নবিজিকে (সা) হত্যার চেষ্টা | বদর ও ওহুদের মাঝে সংঘটিত ঘটনা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

নবিজিকে (সা) হত্যার চেষ্টা | বদর ও ওহুদের মাঝে সংঘটিত ঘটনা, বদরের যুদ্ধের পরে মক্কার কুরাইশদের দিক থেকে নবি করিমকে (সা) হত্যার চেষ্টা হয়। ইবনে হিশাম ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেছেন: উমাইয়া ইবনে খালাফের পুত্র সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া এবং তার কাজিন উমায়ের ইবনে ওয়াহাব আল-জুমাহি একদিন বসে নিজেদের মধ্যে আলাপ করছিল। সাফওয়ানের পিতা ও ভাই সবেমাত্র বদরের যুদ্ধে মারা গেছে। অন্যদিকে উমায়েরের পুত্র মদিনায় যুদ্ধবন্দি অবস্থায় ছিল, কিন্তু পুত্রের জন্য মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য তার ছিল না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, উমায়ের হচ্ছে সেই ব্যক্তি যাকে আবু জেহেল বদরের যুদ্ধের দিন সকালে মুসলিম বাহিনীর খবর নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছিল।

 

নবিজিকে (সা) হত্যার চেষ্টা | বদর ও ওহুদের মাঝে সংঘটিত ঘটনা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

নবিজিকে (সা) হত্যার চেষ্টা | বদর ও ওহুদের মাঝে সংঘটিত ঘটনা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

দুজনের আলাপের একপর্যায়ে সাফওয়ান নবিজি (সা) সম্পর্কে কটূক্তি ও সমালোচনা করে বলল: এই নতুন ধর্মই সব সমস্যা সৃষ্টি করছে।

উমায়ের: আল্লাহর কসম! আমার যদি অনেক ঋণ না থাকত, আর পরিবারকে দেখভাল করার দায়িত্ব না থাকত, তাহলে আমি নিজে মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদকে হত্যা করে আসতাম। কারণ, সে আমার পরিবারকে ধ্বংস করেছে এবং আমার পুত্রকে বন্দি করে রেখেছে।

সাফওয়ান: আমি তোমার ঋণ শোধ করব; তোমার পরিবারকে সেইভাবে দেখভাল করব যেভাবে নিজের পরিবারকে দেখভাল করি। আমি এই প্রতিশ্রুতি দিলে কি তুমি এই কাজ করতে রাজি হবে?

উমায়ের: হ্যাঁ, কিন্তু এ বিষয়ে তুমি কাউকে কিছু বলতে পারবে না। এই আলোচনা শুধু আমাদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

উমায়ের আর দেরি না করে বাড়ি গিয়ে তার তলোয়ার ধার দিল এবং তাতে কিছু বিষও লাগিয়ে নিল। তারপর সে কাউকে কিছু না জানিয়ে মক্কা ত্যাগ করল। সে দ্রুততম সময়ের মধ্যে মদিনায় পৌঁছে ছদ্মবেশ ধারণ করল: মুখ ঢেকে ঘাড়ের  পাশ দিয়ে তার তলোয়ারটি ঝুলিয়ে রাখল। সে এই বেশে নবিজির (সা) মসজিদের দিকে যাচ্ছিল, পথিমধ্যে উমর (রা) তার চোখ দেখে তাকে চিনতে পারলেন। উমর মনে মনে বললেন, “এই কুকুর তো আল্লাহর শত্রু! সে নিশ্চয় কোনো বদ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছে!” তিনি সঙ্গে সঙ্গে নবিজির (সা) কাছে গিয়ে বললেন, “উমায়ের ইবনে ওয়াহাব এখন এই শহরেই আছে এবং সে আপনাকে খুঁজছে।” শুনে নবিজি বললেন, “তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।” উমর তৎক্ষণাৎ নিজের তলোয়ার নিয়ে বেরিয়ে গেলেন এবং উমায়েরকে সঙ্গে নিয়ে মসজিদে প্রবেশ করলেন।

নবিজি (সা) উমায়েরকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিলেও উমরকে বলে রেখেছিলেন, “তার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রেখো, কারণ এই বদ লোকটিকে বিশ্বাস করা যাবে না।” তাই উমর তলোয়ার নিয়ে প্রস্তুত ছিলেন, যাতে প্রয়োজন হলে তিনি নবিজিকে (সা) রক্ষা করতে পারেন। উমায়ের মসজিদে প্রবেশ করেই নবিজিকে (সা) জাহেলি রীতিতে অভিবাদন জানাল: ‘ইনআম সাবাহা’ (শুভ সকাল) ।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

নবিজি (সা): আল্লাহ আমাদের আরও উত্তম একটি অভিবাদন দান করেছেন যা জান্নাতবাসীদের অভিবাদন; আর তা হলো ‘সালাম’। উমায়ের। এই কথা আমার কাছে নতুন লাগছে, আমি আগে কখনও শুনিনি ।

নবিজি (সা): তুমি এখানে কেন এসেছ? উমায়ের: আমার পুত্রের মুক্তিপণের ব্যাপারে আলোচনা ও দরকষাকষি করতে

এসেছি যাতে তুমি তার কোনো ক্ষতি না করে তাকে আমার সঙ্গে যেতে দাও । নবি’জি (সা): যদি তা-ই হয়, তাহলে তোমার ঘাড়ে এই তলোয়ারটি ঝুলছে কেন? উমায়ের। এই তলোয়ার? বদরে এটি আমাদের কী কাজে এসেছিল? (অর্থাৎ বদরে তো এটি আমাদের কোনো কাজে লাগেনি ।)

নবিজি (সা): আমাকে সত্য কথা বলো। উমায়ের: আমি তো বললামই আমি আমার ছেলের জন্য এসেছি।

নবিজি (সা) এবার সত্যটা প্রকাশ করলেন (যা জিব্রাইল (আ) নিশ্চয়ই তাকে বলে গেছেন); তিনি বললেন, “তুমি যা বলছ তা সত্য নয়, বরং তুমি ও সাফওয়ান কাবার ঠিক বাইরে বসে বদরের যুদ্ধে তোমাদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করছিলে। তুমি তাকে বলেছিলে, তোমার কাঁধে ঋণের বোঝা এবং পরিবারকে দেখভাল করার দায়িত্ব না থাকলে তুমি নিজে আমাকে (মুহাম্মদকে) হত্যা করতে। তখন সাফওয়ান তোমার ঋণ পরিশোধ ও পরিবারের যত্ন নেওয়ার প্রস্তাব দেয়, যাতে তুমি আমাকে হত্যা করতে আস। কিন্তু আল্লাহ স্বয়ং তোমার ও তোমার পরিকল্পনার মাঝে বাদ সেধেছেন। ” এবার উমায়েরের অবাক হবার পালা। সে নিশ্চিত ছিল যে নবি’জির (সা) পক্ষে তার ও সাফওয়ানের মধ্যেকার কথোপকথন জানার কোনো সুযোগ ছিল না।

সে তো কাউকে কিছুই বলেনি, এমনকি তার স্ত্রীও জানত না সে কোথায় যাচ্ছে। সে দ্রুততম রাস্তা দিয়ে মক্কা থেকে মদিনা এসেছে। তার চেয়ে বেশি দ্রুত কেউ মদিনা এলে সেটা সে অবশ্যই জানত। আল্লাহ না জানালে নবিজির (সা) পক্ষে কোনোভাবে এই খবর জানা সম্ভব ছিল না। উমায়েরের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। সে তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনিই আল্লাহর রসুল।”

ইসলাম যে সত্য ধর্ম তা মক্কার মুশরিকদের অনেকের কাছেই পরিষ্কার ছিল না। আবু জেহেলের মতো কিছু লোক বুঝতে পারলেও বেশিরভাগই মুশরিকই তা বুঝত না। ফলে তারা ইসলামকে মিথ্যা বলে বিশ্বাস করত এবং তার বিরোধিতা করত। তখনকার যেসব লোক নবিজির (সা) সরাসরি সংস্পর্শে এসেছে তাদেরই যদি ইসলামের সত্যতা বোঝার ক্ষেত্রে এমন অবস্থা হয়, তাহলে এখনকার লোকদের অবস্থা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা যা শোনে তা-ই বিশ্বাস করে। মুসার (আ) যুগেও ফেরাউনের জাদুকররা নিজের চোখে অলৌকিক ঘটনা দেখার পরই ধর্মান্তরিত হয়েছিল [৭:১০৪-১২২]।

লক্ষ করুন, যে ব্যক্তি নবি’জিকে (সা) তলোয়ার দিয়ে আঘাত করার জন্য এতটা প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে, সে-ই মুহুর্তের মধ্যে কালেমা পড়ে মুসলিম হয়ে গেল! উমায়ের বলল, “ (মক্কায় থাকার সময়) আপনি যখন আকাশ থেকে ওহি আসার কথা বলতেন, তখন আমরা আপনাকে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন আপনি যা বললেন তা তো আমি ও সাফওয়ান ছাড়া কেউ জানত না। একমাত্র আল্লাহ আপনাকে না জানালে আপনার জানার কোনো উপায় ছিল না। আল্লাহকে ধন্যবাদ, তিনি আমাকে সত্যের পথ দেখিয়েছেন এবং ইসলামের দিকে চালিত করেছেন।”

এবার নবিজি (সা) উমরকে বললেন, “তোমার এই নতুন মুসলিম ভাইকে দ্বীন সম্পর্কে শিক্ষা দাও। তাকে কোরান পড়তে সাহায্য করো এবং তার পুত্রকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি দাও।”

নতুন মুসলিমের জন্য নবি’জির (সা) প্রথম পদক্ষেপই ছিল তাঁকে কোরান শেখাতে হবে। অর্থাৎ একজন মুসলিমের জীবনে কোরানের গুরুত্ব সর্বাগ্রে। কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে নবিজি (সা) তাঁকে নতুন ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়ার জন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ করতেন। আমাদের সময়েও কেউ ধর্মান্তরিত হলে অবশ্যই তাঁকে একজন ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠিত মুসলিমের সঙ্গে যোগাযোগ ও সংযুক্ত করে দেওয়া উচিত।

 

নবিজিকে (সা) হত্যার চেষ্টা | বদর ও ওহুদের মাঝে সংঘটিত ঘটনা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

উমায়ের ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর জ্ঞান নেওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু সময় মদিনায় রয়ে যান। মক্কায় ফিরে যাওয়ার সময় হলে তিনি নবি’জিকে (সা) বলেন, “হে আল্লাহর রসুল, আমি একদা আল্লাহর দ্বীনের আলো নিভিয়ে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। যারা ইসলাম গ্রহণ করত তাদের ওপর অনেক   অত্যাচার করেছি, তাদের ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছি। আমি আপনাকে ও আপনার সাহাবিদেরও অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি । এখন আপনি আমাকে অনুমতি দিন যেন আমি মানুষকে ইসলামের পথে ডাকি। আমাকে ফিরে যেতে দিন এবং আপনার পক্ষে কাজ করার সুযোগ দিন।”

ওদিকে সাফওয়ান দুই সপ্তাহ পর থেকে মক্কার লোকদের বলতে শুরু করে, ‘তোমাদের কাছে অবাক হওয়ার মতো একটি বড় সুসংবাদ আসতে চলেছে।’ সে সবার মধ্যে উত্তেজনা সঞ্চার করতে সমর্থ হয়। তারপর একপর্যায়ে সে জানতে পারে যে উমায়ের ইসলাম গ্রহণ করেছে। উমায়েরের কাছ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সে আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করে যে উমায়েরের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবে না।

ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, উমায়ের মক্কায় ফিরে যাওয়ার পর তাঁর দ্বারা বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে। উমায়ের ছিল কুরাইশদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, বংশগতভাবে খাঁটি কুরাইশ। সুতরাং তার ওপর কোনো বিপদ আসার তেমন একটা সম্ভাবনা ছিল না। উমায়ের ইসলাম গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিকটাত্মীয়দের জন্যও এই নতুন ধর্ম গ্রহণ করা সহজ হয়ে গিয়েছিল।

এরকম নানাভাবে ইসলাম মানুষের অন্তরে প্রবেশ করেছে। অনেক সময় আমরা ভাবি, আমি মাত্র পাঁচ মিনিট ইসলাম নিয়ে কথা বললেই তারা সবাই ধর্মান্তরিত হবে। কিন্তু ব্যাপারটি আসলে এভাবে হয় না। একজন ব্যক্তি হয়তো একটি নির্দিষ্ট জীবনদর্শন ও ভাবধারায় বড় হয়েছে। নতুন একটি দর্শন গ্রহণ করতে গেলে পুরো ব্যাপারটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে তার সময় লাগবে, কখনও কখনও কয়েক দশকও লেগে যেতে পারে। উমায়ের শেষ পর্যন্ত মদিনায় হিজরত করেন। তাঁর হিজরতের সময় সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য নেই, তবে অনুমান করা যায় যে তা ছিল ওহুদের যুদ্ধের আগেই। পরে ৮ম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের পর তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment