বনু নাদিরকে বহিষ্কার | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

বনু নাদিরকে বহিষ্কার | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন, নবিজি (সা) মদিনায় ফিরে সাহাবিদের প্রকৃত ঘটনা খুলে বললেন। তারপর তিনি মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার মাধ্যমে বনু নাদিরের কাছে একটি বার্তা পাঠালেন। “তোমরা আমাকে আপ্যায়নের প্রস্তুতি নেবে বলে বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছিলে, অথচ তোমরা সেই একই সময়ে পাথর নিক্ষেপ করে আমাকে হত্যার  পরিকল্পনা করছিলে। …. (হত্যাপ্রচেষ্টার এই অপরাধের জন্য) তোমাদের এখন একমাত্র পথ হলো আগামী ১০ দিনের মধ্যে তোমাদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে যাওয়া। ১০ দিন পরে যদি তোমাদের কাউকে দেখতে পাই, তাহলে তার শাস্তি হবে কেবল মৃত্যুদণ্ড।”

বনু নাদিরকে বহিষ্কার | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

বনু নাদিরকে বহিষ্কার | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

জাহেলি যুগে মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা ছিল বনু নাদিরের মিত্র। নবিজির (সা) এই প্রস্তাব শুনে তারা প্রথমে বেশ অবাক হয়। তারপর মাসলামার সঙ্গে তর্ক শুরু করে, “তোমরা কীভাবে আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পার?” মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার সোজাসাপ্টা উত্তর, “ইসলাম এসে সবকিছু বদলে দিয়েছে। আনুগত্য ও বন্ধুত্ব এখন শুধু আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সঙ্গেই সম্পর্কিত।” বনু নাদিরের লোকেরা ভালো করেই জানত যে তারা দোষ করেছে এবং হাতেনাতে ধরা পড়েছে। শেষে তারা মদিনা ছেড়ে চলে যেতে রাজি হয়।

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালুল প্রথমে খবরটি বিশ্বাস করতে পারেনি। সে ভাবতেও পারেনি যে তার মিত্রদের এভাবে মদিনা থেকে বহিষ্কৃত হতে হবে। সে তাদের কাছে বার্তা পাঠাল, ‘যা-ই ঘটুক না কেন, আমি তোমাদের ব্যাপারটি দেখব এবং তোমাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করব। যে-ই তোমাদের বহিষ্কার করার চেষ্টা করুক না কেন আমি তা শুনব না।’ ঠিক এই কথাটিই কোরানে লিপিবদ্ধ আছে: “… আমরা তোমাদের ব্যাপারে কখনও কারও কথা মানব না।” [সুরা হাশর, ৫৯:১১]

আবদুল্লাহ ইবনে উবাই বনু নাদিরের লোকদের আরও জানাল, প্রয়োজন হলে সে বহিষ্কারকারীদের (অর্থাৎ নবিজির) বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আর একান্তই কিছু করতে না পারলে সে স্বেচ্ছায় মদিনা ছেড়ে চলে যাবে। সে তাদের আরও জানাল, “আমি পাতাফানে আমার মিত্রপক্ষের লোকদেরও খবর পাঠিয়েছি। তারা দুই হাজার লোকের শক্তিশালী জনগোষ্ঠী, আমরা একসাথে তোমাদের রক্ষা করব।”

এদিকে আল্লাহ তায়ালা কোরানে (৫৯:১১) সবকিছু ফাঁস করে দিয়েছেন। আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন যে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই একজন মিথ্যাবাদী। বনু নাদির এই বার্তা পাওয়ার পর কী করা উচিত তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করল। হুয়ায় ইবনে আখতাব ছিল বনু নাদিরের অন্যতম নেতা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হুয়ায় ইবনে আখতাবের কন্যা ছিলেন সাফিয়া বিনতে হুয়ায়, যিনি পরবর্তীকালে ‘উম্মুল মুমিনিন’দের একজন অর্থাৎ নবিজির (সা) স্ত্রী হবেন।

পরে সাফিয়া নিজেই সেই সময়ে তাঁর পিতা ও চাচা আবু ইয়াসির ইবনে আখতাবের চিন্তাধারা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে বলে গেছেন। সাফিয়া বর্ণনা করেছেন, “নবিজি (সা) হিজরতের পর প্রথম মদিনায় এলে আমার পিতা ও চাচা ধরেই নিয়েছিল যে, সম্ভবত এ-ই সেই ব্যক্তি (অর্থাৎ সম্ভবত এ-ই সেই নবি) যার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। আমরা জানি যে,  ইহুদিরাও একজন নবির আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল এবং তাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, পরবর্তী নবি তাদের মধ্য থেকেই আসবেন ।

সাফিয়া আরও বর্ণনা করেছেন, “আমি ছিলাম আমার বাবা ও চাচা উভয়েরই খুব প্রিয়। তাঁরা আমাকে খুব আদর করতেন। আমাকে পেলেই তাঁরা আমার সঙ্গে খেলতেন। (আমার মনে আছে) নবিজি (সা) হিজরতের পর মদিনায় এলে তাঁরা দুজনেই তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর তাঁরা বেশ অন্যমনস্ক ছিলেন, আমার দিকে তাঁদের কোনো নজর ছিল না। তখন তাঁদের মধ্যে এমন কথপোকথন হয়েছিল।

চাচা (বাবাকে): ইনিই কি সেই ব্যক্তি (নবি)? বাবা: আল্লাহর কসম, ইনিই সেই ব্যক্তি।

চাচা: আপনি এখন কী করবেন?

বাবা: যতদিন বাঁচি, তার সাথে শত্রুতা করেই বেঁচে থাকব।” (এর অর্থ হলো, ইহুদি ছাড়া আর কাউকে তিনি নবি হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না।) আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের প্রতিশ্রুতির বার্তাটি বনু নাদিরের কাছে পৌঁছলে হুয়ায় ইবনে আখতাব তা বিশ্বাস করে এবং বহিষ্কারের আদেশের বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ নিয়ে তার নিজের উপজাতির লোকদের মধ্যে ভিন্নমত ছিল । আল্লাহ তায়ালা কোরানে উল্লেখ করেছেন: ….তুমি মনে কর ওরা ঐক্যবদ্ধ, কিন্তু ওদের মনের মিল নেই।” [সুৱা হাশর, ৫৯:১৪]

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

হুয়ায় যুদ্ধ করতে চায়, কিন্তু অন্য অনেক ইহুদি তা চায়নি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়, অবশেষে হুয়ায় ইবনে আখতাব তার সিদ্ধান্তটি সবাইকে মানাতে সক্ষম হয় । তারা লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নবিজির (সা) কাছে এই বার্তা পাঠায়, “হে মুহাম্মদ, আমরা এখান থেকে যাচ্ছি না। তুমি যা খুশি তা করতে পার।” নবিজি (সা) তাদের এই সিদ্ধান্তের কথা শুনেই বলে ওঠেন, “আল্লাহু আকবার!”

নবিজির (সা) মুখে ‘তাকবির’ শুনে সাহাবিরাও সমস্বরে বলে ওঠেন, “আল্লাহু আকবার!” কারণ, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, এই ব্যাপারটি মুসলিমদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে। এর ফল কতটা ভালো হয়েছিল তা আমরা শীঘ্রই দেখতে পাব। সেদিনই নবিজি (সা) আনুমানিক ৭০০ জনের একটি বিশাল দল নিয়ে গিয়ে বনু নাদিরের দুর্গগুলো অবরোধ করেন। এত দ্রুত ঘেরাও হতে দেখে ইহুদিরা হতবাক হয়ে যায়।

ওদিকে বনু নাদির আবদুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দেওয়া প্রতিশ্রুত সাহায্যের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সেই সাহায্যের কিছুই আসেনি। আবদুল্লাহ ইবনে উবাই লড়াই বা স্বেচ্ছা নির্বাসন দূরে থাক, বনু নাদিরের পক্ষে প্রতিবাদের একটি  আঙুলও তোলেনি। যতই দিন যেতে লাগল, ততই পরিষ্কার হতে থাকল যে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই কিছুই করবে না। কারও কারও মতে অবরোধটি চলেছিল এক সপ্তাহ, কারও মতে দশ দিন। কিন্তু বনু নাদিরের দিক থেকে লড়াইয়ের কোনো চেষ্টা হয়নি। মদিনার সব মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই করার অবস্থায় তারা ছিল না। অবরোধের পুরোটা সময় ধরে বনু নাদির কেবল বাইরের সাহায্যের অপেক্ষায় ছিল।

নবিজি (সা) তখন এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি একদল সাহাবিকে দুর্গের বাইরে পাহারায় রেখে বাকিদের নিয়ে বনু কুরায়জার সঙ্গে আলোচনা করতে যান। বনু কুরায়জা ছিল মদিনার তিনটি প্রধান ইহুদি উপজাতির মধ্যে তৃতীয় । নবিজি (সা) তাদের কাছ থেকে পুনরায় শপথ নিয়েছিলেন যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তারা সংবিধান মেনে চলবে, না কি বনু নাদিরের পক্ষ অবলম্বন করবে। বনু কুরায়জা তখন সংবিধান মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দেয়। নবিজি (সা) এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে আবার বনু নাদিরের দুর্গের কাছে ফিরে যান।

 

বনু নাদিরকে বহিষ্কার | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, বনু নাদিরের লোকেরা নিজেদের বড় বড় খেজুরবাগান নিয়ে অনেক গর্ব করত। ৫-৮ বছরের পরিচর্যায় তাদের খেজুরগাছগুলো তখন বেশ ফলবন্ত। নবিজি (সা) তাদের মনোবল ভেঙে দিতে বাগানের কয়েকটি গাছ পুড়িয়ে দেন। এতদিনের যত্নে বড় হওয়া গাছগুলোকে পুড়ে যেতে দেখা ছিল তাদের জন্য খুবই কষ্টের। এ ছিল তাদের অনেক চেষ্টা ও শ্রমের ফসল। তারা আহাজারি করতে করতে বলে, “তোমরা শান্তির কথা বলো। এ কেমন শান্তি?” কিছু সাহাবির মনেও নবিজির (সা) এই নিয়ে প্রশ্ন জাগে। আল্লাহ এ সম্পর্কে কোরানে আয়াত নাজিল করেছেন [৫৯:৫], যা নিয়ে এই পর্বের শেষের দিকে আলোচনা আছে। দশ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও বনু নাদির যখন দেখল যে কেউ তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না, তখন তারা নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হলো।

নবি করিম (সা) বনু নাদিরের সঙ্গে যথেষ্ট উদার আচরণ করেন। তাদের নেতারা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তিনি তাদের ক্ষমা করেন এবং তাদের জীবন নিয়ে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেন। নবিজি (সা) তাদের বলেন, “তোমরা যা যা পার নিয়ে যাও। কেবল একটি শর্ত, অস্ত্র নিয়ে যেতে পারবে না।” অবশ্যই এটি ছিল অত্যন্ত ন্যায্য শর্ত।

বনু নাদিরকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আসলেই কারও কিছু বলার ছিল না। নবিজি (সা) তাদের ওপর অতিরিক্ত কিছুই চাপিয়ে দেননি, কোনো কর আরোপ করেননি। তিনি তাদের উটের পিঠে যতটা সম্ভব সবই নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।

বনু নাদিরের লোকরা সাধ্যমতো জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়। তারা ভাবে যে মুসলিমরা তাদের দুর্গ ও বাড়িগুলো দখল করে নেবে, তাই হিংসার বশে নিজেদের  ঘরের আসবাবপত্র ও ভেতরটা নষ্ট করে ফেলে যাতে মুসলিমরা ওগুলো ব্যবহার না করতে পারে । বস্তুত এটি ছিল তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে শাস্তি আল্লাহ কোরানে বলেছেন:

“… এদের ঠিক আগে যারা নিজেদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তির স্বাদ নিয়েছে তারাই {১} এদের একমাত্র তুলনা। এদের জন্য রয়েছে নিদারুণ শাস্তি।” [সুরা হাশর, ৫৯:১৫] ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে, বনু নাদির চলে যাওয়ার সময় মদিনাবাসী রাস্তার পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখে। তাদের জন্য তা ছিল এক অভূতপূর্ণ দৃশ্য। তারা অবাক হয়ে দেখে, বনু নাদিরের লোকেরা কয়েক শতাব্দী ধরে কী পরিমাণ ধনসম্পদ, অলংকার ইত্যাদি সঞ্চয় করেছে।

বনু নাদির তাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ পরিমাণ জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে যায়। তাদের উটগুলো ব্যবহার করা হচ্ছিল শুধু মালপত্র বহনের কাজে। শিশু ও নারীসহ সবাই হেঁটে যাচ্ছিল। অনেকে তাদের ঘরের দরজা খুলে নিয়ে উটের পিঠে চাপিয়েছিল। জানা যায়, তাদের মধ্যে দুই বা তিনজন ইসলাম গ্রহণ করে। ফলে তাদের মদিনায় থেকে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment