্রবেশ করত না; তাদের সকলেই তাতে স্থায়ী হবে। সেথায় থাকবে তাদের আর্তনাদ এবং সেথায় তারা কিছুই শুনতে পাবে না।” (২১ : ৯৮-১০০)

ইবন হিশাম বলেন। আগুন জ্বালানোর উপকরণ।
আবূ যুওয়ায়ব যুওয়ায়লিদ ইবন খালিদ হুযালী বলেন:

“সুতরাং তুমি আগুন নিভাও, তা প্রজ্বলিত করে তুমি তার ইন্ধন হয়ো না। কেননা, শত্রুর আগুনের লেলিহান শিখা তোমাকেও গ্রাস করবে।”

এটা আবূ যুওয়ায়বের একটি কবিতার অংশবিশেষ।

অপর এক কবি বলেন :

“আমি তার জন্য আগুন জ্বালিয়েছি, ফলে সে তার আলোকচ্ছটা দেখেছে। ঐ আগুনের আলো না হলে সে পথের দিশা পেত না।”

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী :  সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

ইব্ন যাবা’রীর উক্তি এবং তার সম্পর্কে অবতীর্ণ আয়াত

ইন ইসহাক বলেন : তাদেরকে উল্লিখিত আয়াত শুনিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মজলিস ত্যাগ করলেন। এ সময় সেখানে আবদুল্লাহ ইবন যাবা’রী সাহমী এসে উপস্থিত হল। সে অন্যদের সাথে মজলিসে আসন গ্রহণ করল। ওয়ালীদ ইবন মুগীরা তাকে লক্ষ্য করে বলল : আল্লাহর কসম! আবদুল মুত্তালিবের সন্তান এইমাত্র নাযর ইবন হারিসকে নির্বাক করে দিয়েছে। মুহাম্মদ দাবি করে বলে আমরা এবং আমরা যাদের উপাসনা করি, সকলেই জাহান্নামের ইন্ধন হব। একথা শুনে আবদুল্লাহ্ ইবন যাবারী বলল : দেখ আমি যদি তাকে পেতাম, তবে নির্ঘাত হারিয়ে দিতাম।

তোমরা গিয়ে মুহাম্মদকে জিজ্ঞেস কর, আল্লাহ্ ছাড়া যাদেরই ইবাদত করা হয়, সকলেই কি উপাসকদের সাথে জাহান্নামী হবে? আমরা তো ফেরেশতাদেরও উপাসনা করি। অনুরূপ ইয়াহুদীরা হযরত উযায়র (আ)-এর এবং নাসারা সম্প্রদায় ‘ঈসা ইবন মারইয়াম (আ)-এর পূজা করে। এ উত্তর শুনে ওয়ালীদ এবং মজলিসের অন্যরা খুবই খুশি হল।

তারা ভাবল, ইবন যাবারীর এ প্রতিউত্তরে মুহাম্মদ (সা)-এর পরাজয় অনিবার্য। তার এ উক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উত্থাপন করা হল। তিনি বললেন : আল্লাহ ছাড়া আর যে-কেউ এটা ভালবাসে যে তার উপাসনা করা হোক, সে অবশ্যই উপাসকের সাথে জাহান্নামী হবে। তারা তো কেবল শয়তানদেরই পূজা করে। আর করে তাদের পূজা, যারা তাদের উপাসনা করতে বলে। এ প্রসঙ্গেই আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেন :

“যাদের জন্য আমার নিকট হতে আগে থেকেই কল্যাণ নির্ধারিত রয়েছে তাদের তা থেকে দূরে রাখা হবে। তারা তার ক্ষীণতম শব্দও শুনবে না এবং সেথায় তারা তাদের মন যা চায়, চিরকাল তা ভোগ করবে।” (২১ : ১০১-১০২)

এ আয়াতে ঈসা ইবন মারইয়াম (আ) ও উমায়র (আ)-কে বোঝানো হয়েছে। অনুরূপ সেইসব ইয়াহুদী ধর্মশাস্ত্রবিদ (আহবার) ও খ্রিস্টান ধর্মযাজক (রাহিব)-ও এর অন্তর্ভুক্ত, যারা আল্লাহ তা’আলার আনুগত্যে জীবন নির্বাহ করেছেন, কিন্তু পরবর্তীকালের বিভ্রান্ত সম্প্রদায়গুলো তাদেরকে আল্লাহর স্থলে রব ঠাউরে নিয়েছে এবং তাদের পূজা-অর্চনায় লিপ্ত হয়েছে।

তারা বলত: তারা ফেরেশতাদের পূজা করে এবং ফেরেশতারা আল্লাহর কন্যা। এ সম্পর্কে আল্লাহ্ নাযিল করেন

“তারা বলে, দয়াময় (আল্লাহ্) সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র, মহান! তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কথা বলে না; তারা তো তাঁর আদেশ অনুসারেই কাজ করে। থাকে। তাদের সামনে ও পেছনে যা কিছু আছে তা তিনি অবগত। তারা সুপারিশ করে শুধু তাদের জন্য, যাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের মধ্যে যে বলবে, ‘আমি-ই ইলাহ তিনি (আল্লাহ্) ব্যতীত’, তাকে আমি প্রতিফল দেব জাহান্নাম; এভাবেই আমি যালিমদের শাস্তি দিয়ে থাকি।” (২১ : ২৬-২৯)

আবদুল্লাহ্ ইবন যাবা’রী-এর এ উক্তি যে, আল্লাহ ব্যতীত ঈসা ইবন মারইয়াম (আ)-এরও পূজা-অৰ্চনা করা হয়, যা শুনে ওয়ালীদ ও উপস্থিত শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে যায় এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিরুদ্ধে এটাকে অপ্রতিরোধ্য আক্রমণ বলে মনে করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেন: “যখন মারইয়াম-তনয়ের দৃষ্টান্ত উপস্থিত করা হয়, তখন তোমার সম্প্রদায় শোরগোল আরম্ভ করে দেয়।” (৪৩:৫৭)

তারপর ঈসা (আ) সম্পর্ক বলা হচ্ছে:
“সে তো ছিল আমারই এক বান্দা, যাকে আমি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং করেছিলাম বনী ইসরাঈলের জন্য দৃষ্টান্ত। আমি ইচ্ছা করলে তাদের মধ্য হতে ফেরেশতা সৃষ্টি করতে পারতাম, যারা পৃথিবীতে উত্তরাধিকারী হত। ঈসা তো কিয়ামতের নিদর্শন; সুতরাং তোমরা কিয়ামতে সন্দেহ পোষণ করো না এবং আমাকে অনুসরণ কর। এটাই সরল পথ।” (৪৩: ৫৯-৬১)

অর্থাৎ মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করা, রুগ্নকে সুস্থ করা সহ যে সকল নিদর্শন আমি তার হাতে তুলে দিয়েছি, কিয়ামতের সত্যতা উপলব্ধি করার জন্য সেগুলো প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

আখনাস ইব্‌ন শারীক ও তার সম্পর্কে আল্লাহ্ যা নাযিল করেন

ইবন ইসহাক বলেন : অপর একজন নির্যাতনকারী হচ্ছে আখনাস ইবন শারীক ইবন ‘আমর ইবন ওয়াহব সাকাফী। সে ছিল যুহরা গোত্রের মিত্র এবং স্বগোত্রের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। গোত্রের সকলে তার কথা শুনত। সে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিন্দা করে বেড়াত এবং তাঁর প্রচার খণ্ডন করত। আল্লাহ্ তা’আলা তার সম্পর্কে সূরা কালামের এ আয়াতগুলো নাযিল করেন।

অর্থ : “তুমি অনুসরণ কর না তার যে কথায় কথায় শপথ করে, যে লাঞ্ছিত, পশ্চাতে নিন্দাকারী, যে একের কথা অপরের নিকট লাগিয়ে বেড়ায়, যে কল্যাণকার্যে বাধা দান করে যে সীমালংঘনকারী, পাপিষ্ঠ, রূঢ় স্বভাব এবং তদুপরি কুখ্যাত ।” (৬৮ : ১০-১৩)

এখানে এ শব্দটি জারজ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। কেননা আল্লাহ কারও পিতৃ-পরিচয় নিয়ে নিন্দা করেন না। বস্তুত এ বিশেষণ উল্লেখপূর্বক আল্লাহ্ তা’আলা তার পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছেন। অর্থ যে নিজ বংশে অপরিচিত, তবে অন্য গোত্রের পরিচয়ে পরিচিত। জাহিলী যুগের কবি খাতীম তামীমীর কবিতায় আছে:

“সে অন্য গোত্রের লোক, কিন্তু এ গোত্রের পরিচয়ে পরিচিতি। লোকে তাকে ফালতু বলেই জানে। সে যেন পায়ের তলার চামড়া, যাকে বাড়তি ধরে অন্য চামড়ার সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়।”

 

সূরা মুমিনূন

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

ওয়ালীদ ইবন মুগীরা এবং তার সম্পর্কে আল্লাহ্ যা নাযিল করেন

অন্য একজন নির্যাতনকারী হচ্ছে ওয়ালীদ ইবন মুগীরা। সে বলত, মুহাম্মদের প্রতি ওহী নাযিল হবে, আর আমি বাদ যাব; যেখানে আমি কুরায়শ গোত্রের একজন সরদার ও সর্বজনমান্য নেতা ? কিংবা অপসন্দ করা হবে সাকীফ গোত্রের অধিপতি আবূ মাসউদ ‘আমর ইবন ‘উমায়কে? আমরা দু’জন হচ্ছি মক্কা ও তায়ষ্ণের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা সূরা যুখরূফের এ আয়াত দু’টি নাযিল করেন।

অর্থ : “এবং এরা বলে, “এই। কুরআন কেন অবতীর্ণ হল না দুই জনপদের কোন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির উপর ? এরা কি তোমার প্রতিপালকের করুণা বন্টন করে ? আমিই তাদের মধ্যে জীবিকা বন্টন করি তদের পার্থিব জীবনে এবং একজনকে অপরের উপর মর্যাদায় উন্নত করি, যাতে একে অপরের দ্বারা কাজ করিয়ে নিতে পারে, এবং তারা যা জমা করে তা হতে তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহ উৎকৃষ্টতম।” (৪৩ : ৩১-৩২)

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

উবায় ইবন খাল্‌ফ ও উক্‌বা ইব্‌ন আবূ মু’আয়ত এবং তাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ যা নাযিল করেন

রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর উপর অপর দুজন নির্যাতনকারী ব্যক্তি হচ্ছে—উবায় ইবন খাল্ফ ইবন ওয়াহব ইবন হুয়াফা ইবন জুমাহ ও ‘উকবা ইবন আবূ মু’আয়ত। তারা ছিল একে অপরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। একবার উকবা রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর মজলিসে বসে তাঁর কথা শুনেছিল। একথা উবায়-এর কানে পৌঁছায়। সে তখন উকবার কাছে এসে বলল:

আমি কি শুনিনি, তুমি মুহাম্মদের সাথ ওঠাবসা কর এবং তার কথা শোন ? আমি যদি তোমার সাথে কথা বলি, তবে আমার জন্য তোমার চেহারা দেখা হারাম। সে একটা কঠিন শপথ করে বলল : যদি তুমি তাঁর কাছে বস, বা তাঁর কথা শোন, তবে তাঁর মুখে থুথু মেরে আসতে হবে।

আল্লাহর দুশমন “উকবা এ ঘৃণ্য কাজটি সম্পন্ন করে। আল্লাহ তাকে লা’নত করুন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেন :

“যালিম ব্যক্তি সেদিন নিজের দু’হাত দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায়, ‘দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকট উপদেশ পৌঁছাবার পর। শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।” (২৫ : ২৭-২৯)

একদিন উবায় ইবন খালফ একখণ্ড জরাজীর্ণ হাড় নিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট উপস্থিত হল। সে বলল: হে মুহাম্মদ! তোমার বিশ্বাস আল্লাহ্ তা’আলা এই ক্ষয়প্রাপ্ত অস্থিকেও পূনরুজ্জীবিত করবেন? এই বলে সে অস্থিটিকে হাতের মাঝে গুড়োগুড়ো করে ফেলল এবং তা ফুঁ দিয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর দিকে উড়িয়ে দিল। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন : হ্যাঁ, আমি তাই বলি। আল্লাহ তা’আলা এর পুনরুত্থান ঘটাবেন এবং তোমারও এরূপ অবস্থা হওয়ার পর আল্লাহ তোমাকেও পুনরায় জীবিত করে তোমাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। এ সময় আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেন :

“এবং সে আমার সম্বন্ধে উপমা রচনা করে অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়; বলে, “অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করবে কে, যখন তা পঁচে গলে যাবে ?’ বল, তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই, যিনি তা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।’ তিনি তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ হতে অগ্নি উৎপাদন করেন এবং তোমরা তা দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত কর।” (৩৬: ৭৮-৮০)

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

সূরা কাফিরূনের শানে নুযূল

একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা) কা’বার তাওয়াফ করছিলেন। এমন সময় আসওয়াদ ইবন মুত্তালিব ইবন আসাদ ইবন ‘আবদুল উয়্যা, ওয়ালীদ ইবন মুগীরা, উমাইয়া ইবন খালফ ও আস ইবন ওয়ায়ল সাহমী তাঁকে ঘিরে ধরল। তারা ছিল নিজ নিজ গোত্রের প্রবীণ ব্যক্তি। তারা বলল:

হে মুহাম্মদ! আচ্ছা এসো, আমরা তাঁর ইবাদত করি, যাঁর ইবাদত তুমি কর এবং তুমিও তাদের ইবাদত কর, যাদের ইবাদত আমরা করি। এভাবে তুমি এবং আমরা একে অন্যের দীনে। শরীক হয়ে যাই যদি আমাদের উপাস্যদের চেয়ে তোমার উপাস্য উত্তম হন, তবে আমরা তার ইবাদত করে ধন্য হব, আর যদি তোমার উপাস্য অপেক্ষা আমাদের উপাস্যগণ শ্রেষ্ঠ হয়, তবে তাদের পূজা করে তুমিও ধন্য হবে। এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা’আলা নাযিল করেন :

“বলুন, “হে কাফিররা! আমি তার ইবাদত করি না যার ইবাদত তোমরা কর এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি আর আমিও ইবাদতকারী নই তার, যার ইবাদত তোমরা করে আসছ এবং তোমরাও তাঁর ইবাদতকারী নও, যাঁর ইবাদত আমি করি। তোমাদের দীন তোমাদের, আমার দীন আমার ।” (১০৯ ১-৬)।

অর্থাৎ আমি তোমাদের উপাস্য দেব-দেবীদের পূজা না করলে, তোমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে না এটাই যদি তোমাদের অভিপ্রায় হয়ে থাকে, তাহলে আমার তোমাদের এ ধরনের পূজার কোন প্রয়োজন নেই। তোমাদের দীন তোমাদেরই জন্য এবং আমার জন্য আমার দীন।

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

আবূ জাহ্ল এবং আল্লাহ্ তার সম্পর্কে যা নাযিল করেন

আবূ জাহল ছিল রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর অন্যতম উৎপীড়নকারী। আল্লাহ্ তা’আলা যখন যাককুম বৃক্ষের উল্লেখ করে কাফিরদের ভয় দেখালেন, তখন আবূ জাহল ইবন হিশাম বলল : হে কুরায়শ সম্প্রদায়। মুহাম্মদ তোমাদের যে যাকুম বৃক্ষের ভয় দেখাচ্ছে, তা কি, জান ? তারা বলল: না। সে বলল : তা হচ্ছে মদীনার ‘আজওয়া’ খেজুর, যা মাখন সহকারে খাওয়া যায়। আল্লাহর কসম! আমরা যদি মদীনায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারি, তা হলে এ খেজুর পেটপুরে খাব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা নাযিল করেন :

“নিশ্চয়ই যাকুম বৃক্ষ হবে পাপীর খাদ্য; গলিত তামার মত; তা তার উদরে ফুটতে থাকবে ফুটন্ত পানির মত।” (৪৪:৪৩-৪৬)

অর্থাৎ সে যা বলছে, যাক্কুম বৃক্ষ তা নয় মোটেই। ইবন হিশাম বলেন : অর্থ যে কোন গলিত দ্রব্য, যথা তামা, সিসা ইত্যাদি। আবূ ‘উবায়দা এরূপই বলেছেন।

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

ইব্‌ন মাসউদ (রা) -এর যেভাবে ব্যাখ্যা করেন

হাসান বসরী (র)-এর সূত্রে আমাদের কাছে পৌঁছেছে যে, ‘আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা) কৃষ্ণায় উমর ফারুক (রা)-এর পক্ষ হতে খাজাঞ্চীর দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। একদিন তাঁর নির্দেশে রূপা গলানো হল। সে উত্তপ্ত গলিত রূপা হতে বিচিত্র রং বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন : দরজায় কেউ আছে কি? লোকেরা বলল: আছে। তিনি বললেন তাদের ভিতরে আসতে বল। তারা এলে পরে তিনি বললেন : এই যে গলিত তপ্ত রূপা দেখছ, এটা হচ্ছে এJI-এর একটা তুচ্ছ দৃষ্টান্ত। কোন কবি বলেন :

“আমার রব তাকে গলিত ধাতুর ন্যায় উত্তপ্ত পানীয় পান করাবেন, সে তা অতি কষ্টে গলাধঃকরণ করবে। সে পানীয় তার মুখমণ্ডল ঝলসে দেবে এবং তার পেটের ভেতর টগবগ করে ফুটবে।”

অন্য মতে দেহের গলিত পুঁজ।

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

আবূ বকর (রা)-এর উক্তি দ্বারা ব্যাখ্যা

বর্ণিত আছে যে, আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর মৃত্যু সন্নিকট হলে তিনি তাঁর কাফনের জন্য দু’খানি পুরাতন ব্যবহৃত কাপড় ধুয়ে রাখতে বললেন। আয়েশা (রা) বললেন : আব্বা! আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে তো এত দুরাবস্থায় রাখেন নি। কাজেই কাফনের জন্য নতুন কাপড় কিনে নিলেই হয়। তিনি বললেন: এ দেহ তো ক্ষণিকের জন্য, শেষ পর্যন্ত তো এটা গলিত পুঁজে পরিণত হবে। কোন কবি বলেন :

“তার পুঁতিগন্ধময় পুঁজ পানির সাথে মিশে গেছে, ঐ গলিত পুঁজে তার পিঠ বার বার সিক্ত হয়েছে।”

ইবনে ইসহাক বলেন : আবূ জাহলের উক্ত মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন :

“কুরআনে উল্লিখিত অভিশপ্ত বৃক্ষটিও কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্য। আমি তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন করি, কিন্তু তা তাদের ঘোর অবাধ্যতাই বৃদ্ধি করে।” (১৭: ৬০)

[ রাসুল সাঃ এর জীবনী : সীরাতে ইবনে হিশাম – ২য় খণ্ড]

ইব্‌ন উম্মু মাকতূম (রা) ও তাঁর সম্পর্কে অবতীর্ণ সূরা আবাসা

একদা ওয়ালীদ ইবন মুগীরা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট উপস্থিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) তার সাথে কথা বলছিলেন। তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তিনি আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তাদের এই আলাপ-আলোচনার মাঝখানেই অন্ধ সাহাবী ইবন উম্মু মাকতুম (রা) সেখানে হাযির হন। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন এবং তাঁকে কুরআন শিখিয়ে দিতে অনুরোধ করেন। তাঁর এ আচরণে রাসূলুল্লাহ্ (সা) বিরক্তবোধ করলেন এবং বেজার হলেন।

কারণ ওয়ালীদের ইসলাম গ্রহণে আশাবাদী হয়ে তিনি তার প্রতি মনোসংযোগ করেছিলেন। ইবন উম্মু মাকভূমের কারণে তাতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছিল। এভাবে যখন তিনি বেশি পীড়াপীড়ি শুরু করলেন, তখন তিনি তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং উপেক্ষা করলেন। তখন আল্লাহ্ তা’আলা হতে এটা পর্যন্ত সূরা ‘আবাসা-এর এ আয়াতগুলো নাযিল করেন।

অর্থ : “তিনি ভ্রুকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন, কারণ তার নিকট অন্ধ লোকটি আসল। আপনি কেমন করে জানবেন সে হয়ত পরিশুদ্ধ হত অথবা উপদেশ গ্রহণ করত, ফলে উপদেশ তার উপকারে আসত। পক্ষান্তরে যে পরওয়া করে না, আপনি তার প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন। অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে আপনার কোন দায়িত্ব নেই। অন্যপক্ষে যে আপনার নিকট ছুটে আসল, আর সে সশংকচিত্ত, আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন; না, এ আচরণ অনুচিত, এ তো উপদেশ বাণী; যে ইচ্ছা করবে সে এটা স্মরণ রাখবে। এটা আছে মহান লিপিসমূহে, যা উন্নত মর্যাদাসম্পন্ন, পবিত্র।” (৮০:১-১৪)

অর্থাৎ হে নবী! আমি তো আপনাকে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি। বিশেষ কারও জন্য আপনি প্রেরিত নন। কাজেই যে হিদায়াত পেতে ইচ্ছুক, তাকে বঞ্চিত করবেন না এবং এ ব্যাপারে যার আগ্রহ নেই, তার প্রতি এত বেশি মনোযোগ দেবেন না।

ইবন হিশাম বলেন : ইবন উম্মু মাক্য (রা) ছিলেন ‘আমির ইবন লুআঈ গোত্রের লোক। আসল নাম ‘আবদুল্লাহ্, কারও মতে আমর।

Leave a Comment