কাব ইবনুল আশরাফের প্রাণনাশ | কাব ইবনুল আশরাফের প্রাণনাশ কারকারাত, এখন আমরা সিরাহের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর একটি নিয়ে আলোচনা করব। তা হলো কাব ইবনুল আশরাফের প্রাণনাশের ঘটনা। এটি সিরাহের অন্যতম সংবেদনশীল বিষয়। এজন্য বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিয়ে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
কাব ইবনুল আশরাফের প্রাণনাশ | কাব ইবনুল আশরাফের প্রাণনাশ কারকারাত | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
কাব ইবনুল আশরাফের বাবা ছিল বনু নাবহান গোত্রের একজন খাঁটি আরব পৌত্তলিক। আর তার মা ছিল বনু নাদির গোত্রের একজন ইহুদি। তার বাবা একবার এক লোককে খুন করলে তাকে তার নিজের গোত্রের লোকদের থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। পালিয়ে গিয়ে সে ইয়াসরিবের ইহুদি গোত্র বনু নাদিরের কাছে আশ্রয় নেয়। বনু নাদিরের লোকজন আবার তাকে তাদের গোত্রের এক নারীকে বিয়ে করারও অনুমতি দেয়।
সেই বিয়ের ফলস্বরূপ কাব ইবনুল আশরাফের জন্ম। সুতরাং কার একজন পরিপূর্ণ আরব ও পূর্ণ ইহুদি। সে বাবার সূত্রে আরবদের কাছ থেকে পেয়েছিল ‘বংশ’, আর মায়ের মাধ্যমে বনু নাদিরের ইহুদিদের কাছ থেকে পেয়েছিল ধর্ম, শিক্ষা ও আভিজাত্য। কাব বড় হয়ে এক সময় বনু নাদিরের অন্যতম একজন নেতা হয়ে উঠে। অনেক কারণে মদিনায় তার নামডাক ছড়িয়ে পড়ে সে ছিল অত্যন্ত ধনী । সেই সময়ে তার নিজস্ব দুর্গ ছিল।
সে ছিল ইয়াসরিবের অন্যতম সুদর্শন পুরুষ। সে ভালো কবিতা লিখতে পারত। কাব ইবনুল আশরাফ প্রথম থেকেই নবিজির (সা) প্রতি শত্রুতা দেখিয়ে আসছিল। যখন কিবলা পরিবর্তন করা হয়, তখন কাবই ছিল সেই ব্যক্তি যে বলেছিল, “তারা কেন কিবলা পরিবর্তন করেছে?” আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরানে কাবের এই কথাটিই উদ্ধৃত করেছেন [২:১৪২] {১} । আবার জাকাতের বিধান আসার পর কাব তার যেসব আনসার বন্ধু ইসলাম গ্রহণ করেছিল তাদের কাছে গিয়ে বলেছিল, “তোমরা কোনো টাকাপয়সা (জাকাত হিসেবে) দান করতে যেও না, কারণ আমি আশংকা করছি। এতে করে তোমরা গরিব হয়ে যাবে। আর (অর্থ দিলেও) তা ধীরেসুস্থে ও বুঝেশুনে দিও, কারণ তোমরা তো জান না ভবিষ্যতে এই লোকটির (মুহাম্মদের) কী হবে।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ কোরানে আয়াত নাজিল করেন: “(আল্লাহ তাদেরও ভালোবাসেন না) যারা কৃপণতা করে ও মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দিয়েছেন তা গোপন করে।” [সুরা নিসা, 8:09] বদরের যুদ্ধের পর যখন দুই ব্যক্তি মদিনায় ফিরে এসে যুদ্ধের ফলাফল জানায়, কাব তখন মশকরা করে বলেছিল, “মুহাম্মদ যদি সত্যিই আরবের এই সমূদ্রান্ত লোকদের হত্যা করে থাকে, তাহলে আমার এই পৃথিবীপৃষ্ঠে না থেকে এর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়াই ভালো (অর্থাৎ আমার বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো)।” তার এই কথাটি অচিরেই বাস্তবে পরিণত হয়েছিল।
বদরের যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়ের ব্যাপারটি যখন কাবের সামনে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়, তখন সে আবু সুফিয়ানের সঙ্গে একটি আঁতাত করে। বনু নাদিরের কয়েকজন লোককে সঙ্গে নিয়ে সে গোপনে মক্কায় যায়, সেখানে নবিজির (সা) বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের সঙ্গে জোট বাঁধে। তারা যে জোট গঠন করেছিল তার বিস্তারিত বর্ণনা সিরাহের বইগুলোতে নেই। তবে ধারণা করা যায়, তারা একটি আকস্মিক আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল।
আলোচনার শেষে আবু সুফিয়ান তাকে বলে, “আল্লাহর কসম কেটে তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, দুটি ধর্মের মধ্যে কোনটি আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়, আমাদের ধর্ম না মুহাম্মদের ধর্ম?” (উল্লেখ্য, পৌত্তলিকরা ইহুদিদের ব্যাপারে হীনম্মন্যতায় ভুগত। কারণ, তারা মনে করত, ইহুদিরা সভ্যতার নিরিখে তাদের চেয়ে এগিয়ে।) কাব তখন উত্তরে বলে, “তোমরা তাদের চেয়ে সঠিক পথে আছ।” এ বিষয়ে আল্লাহ কোরানে উল্লেখ করেছেন:
“দেখো! তারা আল্লাহর সম্বন্ধে কেমন মিথ্যা বানায়, আর প্রকাশ্য পাপ হিসেবে এ-ই যথেষ্ট। তুমি কি তাদের দেখনি যাদেরকে কিতাবের এক অংশ দেওয়া হয়েছিল? তারা ‘জিত্ত’ (প্রতিমা) ও ‘তাগুত’ (অসত্য দেবতা)-এ বিশ্বাস করে। তারা অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে বলে, “বিশ্বাসীদের চেয়ে এদের পথই ভালো।” [সুরা নিসা, ৪:৫০-৫১/ আবু সুফিয়ানের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপে কাব ঠিক এই কথাটিই বলেছিল। তারপর একদিকে কাব মদিনায় ফিরে আসে, অন্যদিকে আল্লাহ তাঁর রসুলকে ওই গোপন জোটের কথাটি জানিয়ে দেন।
কাব নবি করিম (সা) ও মুসলিমদের হেয় করে অনেক কবিতাও লিখেছিল। সর্বশেষ সে যে কাজটি করে তা তার আগের সব অপকর্মকে ছাড়িয়ে যায়। সে মুসলিম নারীদের সম্পর্কে ব্যঙ্গাত্মক ও যৌনতামিশ্রিত কবিতা লিখতে শুরু করে। সে মুসলিম নারীদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করে কবিতা লিখতে থাকে। সন্দেহ নেই, সে ঔদ্ধত্যের সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছিল।
ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম ও আল ওয়াকিদির বর্ণনা অনুসারে, কাবকে বদর ও ওহুদের যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে হত্যা করা হয়েছিল। তবে মুকাতিল ইবনে সুলায়মান, আল-বাগাভি ও আল-সালিহি (যিনি সিরাহ নিয়ে ১২ খণ্ডের সর্বকালের অন্যতম বৃহত্তম বই লিখেছিলেন) সহ অন্যান্য সিরাহ-লেখকের বর্ণনা অনুসারে, ওহুদের যুদ্ধের পরে কাবকে হত্যা করা হয়। এই তিনজন তাঁদের বর্ণনায় আরও একটি কারণ যুক্ত করেছেন যা ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম ও আল ওয়াকিদি করেননি। তা হলো, নবিজিকে (সা) হত্যা করার নির্লজ্জ চেষ্টা, যা বনু নাদির করেছিল ।
ওহুদের যুদ্ধের পর বনু নাদির নবিজিকে (সা) নিমন্ত্রণ করে, এবং তাঁকে বিষ মেশানো খাবার খাইয়ে হত্যা করার চেষ্টা করে। আল-সালিহি ও অন্যদের মতে, বনু নাদিরের এই চক্রান্তের মূল হোতা ছিল কাব। খাবারে বিষ মেশানোর বুদ্ধিটা ছিল তারই। এই পণ্ডিতদের মতে, বনু নাদিরের চক্রান্ত করার আগের রাতেই কাবকে হত্যা করা হয়। সুতরাং এই পণ্ডিতদের বর্ণনা দেখলে আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে যায় কেন কাবকে হত্যা করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। তবে আমরা ইবনে ইসহাকের ভাষাই গ্রহণ করব। আল-সালিহির বর্ণনা অনুসারে খাবারে বিষ মেশানোর বুদ্ধিটি কাবের কাছ থেকে এসেছিল, ইবনে ইসহাকের ভাষ্যের সঙ্গে এর সমন্বয় করা যায় {২} ।
যা-ই হোক, নবিজি (সা) সাহাবিদের ডেকে বললেন, “তোমাদের মধ্যে কে কাব ইবনুল আশরাফের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বটি নেবে? কারণ সে আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে (সা) অনেক জ্বালাতন করছে।” মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা নামের এক সাহাবি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হে আল্লাহর রসুল, আমি এই কাজটি করব।”
এই সাহাবি ছিলেন আউস গোত্রের। এখানে লক্ষণীয়, ইসলাম-পূর্ব সময়ে আউস ও বনু নাদিরের মধ্যে সখ্য ছিল। মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা খাজরাজের কাউকে এটি করতে দিতে চাননি। কারণ, খাজরাজের সঙ্গে বনু নাদিরের সম্পর্কে আগে থেকেই খারাপ ছিল। তাই খাজরাজদের মধ্য থেকে কেউ এটি করলে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারত। তাই আউস গোত্রের একজন বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা এগিয়ে আসেন, যাতে জাহেলি সংঘাত আবারও মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে।
ইবনে হিশামের বর্ণনা অনুসারে, মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা এই দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলার পর থেকে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেন। তিনদিন পর কেউ একজন এই বিষয়টি নবিজির (সা) গোচরে আনেন। নবিজি (সা) তাঁকে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “হে আল্লাহর রসুল, আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমি হয়তো তা আর পূরণ করতে পারব না।”
কাব ছিল ধনী ব্যক্তি, সে সবসময় তার দুর্গের মধ্যে প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় থাকত। মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা বুঝতে পারছিলেন, কাবের বিরুদ্ধে কিছু করা সহজ হবে না। কিন্তু তিনি নবিজিকে (সা) প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ নিয়ে তিনি এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন যে, খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেন। নবিজি (সা) তাঁকে শুধু বললেন: তুমি শুধু চেষ্টা করে যাও। মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা: হে আল্লাহর রসুল, তাহলে আমাকে এমন কিছু কথা কাবকে বলার অনুমতি দিন যা আমি মন থেকে বিশ্বাস করি না। নবিজি (সা): তোমার যা খুশি তা বলতে পারো।
কয়েকদিনের মধ্যেই মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা কাব ইবনুল আশরাফের অফিসে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সেখানে আরও কিছু লোক বসে ছিল । তিনি কাবকে বললেন, “তোমার সঙ্গে আমার খুব ব্যক্তিগত কিছু কথা আছে।” উপস্থিত লোকজন একটু দূরে সরে গেলে তিনি বললেন, “এই ব্যক্তিটি (মুহাম্মদ) এখানে আসার পর থেকে গত কয়েক বছর যাবত আমাদের অনেক যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার জন্য আরবরাও আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে। তদুপরি এখন সে আমাদের কাছ থেকে (জাকাত বাবদ) টাকাপয়সা চাইছে। সে-ই আমাদেরকে এতটা সমস্যা ও কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।’
কাব একথা শুনে খুব খুশি হয়ে বলল, “এ তো সবে শুরু। সে তোমাদের আরও অনেক কষ্টের মধ্যে ফেলবে।” তারা এভাবেই কিছুক্ষণ কথা চালিয়ে গেল। এখন আমরা বুঝতে পারছি, কেন মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা কাবকে বিশেষ কিছু কথা বলার জন্য নবিজির (সা) অনুমতি চেয়েছিলেন। এক পর্যায়ে মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা বলেলেন, “এখন তো আমরা তাঁর অনুসারী। পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তো আমরা তার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙতে পারব না। তাই ততদিন পর্যন্ত তাকে দেওয়ার (জাকাত) জন্য তোমার কাছ থেকে আমার কিছু টাকা ঋণ নেওয়া প্রয়োজন।”

কাব ইবনুল আশরাফের ধনী হওয়ার একটি মাধ্যম ছিল মানুষকে ঋণ দেওয়া। সবাই এটি জানত। এখন মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাও তার কাছে ঋণ চাইছেন। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী ঋণগ্রহীতাকে ঋণদাতার কাছে কিছু না কিছু বন্ধক রাখতে হতো। কাব বন্ধক চাইলে এই বিষয়ে তাদের মধ্যে বেশ কিছু কথাবার্তা হয়:
মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা : আমার কাছে বন্ধক দেবার মতো কিছুই নেই। সে জন্যই তো আমি এখানে (তোমার কাছে) এসেছি।
কাব ইবনুল আশরাফ: ঠিক আছে। তাহলে তোমার স্ত্রীকে আমার বাড়িতে রেখে যেও।
মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা : আল্লাহর কসম, তুমি পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদর্শন। তুমি কীভাবে আশা করছ, তোমার সান্নিধ্যে থাকার পরও একজন নারীর ওপর আমি বিশ্বাস রাখতে পারব?
কাব ইবনুল আশরাফ (প্রশংসা শুনে নরম হয়ে): ঠিক আছে। তাহলে তোমার ছেলেদের আমার কাছে রেখে যেও ।
মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা : আমার ছেলেদের? কিন্তু তারা বড় হলে সারাজীবন তাদের বন্ধুরা ঠাট্টামস্করা করে বলবে, ‘তোমাদের বাবা তো তোমাদের বন্ধক হিসেবে রেখেছিল!’ তাদের সারাজীবন এই অসম্মানের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে! আমি তোমাকে আমার ছেলেদের দিতে পারব না।
কাব ইবনুল আশরাফ: তাহলে কী বন্ধক রাখবে?
মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা: আমি যদি আমার অস্ত্রগুলো তোমার কাছে রাখি তাহলে কি হবে? তুমি তো জানই যে আমাদের এখন এই অস্ত্রগুলোই বেশি প্রয়োজন (কারণ এখন যুদ্ধ চলছে)। তাই আমি আমার অস্ত্রগুলো তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে নিতে মনেপ্রাণে চাইব। তাহলে আমার খুব প্রয়োজনীয় জিনিস বন্ধক হিসেবে তোমার কাছে থেকে যাবে ।
কাব ইবনুল আশরাফ: ভালো বলেছ। তাহলে তুমি তোমার অস্ত্রগুলো আমার কাছে নিয়ে এসো।
এভাবেই মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা কৌশল করেছিলেন যাতে তিনি কাবের কাছে অস্ত্র নিয়ে হাজির হতে পারেন। কারণ এ ক্ষেত্রে কারও কোনো সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। তারপর ঠিক কী ঘটেছিল তা পুরোপুরি জানা যায়নি। তবে যতটুকু জানা যায়, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার সঙ্গে আরও দুই-তিন জন সাহাবি (যেমন, সিলকান ইবনে সালামা ওরফে আবু নায়লা) যোগ দেন। তাঁরাও একইভাবে কাবের কাছে নিজেদের অস্ত্র জমা রেখে ঋণ নেওয়ার কথা বলেছিলেন।
আবু নায়লা কাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, “এই ব্যাপারটি আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখো। আমরা চাই না কেউ আমাদের দেখুক। অমুক দিন রাতের বেলা তমুক সময়ে আমরা তোমার কাছে গিয়ে অস্ত্রগুলো হস্তান্তর করব।” আল-ওয়াকিদির বর্ণনা অনুসারে, তারিখটি ছিল হিজরতের তৃতীয় বছরের ১৪ই রবিউল আউয়াল । সিরাহের বইগুলোতে উল্লেখ আছে, রাতটি ছিল পূর্ণিমার, আকাশে কোনো মেঘ ছিল না। নবিজি (সা) তাদের সঙ্গে বাকি আল ঘরকান পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলেন। বিদায় নেওয়ার আগে তিনি বলেন, “আল্লাহ তোমাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়তা করুন।”
তারপর তাঁরা মদিনার উপকূলে কাবের দুর্গে পৌঁছে কাবকে বাইরে আসার জন্য ডাক দেন। সে তখন বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করছিল। জানা যায়, সে সবেমাত্র আরেকটি বিয়ে করেছিল। ডাক শুনে কাব বাইরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালে তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রী তাকে ধরে বলে, “তুমি এই সময়ে কোথায় যাচ্ছ?” কাব: আবু নায়লা ও মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা আমাকে তাদের কিছু জিনিস দিতে এসেছে।
কাবের স্ত্রী: তারা কেন এই সময়ে এসেছে? এটা ঠিক না। তুমি তো যুদ্ধের মধ্যে আছ (অর্থাৎ তোমার সঙ্গে অনেকেরই বৈরিতা আছে, অনেকের সঙ্গেই তুমি সংঘাতে জড়িয়ে আছ)। তাই তোমার জন্য আমার চিন্তা হচ্ছে । কাব: আবু নায়লা আমার পালক (ফস্টার) ভাই, আর মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাকে আমি অনেকদিন ধরে চিনি। আমি তাদের দুজনকেই বিশ্বাস করি। একথা বলে কাব তার স্ত্রীর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুর্গের বাইরে বেরিয়ে আসে।
মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা তাঁর সাথীদের নিয়ে যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা হলো: যে কোনো কৌশলে তিনি কাবের মাথা ধরে বগলের নিচে চেপে ধরবেন, তারপর অন্যরা বাকি কাজ সারবেন। তাঁরা ভালো করেই জানতেন যে কাৰ সবসময় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় থাকে, এখনও সে সশস্ত্রই থাকবে। তার দামি বর্মটির কথা ছিল সর্বজনবিদিত।
যা-ই হোক, তাঁদের ডাকে কাব দুর্গের বাইরে এল। দেখা হওয়ার পর তারা অনেকটা জাহেলি দিনগুলোর মতোই নিজেদের মধ্যে খোশগল্পে মেতে উঠল। আৰু নায়লা কাবকে বলল, “আমি তোমার কাছ থেকে মিষ্টি আতরের গন্ধ পাচ্ছি।” কাব: হ্যাঁ, আমার সঙ্গে এক যুবতী নারী আছে যার, শরীর থেকে আরবের যে কোনো নারীর চেয়ে বেশি সুগন্ধি বেরোয়।
আবু নায়লা: আমাকে গন্ধটি শুঁকতে দেবে! আৰু নায়লা (কাব গন্ধ শুঁকাতে সামনে এগিয়ে এলে): ওহ! এই গন্ধ তো তোমার চুল থেকে আসছে! আমাকে চুল শুঁকতে দাও!” এ পর্যায়ে কাব মাথা নিচু করলে সেই সুযোগে মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা তার মাথা চেপে ধরেন, আর অন্যরা পরিকল্পনা অনুসারে তাদের জন্য নির্ধারিত কাজটি সেরে ফেলেন।
কাব বর্ম পরে থাকার কারণে কাজটি সহজ ছিল না। জানা যায়, বর্ষপরিহিত কাবকে উপর্যুপরি আঘাত করতে গিয়ে হারিস ইবনে আউস নামের এক সাহাবি নিজ দলেরই অন্যদের আঘাতে গুরুতরভাবে আহত হন। অনেক রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে তাঁকে দ্রুত মদিনায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। নবিজির (সা) সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি হারিসের ক্ষতের ওপর কিছুটা লালা লাগিয়ে দেন। বলা হয়, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতটি নিরাময় হয়।
সংক্ষেপ এই ছিল কাব ইবনুল আশরাফের শেষ পরিণতি। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি নিঃসন্দেহে সত্য; সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম প্রভৃতিতে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে।
আমাদের আধুনিক যুগের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনাটি সমস্যাপূর্ণ। কারণ, এখানে নবিজি (সা) একটি নির্মম হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেছেন। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, কাব ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে কিংবা নবিজিকে (সা) ব্যক্তিগতভাবে ঠাট্টা- উপহাস করেছে বলে কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়নি; বরং এর পেছনে অন্য বেশ কয়েকটি গুরুতর কারণ ছিল; যেমন:
১. কাব ইবনুল আশরাফ আবু সুফিয়ানের সঙ্গে গোপন জোট পাকিয়ে চুক্তি করেছিল। এটি ছিল সুস্পষ্ট বিশ্বাসঘাতকতা, সংবিধান লঙ্ঘন এবং মুসলিমদের জন্য নিরাপত্তাজনিত হুমকি ।
২. মুসলিমদের এবং বিশেষ করে মুসলিম নারীদের নিয়ে অশ্লীল কবিতা রচনা । ৩. নবিজিকে (সা) হত্যার সরাসরি প্রচেষ্টা (আল-সালিহির ভাষ্য অনুসারে)।
ওপরের সব অভিযোগই অত্যন্ত গুরুতর এবং কাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। সন্দেহাতীতভাবে সে ঘৃণ্য অপরাধে অপরাধী। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে; তা হলো, তাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ, আধুনিক যুগের প্রেক্ষিতে এই ঘটনার পর বিচার-শালিস হওয়ার কথা। কিন্তু সমালোচনাকারীরা সেই সময়ের রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের এখনকার পরিস্থিতির মাপকাঠিতে বিবেচনা করছে, নবিজিকে (সা) বিচার করছে আমাদের আধুনিক সময়ের আইন ও রীতিনীতির আলোকে।
কিন্তু সেটি ছিল ভিন্ন সমাজ, ভিন্ন সময় ও ভিন্ন প্রেক্ষাপট। সেই সময়ে সেই সমাজে যারা বাস করত, তারা সেই সমাজের রীতি-পদ্ধতি জানত ও বুঝত। সে কারণেই আমরা দেখতে পাই, কাবের স্ত্রীর বলেছিল, ‘তুমি তো যুদ্ধের মধ্যে আছ। তুমি মোটেই নিরাপদ নও!’ যদিও কাব তখন পর্যন্ত মুসলিমদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি, তবুও তার স্ত্রী বুঝতে পেরেছিল যে তার স্বামী যা করছে, তা অনেকটা যুদ্ধ ঘোষণা করার শামিল। কাবের স্ত্রী সেই সময়কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, রীতিনীতি ও আইনের আলোকে বুঝতে পেরেছিল যে, তার স্বামী মোটেই নিরাপদে নেই।
আমাদের এখনকার আইনের আলোকে এই ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করা অমূলক । সেই সময়ে মহানবি মুহাম্মদ (সা) একাই ছিলেন ইসলামের সরকার। রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আইনি সব ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশনাই ছিল চূড়ান্ত। সেই সরকারে তিনি ছিলেন একদিকে শাসক, অন্যদিকে বিচারক। সেই প্রেক্ষাপটে এই কাজটি বৈধতার মধ্যেই পড়ে। মক্কায় যেহেতু তাঁর কোনো রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল না, সেহেতু তিনি সেখানে কাজটি করেননি। মদিনায় রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়ার পরই তিনি তা করেছেন। স্থান ও কালের প্রেক্ষাপটে কাজটি সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত ছিল।
এখানে আরও একটি বিষয় যোগ করতে হবে: সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিজেই ‘টার্গেটেড কিলিং’ {৩}, বা ১৬ বছরের কিশোরকে ‘ড্রোন’ দিয়ে আক্রমণ করা আইনসিদ্ধ ও সংবিধানসম্মত মনে করছে। যারা সরকারের এই কাজকে সমর্থন করে তাদের জন্য কাব ইবনুল আশরাফের প্রাণনাশের বিষয়টি নিয়ে কোনো সমস্যা থাকার কথা না।
একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন: কাব ইবনুল আশরাফ কি আবু সুফিয়ানকে সাওয়িকের ঘটনায় মদিনা আক্রমণে সরাসরি সাহায্য করেছিল? বনু নাদিরের একজন নেতা হিসেবে তার এই কাজটি করে থাকাই স্বাভাবিক। সম্ভবত সে আবু সুফিয়ানকে আক্রমণে সাহায্য করার কয়েক সপ্তাহ পরে জোট গঠনের জন্য মক্কায় গিয়েছিল। এটি একটি ধারণা মাত্র, কেউ গ্রহণ করতে পারে, অথবা না-ও করতে পারে। আল্লাহ ভালো জানেন ।
আরও পড়ুনঃ