সুমামা ইবনে উসালের ইসলাম গ্রহণ | খন্দক ও হুদায়বিয়ার মাঝে ছোট ছোট অভিযান, সিরাহের বর্ণনায় গত কয়েকটি পর্বে আমরা খন্দকের (আহজাবের) যুদ্ধের কাহিনি শেষ করার মধ্য দিয়ে হিজরতের পঞ্চম বছর পর্যন্ত আলোচনা শেষ করেছি। এর পরের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হুদায়বিয়ার সন্ধি, যা হিজরতের ষষ্ঠ বছরের শেষের দিকে হয়েছিল। এর মাঝে প্রায় ৭-৮ মাসের মধ্যে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনা/অভিযান রাজনৈতিকভাবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ না হলেও আমরা সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চার-পাঁচটি নিয়ে আলোচনা করব।
সুমামা ইবনে উসালের ইসলাম গ্রহণ | খন্দক ও হুদায়বিয়ার মাঝে ছোট ছোট অভিযান | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

মুহাম্মদ ইবনে মাসলামার নেতৃত্বে আনুমানিক ৩০ জন সাহাবিকে নিয়ে গড়া একটি ছোট্ট দলকে আল-কুরতায় বনু বকর ইবনে কিলাব গোত্রের কাছে এক অভিযানে পাঠানো হয়। সময়টা ছিল হিজরতের ষষ্ঠ বছরের সম্ভবত শাওয়াল মাস। অভিযানটি সফলভাবে শেষ করে সাহাবিরা ফিরে আসছিলেন। ফেরার পথে বেশ চমকপ্রদ একটি ঘটনা ঘটে।
সাহাবিরা একটি ছোট কাফেলার দেখা পান। কাফেলার লোকদের মধ্যে একধরনের অস্বাভাবিকতা (সিরাহের বইগুলোতে এর বিস্তারিত উল্লেখ নেই) লক্ষ করলে সাহাবিরা পরিচয় না জেনেই তাদের বন্দি করে নবিজির (সা) কাছে নিয়ে আসেন। নবিজি (সা) সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা কি জানো তোমরা কাদের বন্দি করেছ?” সাহাবিরা বললেন, “না, তারা কারা?” নবিজি (সা) বললেন, “তোমরা সুমামা ইবনে উসালকে বন্দি করেছ।”
সুমামা ইবনে উসাল ছিলেন বনু হানিফা গোত্রের সর্দার। সেই সময় বনু হানিফা ছিল আরবের অন্যতম বড় গোত্র, সংখ্যার হিসেবে কুরাইশদের সমতুল্য। সুমামা ছিলেন তাঁর গোত্রের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের একজন। তাঁর কাফেলায় কোনো পাহারা ছিল না। তাই সাহাবিরা কাফেলার লোকদের সহজেই আটক করে নবিজির (সা) কাছে আনতে পেরেছিলেন।
সেই সময়ের আগ পর্যন্ত মুসলিমদের সঙ্গে পৌত্তলিকদের যুদ্ধে সুমামা সরাসরি মুশরিকদের সমর্থন করছিলেন, এমনকি নবিজিকে (সা) হত্যা করার হুমকিও প্রকাশ্যে দিয়েছিলেন। তাঁর গোত্রের অন্য লোকদেরও মুসলিমদের প্রতি কোনো সহানুভূতি ছিল না। তাই নবিজি (সা) আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন, “হে আল্লাহ, সুমামাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আমাকে শক্তি দিন।” তাদের এভাবে বন্দি করে আনার ঘটনাটি হয়তো আল্লাহর কাছ থেকে নবিজির (সা) দোয়ারই ফল।
নবিজি (সা) সুমামার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার জন্য সাহাবিদের নির্দেশ দেন। তখন কোনো কারাগার ছিল না। তাই সাহাবিরা তাঁকে হাত বাঁধা অবস্থায় মসজিদুন নববিতে এনে রেখেছিলেন। সন্ধ্যায় নবিজি (সা) তাঁর স্ত্রীদের বলেন সুমামার জন্য খাবার পাঠাতে। তিনি যে খাবার খেতেন তা যে সাহাবিদের খাবারের চেয়ে উন্নত কিছু ছিল তা নয়, তবু তাঁর জন্য আলাদা করে খাবার পাঠাতে বলার অর্থ ছিল বিশেষ সৌজন্য প্রদর্শন। খাবার বহনকারী সাহাবি সুমামাকে বলেন, “এই খাবার ব্যক্তিগতভাবে নবিজির (সা) কাছ থেকে এসেছে। নবিজি (সা) নিজে যা খান, আপনার জন্য তাই পাঠিয়েছেন।”

পরদিন সকালে নবিজি (সা) সুমামার কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার কি নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলার আছে?” জবাবে সুমামা বললেন, “হে মুহাম্মদ, আপনি যদি আমাকে হত্যা করতে চান, তাহলে জেনে রাখুন আপনি এমন কাউকে হত্যা করতে যাচ্ছেন যার রক্ত খুব ভারী (অর্থাৎ, আপনি হয়তো একটি গৃহযুদ্ধ ডেকে আনবেন)। আর আপনি যদি আমার প্রতি উদারতা দেখান, তাহলে আপনি এমন এক ব্যক্তির প্রতি উদারতা প্রদর্শন করছেন যিনি এক সময় তা ফিরিয়ে দেবেন। আর যদি আপনি টাকা চান তবে তার অঙ্কটা বলুন; আপনি সেই টাকাও পেয়ে যাবেন।”
এ থেকে সুমামার মর্যাদাবোধের পরিচয় মেলে। লক্ষ করুন, তিনি নিজের প্রাণভিক্ষা চাইছেন না।
নবিজি (সা) তাঁকে ইসলাম গ্রহণের প্রস্তাব দিলে তিনি নীরব থাকেন। নবিজি (সা) সেদিন তাঁকে আর কিছু না বলে চলে যান। পরের দিন সকালেও একই ঘটনা ঘটে। নবিজি (সা) তাঁকে বলেন, “আপনার কি নিজের পক্ষ থেকে কিছু বলার আছে?” সুমামা একই উত্তর দিলে নবিজি (সা) তাঁকে আগের দিনের মতোই রেখে যান । তৃতীয় দিনও সুমামার দিক থেকে একই জবাব আসে ।
সুমামা মসজিদে অবস্থানকালে প্রতিদিন কী দেখতেন সিরাহের বর্ণনাগুলোতে তার উল্লেখ নেই। তবে সহজেই ধারণা করা যায়, তিনি নবিজির (সা) কণ্ঠে কোরানপাঠ শুনতেন, সাহাবিদের নামাজ পড়া দেখতেন এবং নবিজির (সা) সঙ্গে সাহাবিদের কথোপকথন প্রত্যক্ষ করতেন। ৭২ ঘণ্টারও বেশি সময় তাঁর এসব দেখার সুযোগ হয়েছিল।
সুমামাকে মসজিদে বসিয়ে রেখে ইসলাম ধর্ম ও তার সৌন্দর্য প্রদর্শনের মাধ্যমে হয়তো আশা করা হচ্ছিল যে তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তৃতীয় দিনের শেষেও যখন তিনি একই কথা বলেন, তখন নবিজি (সা) তাঁকে মুক্তি দিতে বলেন। সাহাবিরা দড়ি কেটে তাঁকে মুক্ত করে দেন । সুমামা ছাড়া পেয়ে মসজিদ থেকে বেরিয়ে একটি খেজুরের বাগানের পেছনে যান। সেখানে গোসল করে দশ মিনিটের মধ্যে মসজিদে ফিরে এসে ইসলাম গ্রহণ করেন।
তারপর তিনি বলেন, “হে মুহাম্মদ, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমার দৃষ্টিতে পুরো পৃথিবীতে এমন মুখ ছিল না যা আপনার মুখের চেয়ে আমার কাছে বেশি ঘৃণিত। কিন্তু এখন আপনার মুখই আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর ও প্রিয়। আমি আপনার ধর্মের (ইসলাম) চেয়ে অন্য কোনো ধর্মকে বেশি ঘৃণা করতাম না। আর এখন এই ধর্মই আমার কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয়। আপনার শহরের (মদিনা) চেয়ে আমার কাছে আর কোনো শহর বেশি ঘৃণিত ছিল না। আর এখন এটিই আমার সবচেয়ে প্রিয় শহর।”
লক্ষ করুন, তিনি নবিজিকে (সা) সম্বোধন করছেন ‘হে মুহাম্মদ’ বলে। যদিও তিনি এখন একজন মুসলিম, কিন্তু নবিজিকে (সা) সম্বোধনের সঠিক শিষ্টাচারটি শিখে ওঠেননি। তাই তিনি তাঁকে নাম ধরেই সম্বোধন করছেন। তারপর তিনি নবিজিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি ওমরা করার জন্য যাত্রা শুরু করেছিলাম। এখন কি আমি ওমরা করব (যেহেতু আমি একজন মুসলিম)?” নবিজি (সা) উত্তরে বললেন, “হ্যাঁ, আপনি ওমরা করুন।”
ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুসারে, সঠিক ইসলামি তালবিয়া সহযোগে মক্কায় প্রবেশকারী প্রথম ব্যক্তি ছিলেন সুমামা ইবনে উসাল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, পৌত্তলিকরাও হজ ও ওমরাহ পালন করত, কিন্তু তাদের তালবিয়া ছিল ভিন্ন (চতুর্থ পর্বে ‘ইসলাম-পূর্ব আরবে পৌত্তলিকতার ইতিহাস’ অংশে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। কুরাইশরা এই তালবিয়া শোনার পর সুমামাকে বলেছিল, “আপনি কি একজন ‘সাবি’ হয়ে গেছেন?” কুরাইশরা পৌত্তলিকধর্ম ত্যাগকারীদের সাবি (বা সার্বিয়ান) বলে অভিহিত করত। সুমামা তাদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “না, আমি এখন একজন মুসলিম। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রসুল।”
সুমামার নিজের মুখে তাঁর মুসলিম হওয়ার কথা শুনে কিছু কুরাইশ তাঁকে ঘিরে ধরে তলোয়ার বের করে। তখন অন্যরা তাদের শান্ত করার জন্য বলে, “যদি তোমরা তাঁকে হত্যা কর, তাহলে আমাদের পুরো বনু হানিফা গোত্রের রোষানলে পড়তে হবে।” কুরাইশরা সে যাত্রায় সুমামার কোনো ক্ষতি করেনি। কিন্তু সুমামা তাদের এই আচরণে বেশ রেগে গিয়ে বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, বনু হানিফা এবং উত্তর দিক থেকে তোমাদের কাছে এক কণা শস্যও আসবে না যতক্ষণ না তোমরা মুহাম্মদের ধর্ম অনুসরণ কর।”
সুমামার গোত্র বাস করত মধ্য আরবে; এখন আমরা যে অঞ্চলকে নজদ বলে জানি। উত্তর থেকে কোনো শস্য আসবে না বলে সুমামা সেখানকার মহাসড়কের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ বুঝিয়েছেন। যা-ই হোক, তিনি তাওয়াফ করে ফিরে যান, তারপর তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মক্কার কুরাইশদের কাছে সমস্ত শস্য সরবরাহ বন্ধ করে দেন। দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে যায়। কুরাইশদের খাবারের স্বল্পতা দেখা দেয়।
একপর্যায়ে চরম খাদ্যসংকট দেখা দেয়; তখন তারা বাধ্য হয়ে ‘ইলহিজ’ নামে একটি পদার্থ খেয়ে জীবনধারণ করত, যা মোটেই সুস্বাদু ছিল না। একপর্যায়ে আবু সুফিয়ান বাধ্য হয়ে অহমিকা ভুলে নবিজির (সা) কাছে চিঠি লেখে: “হে মুহাম্মদ, তুমি তো বলে বেড়াচ্ছ যে আত্মীয়স্বজনদের প্রতি সদয় হতে হবে, কিন্তু এখানে তুমি আমাদের নিঃস্ব করে দিচ্ছ।” তখন নবিজি (সা) খাদ্য সরবরাহ আবার চালু করার অনুরোধ জানিয়ে সুমামাকে বার্তা পাঠান। ফলে মক্কার লোকদের কাছে আবার খাবার সরবরাহ শুরু হয়।
আরও পড়ুনঃ