হিজরতের জন্য মদিনাকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল? | মদিনায় হিজরত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা, নবি করিমের (সা) জন্য শহর হিসেবে মদিনাকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল? আর কি কোনো শহর ছিল না? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আল্লাহ চাইলে তো তাঁকে আবিসিনিয়ায় পাঠাতে পারতেন। তাহলে মদিনা কেন? এ বিষয়ে পণ্ডিতদের বিভিন্ন ব্যাখ্যা থেকে আমরা কিছুটা ধারণা পেতে পারি, তবে প্রকৃত কারণ আল্লাহই ভালো জানেন।

হিজরতের জন্য মদিনাকে কেন বেছে নেওয়া হয়েছিল? | মদিনায় হিজরত থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
(১) প্রথম কারণ মদিনার কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান। মক্কা থেকে এর দূরত্ব খুব কম না হলেও খুব বেশিও নয়। মক্কা থেকে মদিনা যেতে একটি কাফেলার গড়ে ৭-৮ দিন সময় লাগত। খুব দ্রুত গেলে তিন দিনেও যাওয়া সম্ভব ছিল। মক্কা থেকে মদিনার দূরত্ব এত কম নয় যে তা নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াত। আবার মদিনা আবিসিনিয়ার মতো দূরেও নয় যে যাত্রাপথে অনেক সময় লাগবে।
(২) সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে মদিনা অত্যন্ত উপযোগী শহর। এর চার সীমানার তিন দিকেই প্রাকৃতিক সুরক্ষা রয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম দিকে রয়েছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্ট দুটি পাহাড়। কয়েক হাজার বছর ধরে সংঘটিত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে মদিনায় ভূমিতে এমন এক ধরনের উপাদান তৈরি হয়েছে যা সাধারণ বালি, শিলা, মুড়ি বা কঙ্কর নয় (অর্থাৎ এর ওপর দিয়ে সহজে চলাচল করা যায় না)। দক্ষিণ দিকে (মক্কার দিকে) রয়েছে খেজুরের অনেক বড় বন। খেজুরের গাছগুলো এত ঘনভাবে সন্নিবেশিত যে সেখান দিয়ে কোনো সেনাবাহিনী যেতে পারবে না। বাকি রইল শুধু উত্তর দিক। এই ভূতাত্ত্বিক কাঠামোর কারণেই শহরটিকে এভাবে সুরক্ষিত করা সম্ভব হয়েছিল।

(৩) মদিনাবাসী কখনো কারও দখলভুক্ত হয়নি। ফলে তাদের মনোবল ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। কখনো পরাধীন ছিল না বলে তাদের স্বাধীনচেতা মনোভাব ইসলামকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।
(৪) বুআতের যুদ্ধে মদিনার প্রবীণ নেতারা মারা যাওয়ায় তরুণ প্রজন্ম নতুন ও নিরপেক্ষ নেতা পেতে চেয়েছিল। নবিজির (সা) মধ্যে তারা তাঁদের সেই ইন্সিত নেতাকে খুঁজে পেয়েছিল।
(৫) মদিনার লোকদের (খাজরাজ) সঙ্গে নবি করিমের (সা) রক্তের সম্পর্ক ছিল। আল্লাহ তাঁর রসুলের (সা) পরবর্তী বসবাসের জন্য এমন এক ভূমি বেছে নিয়েছিলেন যেখানে আগে থেকেই তাঁর রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। নবিজি (সা) যে শহরে বাস করবেন, তাঁর নিজের পিতামহ সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন ও বেড়ে উঠেছিলেন। এই বিষয়ে পঞ্চম পর্বে বিশদভাবে বর্ণনা করেছি।
(৬) ইয়াসরিবের আরবরা ছিল আউস ও খাজরাজ উপজাতির। তারা ছিল কাহতানি। আমরা প্রথমদিকের পর্বে কাহতান ও আদনান নামের দুজন আরবের কথা উল্লেখ করেছিলাম। আউস ও খাজরাজ বাদে আশেপাশের অন্য সব আরব উপজাতি ছিল আদনানি। কাহতানি ও আদনানিরা যে এক নতুন ইসলামি রাষ্ট্র গঠনের জন্য একত্রিত হবে তা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। একই জাতীয়তার কারণে কেউ তাদের বিরোধিতা করতে পারেনি। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে কী ঘটতে চলেছে তার একটি পূর্বাভাস পাওয়া যায়; তা হলো, ইসলাম অচিরেই জাতিগত পার্থক্য ও গোষ্ঠীবাদ নির্মূল করতে চলেছে।
(৭) আউজ ও খাজরাজ উভয় উপজাতিই ছিল ইয়েমেনীয়। ইয়েমেনের জনগণের একটি বিশেষ বরকত রয়েছে। নবিজি (সা) তাঁদের প্রশংসা করে বলেছেন, “ইমান হচ্ছে ইয়েমেনি এবং প্রজ্ঞা হচ্ছে ইয়েমেনীয়।”
(৮) ইয়াসরিবে ইহুদি ও আরবদের অনন্য সংমিশ্রণ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আউস ও খাজরাজ উপজাতির লোকেরা দুই শতাব্দী ধরে একেশ্বরবাদী লোকদের সঙ্গে বসবাস করছিল। তাই তাঁরা কিতাব, নবি, শরিয়া ইত্যাদির ধারণার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত ছিল। এই বিষয়টি নিয়ে ইহুদিরা আরবদের অবজ্ঞা ও বিদ্রুপ করত। তাই যখন আসল সত্য ধর্ম ইসলাম এল, তখন আউস ও খাজরাজ তা সহজেই গ্রহণ করল। আর যারা তাদের বিদ্রূপ করত, তারাই অহঙ্কার করে সেই সত্যকে প্রত্যাখ্যান করল।
আরও পড়ূনঃ