সুহায়েল ইবনে আমর | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

সুহায়েল ইবনে আমর | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-৩, সুহায়েল ইবনে আমর ছিল হুদায়বিয়ার ঘটনার সময় কুরাইশদের দিক থেকে পাঠানো সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি। সে ছিল কুরাইশদের একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ । বদর যুদ্ধের পর নবিজি (সা) কুরাইশদের অভিজাত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কিছু যুদ্ধবন্দিকে নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন; তাদের মধ্যে একজন ছিল এই সুহায়েল।

নবিপত্নী সাওদা সুহায়েলের মতো সম্ভ্রান্ত একজন কুরাইশকে বন্দি অবস্থায় দেখে বলেন, “ও ইয়াজিদের পিতা, তুমি এভাবে আত্মসমর্পণ করলে? যুদ্ধবন্দি হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে কেন তুমি যুদ্ধের ময়দানে সম্মানজনকভাবে মৃত্যুবরণ করলে না?” কুরাইশদের মধ্যে সুহায়েলের মর্যাদার কারণেই তিনি হতবাক হয়ে মুখ ফসকে কথাটি বলে ফেলেছিলেন।

সুহায়েল ইবনে আমর | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

সুহায়েল ইবনে আমর | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

সে ছিল চমৎকার বক্তা; বড় বড় সভায় অনর্গল বক্তৃতা দিতে পারত । তাই তাকে বলা হতো ‘খতিব কুরাইশ’। ইসলামের বিরুদ্ধে তার শক্ত ভাষায় কথা বলার অনেক উদাহরণ রয়েছে। তাই বদরের পর সুহায়েলকে বন্দি অবস্থায় দেখে উমর (রা) বলেছিলেন, “হে আল্লাহর রসুল, আমাকে তার জিহ্বা কেটে ফেলার অনুমতি দিন যাতে সে আর আমাদের বিরুদ্ধে কথা না বলতে না পারে।” নবিজি (সা) জবাবে বলেন, “আমি একজন নবি। মানুষের শরীরকে বিকৃত করার নির্দেশ আমাকে দেওয়া হয়নি। হয়তো একদিন সে এমন কিছু বলবে যা তোমাকে খুশি করবে।”

তর্ক-বিতর্ক কিংবা আপস-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কুরাইশদের মধ্যে সুহায়েলের সমতুল্য আর কেউ ছিল না । এই কারণেই হুদায়বিয়ায় নবিজির (সা) আলোচনার জন্য কুরাইশরা তাকে মনোনীত করেছিল । সেই সময় পর্যন্ত সুহায়েল নিঃসন্দেহে একজন কাফের, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের শত্রু। সে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বদর, ওহুদ ও খন্দকের যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কিন্তু সবকিছুর পরও তার মধ্যে ভালোমানুষি ছিল, কল্যাণকর একটি মন ছিল।

উমর যা চিনতে পারেননি, নবিজি (সা) তা চিনতে পেরেছেন। আল্লাহ কোরানে বলেছেন, “হে নবি, তোমাদের হাতে ধৃত যুদ্ধবন্দিদের বলো, ‘আল্লাহ যদি তোমাদের হৃদয়ে ভালো কিছু দেখেন, তাহলে তোমাদের কাছ থেকে যা (মুক্তিপণ) নেওয়া হয়েছে তার চেয়ে ভালো কিছু তিনি তোমাদের দেবেন ও তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [সুরা আনফাল,৮ঃ৭০] প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সিরাহের শেষের দিকে সুহায়েল ইসলাম গ্রহণ করেন।

সন্দেহ নেই, তাঁর মর্যাদা পূর্ববর্তী ধর্মান্তরিতদের মর্যাদার মতো নয়। তবে ইতিহাসে উল্লেখ আছে, মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে ইবাদতের (নামাজ, রোজা, জাকাত ইত্যাদি) ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ছিলেন সুহায়েল। নবিজির (সা) মৃত্যুর পর তিনি যেভাবে সুদৃঢ় ইমানের পরিচয় দিয়েছিলেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। আমরা জানি, মক্কা বিজয়ের পর মুহাজির ও আনসাররা সবাই মদিনায় ফিরে যান।

সেই সময় মক্কায় বসবাসকারী লোকেরা। ব্যাপক সংখ্যায় ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে । নবিজির (সা) মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ওই নবদীক্ষিত অনেকের মধ্যেই ইসলাম ত্যাগ করার ঝোঁক দানা বাঁধে এবং এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় চলে যায় যে, নবিজি (সা) যে সাহাবিকে মক্কার গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন, তিনি পর্যন্ত প্রাণভয়ে আত্মগোপন করেন।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

সেই বিশৃঙ্খল জনতাকে শান্ত করতে, তাদের মধ্যে স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি ফিরিয়ে আনতে এবং গভর্নরকে আত্মগোপন অবস্থা থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন সুহায়েল ইবনে আমর। তিনি কাবার সামনে দাঁড়িয়ে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে একটি জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন; তিনি তাদের সতর্কতামূলক উপদেশ দিয়ে বলেন, “হে মক্কাবাসী, তোমরা তো ধর্মান্তরিত হওয়া সর্বশেষ দল । এখন ধর্মত্যাগকারী প্রথম দল হয়ো না।”

অনেক বছর পর একদিন সুহায়েল ও আবু সুফিয়ান মদিনায় তৎকালীন খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের (রা) সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। সেখানে বেলাল, সুহায়েব আল-রুমি, ইবনে মাসউদ প্রমুখ এলে খলিফার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষমাণ লোকদের সারিতে সুহায়েল ও আবু সুফিয়ানকে পেছনে রাখা হলো । তা দেখে আবু সুফিয়ান সুহায়েলকে বললেন, “এমন দিন আমার জীবনে আর কখনও আসেনি। আমরা এখানে আছি, আর এই দাসদেরকে আমাদের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।”

জবাবে সুহায়েল বললেন, “আমি তোমার চেহারায় রাগের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। তুমি যদি রাগ করতে চাও, তাহলে নিজের ওপর রাগ করো । কারণ তাঁদের যখন ইসলামের পথে ডাকা হয়েছিল, আমাদেরও তখন ডাকা হয়েছিল । তাঁরা যখন ইসলামের পথে দ্রুত এগিয়ে গিয়েছিল, আমরা তখন পিছিয়ে ছিলাম। ইসলামের পথে সামনে থাকার কারণে যে সম্মানের আসনে তাঁরা সমাসীন, তা আজ উমরের দরজায় আগে প্রবেশ করার সম্মানের চেয়েও অনেক বেশি।” তারপর তিনি বললেন, “তুমি যদি মর্যাদায় তাঁদের স্তরে পৌঁছুতে না পার, তাহলে অন্তত আল্লাহর পথে জেহাদে অংশ নিতে পার, যাতে অন্তত দেখাতে পার যে তুমি তাঁদের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছ।”

পরবর্তী সময়ে সুহায়েল সিরিয়ায় রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি ১৮ হিজরিতে শহিদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করেন। যা-ই হোক, এই মুহূর্তে সুহায়েল ইসলামের একজন ঘোরতর শত্রু। কুরাইশরা তাকে মুসলিম বাহিনীর নেতা মুহাম্মদের (সা) সঙ্গে একটি চুক্তি করার জন্য পাঠিয়েছে। তারা তাকে খুব স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, “আপনি যে কোনো শর্তেই রাজি হতে পারেন, কিন্তু এটা নিশ্চিত করবেন যাতে মুহাম্মদ এই বছর মক্কায় প্রবেশ না করে; কারণ আরবরা যেন না বলতে পারে যে, সে আমাদের চেয়ে শক্তিশালী ।”

 

সুহায়েল ইবনে আমর | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-৩ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

সুহায়েল ইবনে আমরের দুই পুত্র

সুহায়েলের দুই ছেলেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের ইসলাম গ্রহণের কারণে সুহায়েল ও তাঁর পরিবারকে কুরাইশদের অনেক লাঞ্ছনা সইতে হয়েছে। বড় ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে সুহায়েল তাঁর ইসলাম গ্রহণের বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন, কারণ পিতার সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব চলছিল এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর মুসলিম পরিচয় প্রকাশ পেলে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে। বদরের যুদ্ধের সময় আবদুল্লাহর মদিনায় যাওয়ার সুযোগ আসে।

তিনি স্বেচ্ছাসেবক সেজে সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে কুরাইশদের সঙ্গে মদিনায় তাদের প্রথম শিবির পর্যন্ত যান। সেখান থেকে একটি ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে গিয়ে সোজা গিয়ে মুসলিমদের দলে যোগ দেন। তারপর কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কল্পনা করুন, এ নিয়ে মক্কায় সুহায়েলকে কতটা লজ্জা ও সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল! আবদুল্লাহ মদিনায় চলে যাওয়ার পর তাঁর ছোট ভাই আবু জান্দাল ইবনে সুহায়েলও ইসলাম গ্রহণ করেন।

সুহায়েলের কাছে খুব তাড়াতাড়িই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তার ছোট ছেলেও একজন মুসলিম। সে আবু জান্দালকে অন্ধকূপে আটকে রাখার জন্য তার চাকরদের নির্দেশ দেয়। সেখানে ছেলেকে অনেক নির্যাতন করে, এমনকি তাঁকে ঠিকমতো খাবার ও পানি দেওয়া থেকেও বঞ্চিত রাখে। বদর যুদ্ধ থেকে এখন (হুদায়বিয়ার ঘটনা) পর্যন্ত চার বছরেরও বেশি পার হয়ে গেছে । আবু জান্দাল এই সময় পর্যন্তও শৃঙ্খলিত ।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment