উমরের (রা) খেলাফতকালে হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রচলন | সুফ্ফার লোকেরা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

উমরের (রা) খেলাফতকালে হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রচলন | সুফ্ফার লোকেরা, আমরা এখন আলোচনা করব হিজরি ক্যালেন্ডার প্রচলন নিয়ে, যা ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না হলেও হিজরতের সময়ের ওপর ভিত্তি করেই হিজরি বা ইসলামিক ক্যালেন্ডারের প্রচলন হয়।

উমরের (রা) খেলাফতকালে হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রচলন | সুফ্ফার লোকেরা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

এর আগ পর্যন্ত আরবদের কোনো ক্যালেন্ডার ছিল না। ক্যালেন্ডার, লিপি, স্থাপত্য ইত্যাদি যে কোনো জাতির সভ্যতার নিদর্শন। ইসলাম এসে একটি পশ্চাৎপদ সমাজকে বদলে দিয়ে পুরো বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করে। সত্যিই এটি একটি বিস্ময়কর ব্যাপার। আল্লাহ পবিত্র কোরানে বলেছেন, “আমি তোমাদের ওপর কিতাব নাজিল করেছি যার মধ্যে তোমাদের জন্য উপদেশ আছে।” [সুরা আম্বিয়া, ২১:১০ ) সভ্যতার মাপকাঠিতে আরবরা অনেক কিছুতেই পিছিয়ে ছিল:

 (ক) তাদের কোনো সমন্বিত ক্যালেন্ডার ছিল না। প্রত্যেক গোত্রের ছিল নিজস্ব ও আলাদা ক্যালেন্ডার। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর ওপর ভিত্তি করে তারা সময়ের হিসাবে করত। উদাহরণস্বরূপ, কোনো উপজাতির প্রধান ব্যক্তি মারা গেলে তারা পুরো বছরটিকে ‘গোত্রপ্রধানের মৃত্যুর বছর বলে অভিহিত করত। তারপর তারা এই সীমানির্ধারক মাইলফলক বছরগুলোকে কাছাকাছি অন্য কোনো বছরকে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহার করত; যেমন: গোত্রপ্রধানের মৃত্যুর দুই বছর পরে’, ‘হাতির ঘটনার তিন বছর আগে’ ইত্যাদি। প্রতি কয়েক বছরে কোনো না কোনো মাইলফলক ঘটনাকে তারা তাদের ক্যালেন্ডারে ব্যবহার করত। আবার সেগুলোও ছিল প্রতিটি উপজাতির স্থানীয় বা বিকেন্দ্রীকৃত ক্যালেন্ডার।

(খ) আরবদের মধ্যে ‘আল-নাসি’ নামের একটি বিভ্রান্তিমূলক রীতির প্রচলন ছিল (৯:৩৭]। ইব্রাহিমের (আ) সময়ে আল্লাহ তায়ালা ‘শরিয়া’ (বিধান) দিয়েছিলেন যে বছরের চার মাস পবিত্র রাখতে হবে। আল্লাহ এ বিষয়টি পবিত্র কোরানে উল্লেখ করেছেন: “আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর কাছে মাসগণনায় মাস বারোটি, তার মধ্যে চারটি মাস (মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ) হারাম।” [সুরা তওবা, ৯:৩৬]

এই ১২ মাসের বিধানটি আল্লাহ আমাদের জন্য শুরুর সময় থেকেই দিয়েছেন। এখানে লক্ষণীয়, পৃথিবীতে প্রচলিত উল্লেখযোগ্য সব ক্যালেন্ডারই ১২ মাসের। এই ১২ মাসে বছরের বিষয়টি প্রথম দিকের নবিদের শরিয়াতেও ছিল। রোমান ও পার্সিয়ানরা যে তাদের ক্যালেন্ডারে ১২ মাস পেয়েছে, তার সবই এসেছে আল্লাহর নির্দেশিত আদি শরিয়া থেকে। এ ছাড়া ৭ দিনে এক সপ্তাহের বিষয়টিও শরিয়াতে আছে। আল্লাহই এ বিধান দিয়েছেন।

 

উমরের (রা) খেলাফতকালে হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রচলন | সুফ্ফার লোকেরা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

বছরের চার মাসকে পবিত্র রাখার ধারণাটি ইব্রাহিমের (আ) কাল থেকেই চলে আসছিল। পবিত্র মাসে যুদ্ধ করার বিধান ছিল না; আরবরা তা অনুসরণ করত। তবে সময়ের আবর্তে কুরাইশসহ কোনো কোনো শক্তিশালী উপজাতি এই চার মাসের বিষয়টি নিজেদের সুবিধামতো নির্ধারণ করে নেওয়া শুরু করে। তারা কোনো যুদ্ধ ঘোষণা করতে চাইলে তা যদি কোনো পবিত্র মাসে পড়ত, তাহলে তা অন্য একটি সাধারণ মাস দিয়ে পরিবির্তিত করে নিত; কারণ পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা বারণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ, যে মাসে তারা যুদ্ধ করতে চাইত তা যদি মহররম হতো, তাহলে তারা সেই মাসের নাম বদলে দিয়ে সফর বলে ঘোষণা দিত। এটিই আল-নাসি, যা ছিল এক প্রকারের কৃষ্ণর। এভাবেই তারা আক্ষরিক অর্থে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী মাসগুলো অদলবদল করার ঘোষণা দিত।

এরকম করে মাসের অদলবদল চলার পর কয়েক দশক বা শতাব্দী পর কী অবস্থা হয়েছিল তা কল্পনা করুন। পুরো বিষয়টি ভীষণ গোলমেলে হয়ে উঠেছিল। পবিত্র মাস আসলে কোনটি তা সঠিকভাবে নির্ণয় করার কোনো উপায়ই আর ছিল না। ফলে পবিত্র মাসগুলোর ধারাবাহিকতার গুরুত্ব লোপ পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিদায় হজের বছরে (অর্থাৎ ১০ম হিজারিতে নবি করিম (সা) ঘোষণা করেন, “আল্লাহ তায়ালা নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করার সময় মাসগুলোর যে ক্রম ছিল, এ বছরের মাসগুলো সেই ক্রমেই পড়েছে। এখন থেকে এর ক্রমের আর পরিবর্তন হবে না।” আল্লাহর ইচ্ছাতেই মাসগুলোর ক্রম ঠিক হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত মাসগুলোর ক্রম নিয়ে আর সমস্যা হয়নি।

(গ) মাসের বিষয়টির সুরাহা হলেও বছরের সমস্যা রয়েই গেল। নবিজি (সা) জীবদ্দশায় কোনো ক্যালেন্ডার প্রতিষ্ঠা করে যাননি। হিজরতের ১৭তম বছরে একসঙ্গে দুটি ঘটনা ঘটে।

১) এক লোক আরেক লোকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন। ধারের টাকা টাকা ফেরত দেওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। বিষয়টি তৎকালীন খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) পর্যন্ত গড়ায়। একজন অভিযোগ করল, “শাবান মাসে আমাকে তার টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এর মধ্যে রমজান মাস এসে গেছে।” অন্যজন বলল, “আমি তো আগামী বছরের শাবান মাসকে বুঝিয়েছি, এই বছরের নয়।” এই বিরোধের সমাধান করতে গিয়ে উমর (রা) দোটানায় পড়ে গেলেন। দুজনের কারও বক্তব্যেই ভুল কিছু নেই, কারণ চুক্তিতে কেবল ‘শাবান’ কথাটির উল্লেখ আছে। খলিফা এখন কীভাবে এর নিষ্পত্তি করবেন? সম্ভবত তাঁরা দুজনেই সততা বজায় রেখে কথা বলছে। খলিফা বেশ সমস্যায় পড়ে গেলেন।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

২) উমর (রা) আবু মুসা আল-আশরি বা অন্য কোনো গভর্নরের কাছ থেকে একটি চিঠি পান। সেখানেও একই রকম সমস্যার কথা বলা ছিল, “হে উমর (রা), আপনি কখনও কখনও নির্দিষ্ট মাসের মধ্যে কোনো কাজ শেষ করার জন্য আমাদের নির্দেশ দেন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না মাসটি এই বছরের, না পরের বছরের। অতএব, আপনি আমাদের এ বিষয়টি বোঝার সঠিক উপায় বাতলে দিন।”

সুতরাং উমর (রা) সাহাবিদের নিয়ে সভা ডাকলেন। সভায় কেউ পরামর্শ দিলেন, “আমরা রোমান বা পার্সিয়ানদের ক্যালেন্ডার অনুসরণ করতে পারি।” কিন্তু এই প্রস্তাব তৎক্ষণাৎ নাকচ করা হলো। কারণ মুসলিমদের এখন একটি নিজস্ব সভ্যতা আছে, তাদের আর অন্য কাউকে অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই। সভায় তাঁরা একটি নিজস্ব ক্যালেন্ডার প্রচলন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

এবার উমর (রা) সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, “তাহলে কোন বছর থেকে আমরা আমাদের কালেন্ডারের সাল গণনা শুরু করতে পারি?” সাহাবিরা নানা রকমের মত পেশ করতে লাগলেন। একজন বললেন, নবিজির (সা) ইন্তেকালের বছর থেকে আমরা শুরু করতে পারি। আরেকজন বললেন, নবিজির (সা) জন্মের বছরটি হতে পারে। আরেকজন বদরের যুদ্ধের বছরের পক্ষে মত দিলেন। এ পর্যায়ে আলি ইবনে আবি তালিব (রা) বললেন, “হিজরতের বছর থেকেই ক্যালেন্ডারটি শুরু হওয়া উচিত। কারণ এই বছরটি থেকেই মুসলিমরা নিপীড়ন- অপমানের অবস্থান থেকে সম্মানের অবস্থানে পৌঁছেছিল।”

এই প্রস্তাবের সঙ্গে সব সাহাবি একমত প্রকাশ করলেন। খলিফা উমরও (রা) বললেন, এটাই সবচেয়ে বিজ্ঞ মত। উল্লেখ্য, পরবর্তীকালে পণ্ডিতেরা এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোরান থেকে প্রমাণাদি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন। তারপর প্রশ্ন উঠল, কোন মাসকে বছরের প্রথম মাস হিসাবে গ্রহণ করা উচিত। এবারও উপস্থিত সাহাবিরা ভিন্ন ভিন্ন মত দিতে শুরু করলেন। কেউ বললেন, রমজান পবিত্রতম মাস হিসেবে বছরের প্রথম মাস হওয়া উচিত। কেউ কেউ জিলহজ, রজব ইত্যাদি মাসের পক্ষেও বললেন। শেষ পর্যন্ত উসমান ইবনে আফফান (রা) বললেন, “বছরের প্রথম মাস হবে মহররম মাস।” মহররম কেন? এ নিয়ে পণ্ডিতেরা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

 

উমরের (রা) খেলাফতকালে হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রচলন | সুফ্ফার লোকেরা | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

    ১) নবিজি (সা) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন সফর মাসের শেষ থেকে রবিউল আউয়াল মাসের শুরু পর্যন্ত। তাহলে সফর মাসকেই হিজরি বছরের প্রথম মাস হিসেবে বেছে নেওয়ার কথা। কিন্তু কেন তা না করে মহররমকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে? এই প্রশ্নের একটা উত্তর হতে পারে এই যে, নবিজি (সা) মক্কার সব মুসলিমকে মহররম মাসে মদিনায় হিজরত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং অধিকাংশ মুসলিম ওই মাসেই হিজরত করেন। এ কারণেই মহররমকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।

  ২) কিছু বর্ণনা অনুসারে, উসমান (রা) একটি কারণ উল্লেখ করেছিলেন। সাহাবিরা প্রায় প্রতিবছরই হা করতে মক্কায় যেতেন; হজ পালন করে ফিরতেন। জিলহজ মাসের শেষের দিকে; হজ শেষে নতুন করে জীবন শুরু করার একটা ব্যাপার সাহাবিদের মধ্যে ছিল। জিলহজ মাসের পরেই মহররম, তাই মহররমকেই বছরের প্রথম মাস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।

আরও পড়ূনঃ

Leave a Comment