হুদায়বিয়ার ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় | হুদায়বিয়ার সন্ধি ( চুক্তি )-৫, ক. হুদায়বিয়ার ঘটনার সময় কুরাইশরা প্রথমবারের মতো মুসলিমদের রাজনৈতিকভাবে সমান স্তরে মেনে নিয়ে চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছিল। মুসলিমরা যে কেবল অনেকদূর এগিয়েছেন তা-ই নয়, সামনের দিনগুলোতে যে তাঁরা কর্তৃত্বের আসনে বসতে যাচ্ছেন সে সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছিল। কুরাইশদের অনেকেই অনুধাবন করতে পারছিল যে, জোয়ার উল্টোদিকে বাঁক নিয়েছে। এই উপলব্ধি থেকেই তারা ওই বছর মুসলিমদের মক্কায় প্রবেশ যে কোনো মূল্যে ঠেকাতে চেয়েছিল। তারা নিশ্চিতভাবেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। এ থেকে মুসলিমদের তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থান লক্ষ করা যায় ।
কুরাইশ ও মুসলিমদের শক্তির ভারসাম্যের এই পরিবর্তন লক্ষ করেই কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করবে, যা আমরা মক্কা বিজয়ের আগে শেষ ধর্মান্তরিতদের (খালিদ ইবনে ওয়ালিদ, উসমান ইবনে তালহা, আমর ইবনুল আস প্রমুখের) কাহিনি আলোচনার সময় দেখব। হুদায়বিয়ার সন্ধির পরই তারা উপলব্ধি করেছিল যে ইসলামই সত্য। হুদায়বিয়া ছিল তাদের কাছে ইসলামের সত্যতা নিরূপণে চূড়ান্ত প্রমাণ ।
হুদায়বিয়ার ঘটনা থেকে শিক্ষণীয় | হুদায়বিয়ার সন্ধি ( চুক্তি )-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

খ. এই সন্ধি মুসলিমদের স্বস্তি ও নিরাপত্তা এনে দিয়েছিল, যা তাঁরা আগে কখনও অনুভব করেনি। মুসলিমদের মনে সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া বদর, ওহুদ, খন্দক এসব যুদ্ধের স্মৃতি জাগরূক আছে। তাঁরা সব সময়ই একটা আতঙ্কের মধ্যে ছিল, কুরাইশরা আবার কখন আক্রমণ করে বসে! মুসলিমরা অন্য আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করতে পারছিল না; যেমন খায়বারে বসবাসকারী ইহুদি গোত্র বনু নাদির ও বনু কায়নুকা। হুদায়বিয়ার চুক্তির কারণে কুরাইশদের দিক থেকে হুমকি দূর হওয়ার পর মুসলিমরা এখন ইহুদিদের মোকাবেলা করতে পারবে।
গ. কুরাইশদের দিক থেকে সম্ভাব্য হুমকি দূর হওয়ার পর নবিজি (সা) এই প্রথমবারের মতো ইসলামকে বৃহত্তর (বিশ্ব) পরিসরে পৌঁছে দেওয়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পেরেছিলেন।
ঘ. এই চুক্তিটি এক অর্থে প্রতিষ্ঠিত করেছে যে, মুসলিম উম্মাহ এখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র। মুসলিমরা এখন সিজার, কিসরা ও মুকাওকিসের {১} মতো সম্রাটদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে।

ঙ. এই চুক্তির কারণে প্রথমবারের মতো কোনো রকমের সংঘাতের সম্ভাবনা ছাড়াই মুসলিমরা আরবের পৌত্তলিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিল। পুরো আরব উপদ্বীপ জুড়েই মুসলিম ও পৌত্তলিকদের মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য ও যাতায়াতের মাধ্যমে পারস্পরিক মেলামেশার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে ইসলামের বার্তা শান্তিপূর্ণভাবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। শান্তিপূর্ণ দাওয়াতের কারণে অনেক লোক ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। সুতরাং হুদায়বিয়ার চুক্তি বা সন্ধি ছিল “শান্তি ও দাওয়াতের জেহাদ’; তা ছিল যে কোনো ‘যুদ্ধের জেহাদের’ চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর।
বিখ্যাত তাবেয়িন ইবনে শিহাব আল-জুহরি (মৃ. ১২৪ হিজরি) বলেছেন, “হুদায়বিয়ার আগে ইসলামের জন্য এর চেয়ে বড় কোনো বিজয় আসেনি। মানুষ পরস্পরের সঙ্গে নির্বিঘ্নে মিশতে ও কথা বলতে পারত। ফলে যারা ইসলাম সম্পর্কে আগে শোনেনি, তারাও নবিজির (সা) বার্তা শোনার পর ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করল । অবস্থা এমন হলো যে, হুদায়বিয়ার পরের দুই বছরে মুসলিমরা সংখ্যায় দ্বিগুণ বা বা তার চেয়েও বেশি হয়ে গেল ।”
আগের ১৯ বছরে যত সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিল, পরের দুই বছরে তার চেয়েও বেশি সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে । আল-জুহরিকে উদ্ধৃত করে ইবনে হিশাম যোগ করেছেন, “আল-জুহরির বক্তব্যের প্রমাণ হলো, রিদওয়ানের অঙ্গীকারে মুসলিম ছিলেন ১,৪০০ জন, আর দুই বছর পরে মক্কা বিজয়ের সময় ছিলেন ১০,০০০ হাজার জন।” তাহলে বাকি ৮,৬০০ জন কোথা থেকে এলেন । তাঁরা ওই দুই বছরের শান্তিপূর্ণ দাওয়াতের ফসল ।
চ. রিদওয়ানের অঙ্গীকারে অংশগ্রহণকারী সাহাবিদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। নবিজি (সা) তাঁদের ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ছ. হুদায়বিয়ার সন্ধি মক্কা বিজয়ের সরাসরি সূত্রপাত করেছিল। পরবর্তী সময়ে আমরা দেখব, কুরাইশরা চুক্তি ভঙ্গ করার কারণেই নবিজি (সা) তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সুতরাং হুদায়বিয়া ছাড়া মক্কা বিজয় সম্ভব হতো না। হুদায়বিয়ার সন্ধি ছিল নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয় ।
আরও পড়ুনঃ