হামরা আল-আসাদ অভিযান: কুরাইশরা যাতে আবার আক্রমণ না করে তা নিশ্চিত করা | ওহুদের যুদ্ধ-৫, কুরাইশরা যদিও শেষ পর্যন্ত জানতে পারে যে নবিজি (সা) জীবিত আছেন, তবু তারা মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফেরার পথে তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও তর্কবিতর্ক শুরু হয়: আমরা কি মদিনায় ফিরে গিয়ে তাদের (মুসলিমদের) সবাইকে শেষ করে দিয়ে আসব? না আমরা এখন মক্কায় ফিরে যাব? আমাদের এখন কী করা উচিত?
কুরাইশরা এরপর কী করতে পারে তা নিয়ে নবিজিও (সা) বেশ চিন্তিত ছিলেন। তাই মদিনায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি বিশেষ দল গঠনের প্রয়োজন বোধ করলেন। তিনি সাহাবিদের বললেন, “কুরাইশরা যাতে ফিরে এসে আবার আক্রমণ না করে তা নিশ্চিত করতে আমাদের আরও একটি দল গঠন করতে হবে। তোমাদের মধ্যে কে স্বেচ্ছায় এতে অংশ নেবে?” তিনি আরও বললেন, “যারা আগে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলে কেবল তারাই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে এই দলে যোগ দিতে পারবে (অর্থাৎ তিনি মুনাফেকদের মধ্য থেকে কাউকে চান না)।”
হামরা আল-আসাদ অভিযান: কুরাইশরা যাতে আবার আক্রমণ না করে তা নিশ্চিত করা | ওহুদের যুদ্ধ-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

৭০ জন সাহাবি স্বেচ্ছায় এই দলে যোগ দেন। আলি ইবনে আবি তালিবকে (রা) করা হয় তাঁদের দলনেতা। সেদিন ছিল ওহুদের যুদ্ধের পরের দিন; অর্থাৎ শাওয়াল মাসের ১৬ তারিখ, রবিবার। নবিজি (সা) আলিকে (রা) হামরা আল- আসাদে শিবির স্থাপন করতে বললেন। তাই এই অভিযানটিকে “গাজওয়াত হামরা আল-আসাদ’ বা হামরা আল-আসাদ অভিযান বলা হয়। তিনি আলিকে (রা) আরও পরামর্শ দিলেন, “দূর থেকে দেখবে তারা কীসে চড়ে আছে; যদি দেখ ঘোড়ায় চড়ে আছে তাহলে বুঝবে তারা মদিনার দিকে আসছে, আর যদি দেখ উটে চড়ে আছে তাহলে বুঝবে তাঁরা মক্কায় ফিরে যাচ্ছে।”
দেখা গেল, কুরাইশরা উটে চড়ে মক্কা অভিমুখে ফিরে যাচ্ছে। পরদিন নবিজি (সা) ওই ৭০ জন সাহাবির সঙ্গে যোগ দেন। আল্লাহ সুবনাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরানে তাঁদের প্রশংসা করেছেন: “আঘাত পাওয়ার পরও যারা আল্লাহ ও রসুলের ডাকে সাড়া দিয়েছে, তাদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে এবং সজাগ থেকেছে আল্লাহর নির্দেশের প্রতি, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার।” [সুরা আল ইমরান, ৩: ১৭২] আয়েশা (রা) তাঁর ভাগ্নে উরওয়া ইবনে জুবায়েরের কাছে এই আয়াতটি শুনিয়ে বলেছিলেন, “হে আমার ভাগ্নে, তোমাদের দুজন পিতাই (পূর্বপুরুষই) আল্লাহ ও তাঁর রসুলের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন।” এখানে আয়েশা (রা) উরওয়ার পিতা জুবায়ের ইবনুল আওয়াম এবং পিতামহ আবু বকরের (রা) কথা বোঝাতে চেয়েছেন।
[প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উরওয়ার মা ছিলেন আসমা বিনতে আবু বকর। আয়েশার (রা) কাছ থেকে আসা হাদিসগুলোর পরম্পরায় প্রধান বর্ণনাকারী ছিলেন উরওয়া। কারণ তিনি ছিলেন আয়েশার (রা) রক্তের সম্পর্কের ভাগ্নে। তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ যিনি আয়শার (সা) সঙ্গে অতিরিক্ত হিজাব ছাড়াই সরাসরি কথা বলতে পারতেন। উরওয়া কিন্তু সাহাবি ছিলেন না, কারণ তিনি আবদুল্লাহর পরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। আয়েশার (রা) বর্ণনা করা বেশিরভাগ হাদিসই উরওয়ার মাধ্যমে আমাদের কাছে এসেছে।]

কুরাইশরা আবার ফিরে আসে কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাহাবিরা হামরা আল-আসাদে তিনদিন অপেক্ষা করেন। আল-ওয়াকিদির বেশ কয়েকটি বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি, কুরাইশরা মদিনায় ফিরে আবার আক্রমণ চালানোর সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিল। কিন্তু কেন তারা তা করেনি তা আমরা আল-ওয়াকিদির এই বর্ণনা থেকে জানতে পারি: কুরাইশদের অনেকে চেঁচামেচি শুরু করে দিল এই বলে যে, তারা যে কাজ (মুহাম্মদকে হত্যা করা) করতে এসেছে তা তো এখনও করতে পারেনি। তাদের মধ্যে প্রধান ছিল ইকরিমা ইবনে আবি জেহেল। সে বলল, “আমাদের সেখানে ফিরে গিয়ে এই আপদ থেকে চিরকালের জন্য মুক্তি পাওয়া দরকার।”
কিন্তু সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া ইকরিমার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলল, “শোনো, তোমরা এটা করো না। নিশ্চয় তারা এবার রাগে ফুঁসে উঠবে। আর তোমরা তো জানো না যে তাদের সঙ্গে হয়তো মদিনার খাজরাজ ও আউস উপজাতির যারা আগের বার যুদ্ধে অংশ নেয়নি তারাও এবার যোগ দিতে পারে।” এখানে উল্লেখ্য, মদিনার রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মুনাফেকদের সম্পর্কে কুরাইশদের তখনও পরিষ্কার ধারণা ছিল না। কিন্তু ইকরিমা পীড়াপীড়ি করতে থাকল, “আমরা মুহম্মদকে হত্যা করতে পারিনি; আমাদের নারীদের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার মতোও তেমন কিছু অর্জন করিনি।”
এই পর্যায়ে কুরাইশরা মদিনায় ফিরে আবারও আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত একরকম নিয়েই ফেলেছিল। কিন্তু তখনই আল্লাহ মাবাদ আল-খুজাই নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে এক কৌশল করলেন। মাবাদ তখনও মুসলিম ছিলেন না। তিনি আরও পরে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, কারণ তিনি কুরাইশদের বিশ্বাসঘাতকতা ও অশ্লীলতার নমুনা দেখতে পেয়েছিলেন, যা এমনকি জাহেলি আরবদের মূল্যবোধেরও পরিপন্থী ছিল।
মাবাদ সেই সময় মদিনায় ছিলেন। মুসলিমরা হামরা আল-আসাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগেই তিনি নবিজির (সা) সঙ্গে দেখা করে তাঁকে বিশেষভাবে সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, “আপনি এবং আপনার সঙ্গীদের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে তা আমরা শুনেছি। জেনে রাখুন, আমি এতে খুশি নই। আমি বরং অন্য (কুরাইশ) দলটিরই ক্ষতি ও পরাজয় কামনা করেছিলাম।” তারপর তিনি মদিনা ত্যাগ করেন। পথে আবু সুফিয়ানের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়।
সে মাবাদকে খুজা সম্প্রদায়ের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে সম্মান করত। সে মাবাদের কাছ থেকে মদিনার খবরাদি জানার জন্য উদগ্রীব ছিল। সে জিজ্ঞেস করল, “হে মাবাদ, আমাকে বলুন। আপনি মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীসাথিদের কেমন অবস্থায় দেখে এসেছেন?” উত্তরে মাবাদ বললেন, “ওহ! আপনি হয়তো এখন আর তাদের মোকাবেলা করতে চাইবেন না। কারণ, তারা এখন রাগে ও প্রতিশোধের আগুনে ফুঁসছে। তাদের মধ্যে যারা আগে যুদ্ধ করেনি, তারাও এখন যুদ্ধ করতে প্রস্তুত!” মাবাদ না জেনেও সেই কথাই বললেন যা কিছু সময় আগে সাফওয়ান বলেছিল।
মাবাদ আবু সুফিয়ানকে আরও বললেন, “প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে তারা শপথ নিয়েছে যে কুরাইশরা তাদের সাথে যা করেছে তার সমপরিমাণ প্রতিশোধ নেওয়ার আগ পর্যন্ত তারা শান্তি পাবে না।” এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান বলল, “আমাদের এখন কী করা উচিত? আপনার কোনো পরামর্শ আছে?” জবাবে মাবাদ বললেন, “আমার পরামর্শ হলো, আপনাদের ঘোড়া যত জোরে দৌড়াতে পারে, তত তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালিয়ে যান।”
মাবাদের মতো সম্মানীয় মানুষের কাছ থেকে এমন ভয়ংকর অবস্থার কথা জানতে পেরে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পাকাপাকি করে। কিন্তু নবিজির (সা) কোনো ধারণা ছিল না যে এমনটি ঘটতে পারে। মাবাদ নিজে থেকেই এই কাজটি করেছিলেন। এখানে ওহুদের যুদ্ধের শেষ। মুসলিমরা হামরা আল-আসাদে তিন দিন অপেক্ষার পর মদিনায় ফিরে যান।
আরও পড়ুনঃ