হাদিস সূচী : হানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কথা, কাজ, অনুমোদন ও মৌনসম্মতিকে হাদিস বলে। অর্থাৎ রসুল্লাহ সা: তার জীবদ্দশায় যা বলেছেন, করেছেন বা মৌন সম্মতি দিয়েছেন তার খবরের নামই হাদিস।

Table of Contents
হাদিস সূচী
হাদিসের সংজ্ঞা:
ইমাম বুখারী (রহঃ) বলেন:
“হাদিস এমন একটি শাস্ত্র যার মাধ্যমে মহানবী (সাঃ) এর বক্তব্য বা কথা ও অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়।”
ড. মুহাম্মদ ত্বহান বলেছেন:
“যে কথা, কাজ ও সমর্থনের সম্বন্ধ মহানবী (সাঃ) এর দিকে করা হয়েছে তাকে হাদীস বলে।”
নূরুল আনওয়ার গ্রন্থে বলা হয়েছে:
“শুধুমাত্র রাসূল (সাঃ) এর বাণীকেই হাদীস বলা হয়।”
মিজানুল আকবর প্রণেতার মতে:
“রাসূল পাক (সাঃ) এর সাথে সম্পর্কিত কথা, কাজ ও মৌনসম্মতিকে হাদীস বলা হয়।”
জমহুর মুহাদ্দিস-ই কিরাম এর মতে:
“মহানবী (সাঃ) ও সাহাবী কিরাম এর কথা কাজ ও মৌনসম্মতিকে হাদীস বলে।”
অধিকাংশ মুহাদ্দিসিনে কিরামের মতে এই দাড়ায় যে:
“মহানবী (সাঃ) এর কথা, কাজ ও মৌনসম্মতি এবং সাহাবী ও তাবেঈগণের বক্তব্যকে হাদিস বলে।”
ইসলামে হাদীসের গুরুত্ব
হাদীসের গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে হাদিসের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হলো –
কুরআনের দৃষ্টিতে হাদীসের গুরুত্বঃ
পবিত্র আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলা হাদীসের গুরুত্বের কথা বর্ণনা করেছেন এবং এর অনুকরণ ও অনুসরণকে মানুষের জন্য অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছেন আবার কখনো কখনো রাসূলের অনুসরণকেই আল্লাহ তা’আলার অনুসরণের জন্য যথেষ্ট বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
কুরআনের ভাষায়,
“অর্থাৎ, আর রাসূল (সাঃ) তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন, তা ধারণ কর এবং তিনি যা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা।”
আল্লাহ তা’আলা আরও বলেছেন,
“অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য কর আর আনুগত্য কর তোমাদের মধ্যে কর্তৃত্বশীলদের।”
রাসূলের দৃষ্টিতে হাদীসের গুরুত্বঃ রাসূল (সাঃ) মানুষের হিদায়াতের জন্য কুরআনের পাশাপাশি হাদীসের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন,
“অর্থাৎ,নিশ্চয় আমি তোমাদের নিকট এমন দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতক্ষন পর্যন্ত তা তোমরা দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা বিভ্রান্ত হবে না, এ দুটি হলো আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের হাদীস।”
শরীয়তের দ্বিতীয় উৎসঃ
কুরআনের পরই হাদীসের স্থান। শরীয়তের দ্বিতীয় উৎস হিসেবে এর গুরুত্ব অতুলনীয়। এটি কুরআনের ব্যাখ্যা। কারণ এটি আল্্ল্লা পরোক্ষ বাণী।
এ সম্পর্কে এরশাদ হয়েছে,
“অর্থাৎ, রাসূল নিজ প্রবৃত্তি থেকে কখনো কথা বলেন না, বরং তার নিকট প্রেরিত ওহী ছাড়া ওসব আর কিছুই নয়।”
পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাঃ
রাসূলের বাণী আল হাদীস হলো মূলত মহাগ্রন্থ আল কুরআনের ব্যাখ্যা। যেমন – নামাজ পড়ার কথা কুরআনে বলা হলেও এর বিস্তারিত আলোচনা হাদীসের মাধ্যমেই পাওয়া যায়।
কুরআন বুঝার সহায়কঃ
কুরআন বুঝার অন্যতম সহায়ক হচ্ছে হাদীস। এটি কুরআনের ব্যাখ্যা। এর মাধ্যমে কুুুরআনে বিভিন্ন নীতিকে বাস্তবে রূপায়ণ করা হয়েছ।
কুরআনের পরই হাদীসের স্থানঃ
পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াতে এবং হাদীসে কুরআনের পরই হাদীসের স্থান নির্ধারিত হয়েছে। কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে সহায়ক হিসেবে কুরআনের পরই হাদীসের স্থান দেওয়া হয়েছে।
হিদায়াত লাভের মাধ্যমঃ
হিদায়াত লাভের অন্যতম মাধ্যম হলো হাদীস। এটি মূলত রাসূল (সাঃ) এর বাণী, কাজ ও মৌনসম্মতি। এটি অনুসরণের মাধ্যমে রাসূলকে অনুসরণ করা যায়। তাই যে হাদীসের অনুসারী হবে সে রাসূলের অনুসারী হিসেবে হিদায়াত লাভ করবে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রঃ) বলেন, “হাদীস অন্ধকারের মধ্যে আলোকবর্তিতাস্বরূপ, এটা সর্বদিক উজ্জ্বলকারী পূর্ণচন্দ্র।”
পরকালে নাজাতের মাধ্যমঃ নবী (সাঃ) এর হাদীসের উপর আমল পরকালে নাজাত পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। কারণ এর মাধ্যমে শরীয়তের যাবতীয় বিধান তথা হালাল-হারাম, আদেশ-নিষেধ, ভালো-মন্দ ইত্যাদির সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। হাসীস অনুযায়ী আমল করলে পরকালে জান্নাত লাভ করা সহজ হয়।
কুরআনের ব্যবহারিক রূপায়ণঃ
হাদীস পবিত্র কুরআনের ব্যবহারিক রূপায়ণ। কুরআনকে ভিত্তি করেই মহানবী (সাঃ) পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলামকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। একারণে মহানবী (সাঃ) কে “কুরআনের জীবন্ত প্রতীক” বলা হয়।
অনুসরণীয় আদর্শঃ
নবী (সাঃ) এর আদেশ, নিষেধ, তাঁর যাবতীয় কর্মকাণ্ড, কথাবার্তা, তথা গোটা জীবনই মুসলিম উম্মাহর জন্য একান্ত অনুসরণীয় এক মহান আদর্শ।
তাই বলা যায় জগতের নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের উৎস হলো হাদীসের জ্ঞান। আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল সম্পর্কে অবগত হওয়ার এবং ইসলামের যাবতীয় বিধিবিধান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করার জন্য হাদীস অপরিহার্য।
হাদিসের পরিচয়:
হাদিস আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হলো –
- কথা / বাণী
- উপদেশ
- কাহিনী / ঘটনা
- সংবাদ
- বক্তব্য ইত্যাদি
হাদীসের প্রকারভেদ
বিভিন্ন দিক থেকে হাদিসকে বিভিন্নভাবে ভাগ করা যায়। যেমন –
মতনের দিক থেকে হাদীস ৩ প্রকার। যথাঃ-
- হাদীস-ই- মারফু
- হাদীস-ই- মাওকুফ
- হাদীস-ই- মাকতু
যে হাদীসের সনদ সরাসরি মহানবী (সাঃ) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে হাদিসে হাদীসে মারফু বলে।
যে হাদীসের সনদ মহানবী (সাঃ) পর্যন্ত পৌঁছে নাই এবং সাহাবী কিরাম (রাঃ) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে হাদীসে মাওকুফ বলে।
যে হাদিসের সনদ তাবেঈ (রহঃ) পর্যন্ত পৌঁছেছে তাকে হাদীসে মাকতু বলে।
কোন কোন মুহাদ্দিসগণ এর সাথে আরেকটি প্রকার সংযুক্ত করেছেন সেটি হলো হাদীসে কুদসি।
হাদীসে কুদসীঃ
যে হাদীসের ভাব ভাষা দুটিই আল্লাহ তায়ালার তবে সেটি মহানবী (সাঃ) বর্ণনা করেছেন, তাকে হাদীসে কুদসি বলে।
রাবী বাদ পড়া হিসাবে হাদীস দুই প্রকার।যথাঃ
- মুত্তাছিল হাদীস
- মুনকাতে হাদীস
যে হাদীসের সনদের ধারাবাহিকতা সর্বস্তরে ঠিক রয়েছে কোথাও কোন রাবী বাদ পড়ে নি তাকে মুত্তাছিল হাদীস বলে।
যে হাদীসের সনদের মধ্যে কোন রাবীর নাম বাদ পড়েছে তাকে মুনকাতে হাদীস বলে।
মুনকাতে হাদীস আবার তিন প্রকারঃ
- মুরসাল হাদীস
- মুয়াল্লাক হাদীস
- মুদাল হাদীস
যে হাদীসে শেষের দিকে রাবীর নাম বাদ পড়েছে অর্থাৎ সাহাবীদের নামই বাদ পড়েছে তাকে মুরসাল হাদীস বলে।
যে হাদীসের সনদের প্রথম দিকে রাবীর নাম বাদ পড়েছে অথার্ৎ সাহাবীর পর তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ীর নাম বাদ পড়েছে তাকে মুয়াল্লাক হাদীস বলে।
যে হাদীসে দুই বা ততোধীক রাবী ক্রমান্বয়ে সনদ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে তাকে মুদাল হাদীস বলে।
বিষয়বস্তুর বিচারে হাদীসকে ৩ ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-
হাদীস-ই-ক্বাওলি
হাদীস-ই- ফেইলি
হাদীস-ই- তাকরিরি
মহানবী (সাঃ), সাহাবী (রাঃ) ও তাবেঈগণের সরাসরি বক্তব্য বা বাণীকে হাদীস-ই-ক্বাওলি বলা হয়।
মহানবী (সাঃ) তাঁর সাহাবী কিরাম (রাঃ) ও তাবেঈগণের কাজকে হাদীস-ই-ফেইলি বলে।
মহানবী (সাঃ) তাঁর সাহাবী কিরাম (রাঃ) ও তাবেঈগণের মৌনসম্মতিকে হাদীস-ই-তাকরিরি বলে।
বিশুদ্ধতার বিচারে হাদীস ৩ প্রকার। এগুলো হলো –
- সহীহ হাদীস
- হাসান হাদীস
- যঈফ হাদীস
সহীহ হাদীসঃ
যে হাদীসের বর্ণনাকারীদের বর্ণনার ধারাবাহিকতা রয়েছে এবং সনদের প্রতিটি স্তরে বর্ণনাকারীর নাম, বর্ণানাকারীর বিশ্বস্ততা, আস্তাভাজন, স্বরণশক্তি অত্যন্ত প্রখর এবং কোনস্তরে তাদের সংখ্যা একজন হয়নি তাকে সহীহ হাদীস বলে।
হাসান হাদীসঃ
যে হাদীসে সহীহ হাদীসের সব গুনই রয়েছে, তবে তাদের স্বরণ শক্তির যদি কিছুটা দুর্বলতা প্রমাণিত হয়েছে, তাকে হাসান হাদীস বলে।
যঈফ হাদীসঃ
হাসান, সহীহ হাদীসের গুন সমুহ যে হাদীসে পাওয়া না যায় তাকে যঈফ হাদীস বলে।
সনদের ভিত্তিতে হাদীস আবার ৪ প্রকার। যথাঃ
- হাদীস-ই-মুত্তাসিল
- হাদীস-ই-মুনকাতেঈ
- হাদীস-ই- মাউযু
- হাদীস-ই-মাতবুক
এছাড়াও আরও অনেক প্রকার হাদীস রয়েছে।
কিতাবুস সিত্তাহ
কিতাব কথাটি কিতাব كتاب থেকে আগত, যার অর্থ বই। আর আল-সিত্তাহ السته হচ্ছে ৬টি। ইসলামী পরিভাষায় হাদিসের ছয়খানা অন্যতম হাদিসগ্রন্থকে একত্রে কিতাবুস সিত্তাহ বলে। কিতাবুস সিত্তাহ গ্রন্থাবলি ও এর সংকলকদের নাম :
ক্রমিক নং | গ্রন্থের নাম | সংকলকের নাম | জন্ম | ওফাত | জীবন কাল | হাদিস সংখ্যা |
১ | সহীহ বুখারী | মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইবরাহিম ইবনে মুগিরা | ১৯৪ হিজরি ১৩ শাওয়াল,৮২০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুলাই | ২৫৬ হিজরি | ৬২ বছর | ৭৩৯৭টি |
২ | সহীহ মুসলিম | মুসলিম ইবনে হাজ্জাজ আল কুশায়রি আল নিশাপুরী | ২০৪ হিজরিতে নিশাপুরে | ২৬১ হিজরি | ৫৭ বছর | ৪০০০টি |
৩ | জামি’ আত তিরমিজি | আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিজি | ২০৯ হিজরিতে খোরাসানের তিরমিজ শহরে | ২৭৯ হিজরি | ৭০ বছর | ৩৮১২টি |
৪ | সুনানে আবু দাউদ | আবু দাউদ সুলায়মান ইবনে আশআশ ইবনে ইসহাক | ২০২ হিজরিতে সিস্তান নামক স্থানে | ২৭৫ হিজরি | ৭৩ বছর | ৪৮০০টি |
৫ | সুনানে নাসাই | ইমাম আবু আবদুর রহমান আহমদ ইবনে শুআইব ইবনে আলি আল খোরাসানি আন-নাসাই | ২১৫ হিজরি নাসা শহরে | ৩০৩ হিজরি | ৮৮ বছর | ৫৭৬১ টি |
৬ | সুনানে ইবনে মাজাহ | আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মাযাহ আল কাজবিনি | ২১৭ হিজরিতে কাসবিন শহরে | ২৭৩ হিজরি | ৬৪ বছর | ৪৩৪৯টি |
আরও দেখুন: