ধর্মতাত্ত্বিকতার নিরিখে হুদায়বিয়া থেকে শিক্ষণীয় | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

ধর্মতাত্ত্বিকতার নিরিখে হুদায়বিয়া থেকে শিক্ষণীয় | হুদায়বিয়ার সন্ধি ( চুক্তি )-৫, ক. সুহায়েল ইবনে আমর আলোচনার জন্য আসার পর নবিজির (সা) প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা জানি, আমাদের ধর্মে কোনো কিছুকে ‘শুভ লক্ষণ’ বলতে হলে দুটি শর্ত পুরণ করা বাঞ্ছনীয়: (১) একটি ইতিবাচক চিহ্ন বা বার্তা থাকতে হবে; নেতিবাচক কিছু থাকা চলবে না; (২) বার্তাটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে।

ধর্মতাত্ত্বিকতার নিরিখে হুদায়বিয়া থেকে শিক্ষণীয় | হুদায়বিয়ার সন্ধি ( চুক্তি )-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

ধর্মতাত্ত্বিকতার নিরিখে হুদায়বিয়া থেকে শিক্ষণীয় | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

খ. মুসলিমরা হুদায়বিয়ায় থাকার সময় একদিন প্রবল বৃষ্টি হয়েছিল। তখন তাঁদের মধ্যে দু-একজন মন্তব্য করেন, অমুক-অমুক নক্ষত্রের কারণে বৃষ্টি হয়েছে । পরদিন সকালে ফজরের নামাজের পর নবিজি (সা) বললেন, “আল্লাহ গত রাতে আমাকে বলেছেন, ‘মুমিনদের কেউ কেউ আমার প্রতি ইমান এনে ঘুম থেকে জেগেছে, আবার তাদের কেউ কেউ আমাকে বাদ দিয়ে নক্ষত্রের প্রতি ইমান এনে ঘুম থেকে জেগেছে।” অর্থাৎ যারা বলেছে নক্ষত্রের কারণে বৃষ্টি হয়েছে তারা আল্লাহকে প্রত্যাখ্যান করেছে; যারা বলেছে বৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর আশীর্বাদ ও রহমতের কারণে তারা আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছে।

কিছু সাহাবি তখনও কিছু প্রাক-ইসলামি কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন; তাঁরা বৃষ্টিকে একটি নির্দিষ্ট নক্ষত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছিলেন। ইসলামে এটা হারাম । আমাদের সময়েও ‘সৌভাগ্যের পাথর’ জাতীয় বিষয়ের ওপর মানুষের একই রকম বিশ্বাস আছে, যা হারাম। সাহাবিরা নক্ষত্রের সঙ্গে বৃষ্টিকে সম্পর্কিত করলেও নিঃসন্দেহে আল্লাহকে প্রত্যাখ্যান করতে চাননি। তবু আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তাঁরা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ থেকে আমরা বলতে পারি, আপনি যদি অর্থ না বুঝে এমন কথা বলেন, তবে তা হবে ‘ছোট শিরক’। আর যদি আপনি অর্থ বুঝে বলেন, তবে তা হবে ‘বড় শিরক’।

গ. হুদায়বিয়ার অন্যতম প্রধান শিক্ষা হচ্ছে ‘তাওয়াক্কুল’ বা আল্লাহর ওপর ভরসা। কোনো কিছু ঘটলে কেন ঘটল তা আমরা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারি না। আপাতভাবে অনেক সময় তা আমাদের কাছে অন্যায্য ও ক্ষতিকর বলে মনে হতে পারে। সঠিক কারণ শুধু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই জানেন, আমরা জানি না। তাওয়াক্কুলের মূল বিষয় হলো আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং আল্লাহর কাছ থেকে সর্বোত্তম প্রাপ্তি আশা করা । হুদায়বিয়ার ঘটনা আল্লাহর ওপর ভরসার একটি নিখুঁত উদাহরণ। এমনকি নবিজিও (সা) জানতেন না তিনি উমরকে (রা) কী জবাব দেবেন। তিনি শুধু বলেছিলেন, “আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেন।”

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

ঘ. আমরা কোরান ও সুন্নাহর চেয়ে ভালো জানি না। উমর (রা) ও সাহল ইবন হানিফ (রা) উভয়েই বলেছিলেন, ধর্মকে দোষারোপ করার আগে নিজের মতের বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করা উচিত। কোরান ও সুন্নাহে স্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ থাকলে ‘আমি মনে করি’, ‘আমার মত হলো’ ইত্যাদি বলার অবকাশ নেই।

ঙ. নবিজি (সা) কি পড়তে বা লিখতে পারতেন? এ প্রসঙ্গে এক বিরাট বিতর্ক শুরু হয় যখন আন্দালুসের বিখ্যাত মালিকি আলেম আবুল ওয়ালিদ আল-বাজি (মৃ. ৪৭৪ হিজরি) দাবি করেন যে নবিজি (সা) পড়তে ও লিখতে পারতেন। ব্যাপারটি জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তখন অন্য আলেমগণ বলেন, “কোনো ব্যক্তি যদি দাবি করে যে, নবিজি (সা) পড়তে ও লিখতে পারতেন, তাহলে সে কাফের।”

কারণ, পবিত্র কোরানের সুরা আরাফে আল্লাহ বলেছেন যে, মুহাম্মদ (সা) ছিলেন একজন নিরক্ষর (‘উম্মি’) নবি (৭:১৫৭)।আল-বাজির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়। তৎকালীন সুলতান তাঁকে ডেকে বলেন, “সব আলেম আপনাকে কাফের বলে অভিযুক্ত করছেন, কারণ আপনি কোরানের আয়াতকে অস্বীকার করেছেন, কারণ আপনি বলেছেন যে নবিজি (সা) পড়তে ও লিখতে পারতেন।”

আল-বাজি: আমার কাছে সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে যে, তিনি পড়তে ও লিখতে পারতেন।

সুলতান: কী সেই প্রমাণ?

আল-বাজি (সহিহ বুখারির হাদিস উল্লেখপূর্বক): হুদায়বিয়ার সময় যখন আলি ইবনে আবি তালিব ‘রসুলুল্লাহ’ কথাটি মুছে ফেলতে অস্বীকার করেন, তখন নবিজি (সা) কিতাবটি নিয়ে নিজেই লেখেন ‘মুহাম্মদ ইবনে আবদিল্লাহ’। অন্য আলেমগণ: কিন্তু কোরানের আয়াতে তো বলা হয়েছে যে তিনি একজন নিরক্ষর নবি ছিলেন; তার ব্যাখ্যা কী?”

আল-বাজি: ওই আয়াতে নবিজির (সা) নবুওয়তের প্রাথমিক পর্যায়ের কথা বর্ণনা করা হয়েছে । কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি পড়তে ও লিখতে শিখেছিলেন।

অন্য আলেমগণ: আপনি কীভাবে এই আয়াতটি ব্যাখ্যা করবেন—’তুমি তো এর পূর্বে কোনো কিতাব পড়নি বা নিজ হাতে কোনো কিতাব লেখনি যে মিথ্যাবাদীরা সন্দেহ করবে’? [২৯:৪৮]

আল-বাজি: এই আয়াত বরং আমার মতের পক্ষে এবং আপনাদের মতের বিরুদ্ধে প্রমাণ। কারণ এখানে বলা হয়েছে, ‘কোরান নাজিলের আগে থেকে তুমি (মুহাম্মদ) কোনো কিতাব পড়নি বা লেখনি।’ (অর্থাৎ কোরান নাজিল হওয়ার পরে নবিজি (সা) পড়তে ও লিখতে শিখেছিলেন।)

শেষ পর্যন্ত অন্য আলেমরা তাঁকে যুক্তি দিয়ে পরাজিত করতে পারেননি। একপর্যায়ে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়, কারণ আল-বাজির কাছে কোরান ও সুন্নাহ থেকে যুক্তিপূর্ণ প্রমাণ ছিল। তাই তাঁরা এটাকে কুফর হিসেবে প্রমাণ করতে পারেননি। আল-বাজি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের এই মতের পক্ষে অটল ছিলেন।

যা-ই হোক, মুসলিম উম্মাহর সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমদের মত হলো, নবিজি (সা) নিরক্ষর ছিলেন। বুখারির যে হাদিসে বলা হয়েছে যে তিনি তাঁর নাম লিখেছিলেন, তার দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে:

 

ধর্মতাত্ত্বিকতার নিরিখে হুদায়বিয়া থেকে শিক্ষণীয় | হুদায়বিয়ার সন্ধি (চুক্তি)-৫ | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

১. তিনি কেবল তাঁর নাম লিখেছিলেন। সাধারণত দেখা যায়, যেসব মানুষ পড়তে ও লিখতে জানে না, তাদের অধিকাংশই অন্তত নিজের নামটি লিখতে পারে ।

২. তিনি নিজের নাম লিখেছিলেন—এই কথাটি আক্ষরিক অর্থে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা যখন বলি, ‘গভর্নর মহাসড়ক নির্মাণ করেছেন, তখন নিশ্চয়ই কথাটি আক্ষরিক অর্থ করি না যে গভর্নর নিজের হাতেই মহাসড়ক নির্মাণের কাজ করেছেন। বরং আমরা বুঝতে পারি যে গভর্নর মহাসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন।

আমরা হাদিসটি এভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি: নবিজি (সা) জানতেন না কীভাবে লিখতে হয়, কিন্তু তিনি কাউকে লিখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া [২৯:৪৮] আয়াত অনুসারে তিনি আগে লেখেননি মানে এই নয় যে তিনি পরে লিখেছিলেন। উপসংহারে আমরা [৭:১৫৭] আয়াত অনুসারে বলব, মহানবি মুহাম্মদ (সা) নিরক্ষর ছিলেন।

আরও পড়ুনঃ

Leave a Comment