আমিনা থেকে হালিমা | মহানবি মুহাম্মদের (সা) শৈশব, মহানবি মুহাম্মদের (সা) শৈশব ও কৈশোরে বেড়ে ওঠার সময় নিয়ে আলোচনা করব । এখানে একটি বাস্তব সমস্যা হলো, নবিজির (সা) জীবনের প্রথম ৩০ বা ৪০ বছর সম্পর্কে আমাদের কাছে খুব কমই তথ্য আছে। তুলনামূলকভাবে বলতে গেলে, আমাদের কাছে তাঁর জীবনের প্রথম ৫৩ বছরের যত তথ্য আছে তার পরিমাণ পরবর্তী ১০ বছরের তথ্যের অর্ধেকেরও কম হবে। আবার ওই ৫৩ বছরের তথ্যের বেশির ভাগই ৪০ বছরের পর থেকে; অর্থাৎ নবুয়ত প্রাপ্তির পরের। এটিই স্বাভাবিক। তবে মুসলিম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের যা কিছু জানার প্রয়োজন আছে, আল্লাহ তায়ালা নিশ্চয়ই তা সংরক্ষণ করেছেন।

আমিনা থেকে হালিমা | মহানবি মুহাম্মদের (সা) শৈশব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন
নবিজির (সা) জন্মের পরে তাঁর জীবন সম্পর্কে আমরা প্রথম যে বিষয়টি জানি তা হলো তাঁর মা তাঁকে কিছু সময়ের জন্য বাড়ি থেকে দূরে মরুভূমিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এই বিষয়টি আমাদের কাছে কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলেও এটিই ছিল সেই সময়ের অভিজাত কুরাইশদের মধ্যে প্রচলিত রীতি। এই রীতিটি তদানীন্ত ন সমাজে আভিজাত্যের প্রতীক হওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ ছিল:
১) কুরাইশরা মনে করত, শিশুদের একটি বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বড় করা প্রয়োজন। সেই সময়ে (এমনকি আজ থেকে ১০০ বছর আগেও) শিশুমৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি। সুতরাং কুরাইশরা শিশুদের সুরক্ষার জন্য তাদেরকে স্বাভাবিক সামাজিক পরিবেশ ও অনেক মানুষের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে চাইত। যেহেতু প্লেগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ মানুষের সংস্পর্শেই ছড়ায়, একজনের সংস্পর্শে অন্যজন সংক্রমিত হয়, সেহেতু শিশুকে মানুষের থেকে দূরে রাখলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বলে মনে করা হতো।
২) কুরাইশরা সন্তানের স্ট্যামিনা বা প্রাণশক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি মরুভূমির রুক্ষ জীবনযাপনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার উপযুক্ত করে তুলতে চাইত। সেই যুগে মক্কার জীবনযাত্রা এমনিতেই ছিল অনেক কঠিন। তারপরও তারা তাদের সন্তানদের অল্প বয়সেই আরও শক্ত পরিবেশে বড় করতে চাইত, যাতে তারা পরে। মক্কার কষ্টকর জীবনের সঙ্গে সহজেই মানিয়ে নিতে পারে।
আমরা জানি, বাচ্চারা বড়দের তুলনায় অনেক সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এটা প্রকৃতিগত একটা ব্যাপার। আল্লাহই আমাদেরকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, কুরাইশরা এ ব্যাপারে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে চিন্তাভাবনা করত। তারা মনে করত, সন্তানরা অল্প বয়সে কষ্ট করলে পরবর্তী সময়ে মক্কায় জীবনে অতটা কষ্ট পাবে না।
৩) পিতামাতা হিসেবে আমরা আমাদের সন্তানদের সঙ্গে যত কঠোরই হই না। কেন, তারা কোনো ভুল করলে পরিবারের অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ যেমন দাদা-দাদি, নানা-নানি চাচা-চাচিদের কাছ থেকে এক ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে থাকে। কিন্তু পরিবার থেকে দূরে মরুভূমিতে নিকট-আত্মীয়দের প্রশ্রয় পাওয়ার সেই সুযোগ নেই। কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিবেশে শিশুকে বড় করার জন্যও কুরাইশরা তাদের সন্তানদের পরিবারের নিরাপদ পরিমণ্ডল থেকে বাইরে দূরে পাঠিয়ে দিত।

৪) যেসব উপজাতির মধ্যে শিশুরা বেড়ে উঠত, তারা আরবি ভাষা শুদ্ধ ও সাবলীলভাবে ব্যবহারের জন্য পরিচিত ছিল। সাধারণত শহরাঞ্চলে ভাষার বিশুদ্ধতা হারিয়ে যায়। সেখানে অন্য ভাষা ও সংস্কৃতির শব্দ ঢুকে যায়। (উদাহরণস্বরূপ, আধুনিককালের আরবি সংবাদপত্রের শতকরা ৩০ ভাগই ইংরেজি শব্দ)। মক্কার বাইরে মরুভূমিতে আরবি ভাষায় অন্য ভাষা-সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটার সম্ভাবনা ছিল না। এই ব্যাপারেও আরবরা দীর্ঘমেয়াদে চিন্তাভাবনা করেছে: তারা তাদের সন্তানদের সঠিক পরিবেশে খাঁটি আরবি শেখাতে চেয়েছে। উল্লেখ্য, সেই সময়ে মক্কার বাইরে শিশুদের প্রতিপালনের জন্য সবচেয়ে নামকরা গোত্র ছিল বনি সাদ ইবনে বকর। নবিজি (সা) এই উপজাতির এক পরিবারেই লালিত- পালিত হয়েছিলেন।
একটি সহিহ হাদিসে আছে, নবিজিকে (সা) নিজের সম্পর্কে বলতে বললে তিনি বলেছিলেন, “আমি আমার পিতা ইব্রাহিমের দোয়ার ফসল, আমি আমার ভাই ইসার দেওয়া সুসংবাদ; এবং বনি সাদ ইবনে বকর আমাকে লালন-পালন করেছিল।” আনুষঙ্গিকভাবে, কিছু মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদের মতে যিশুখ্রিষ্ট নিউ টেস্টামেটে’ যে ‘সুসংবাদ’-এর উল্লেখ করেছেন, নবিজিও (সা) সে কথাই বলেছেন । আল্লাহ তায়ালাও পবিত্র কোরানে সেটার স্বীকৃতি দিয়েছেন: ” (স্মরণ করো), যখন মরিয়মপুত্র ইসা বলেছিল, ‘হে বনি ইসরাইল! আমি আল্লাহর একজন রসুল, যাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে তাওরাতের (যেটুকু অবশিষ্ট আছে) তা সমর্থন করতে, আর তোমাদের সুসংবাদ দিতে একজন রসুলের যিনি আসবেন আমার পরে, যার নাম হবে আহমান।” [সুরা সাফ, ৬১:৬)
আমরা সবাই নবিজির (সা) পালক মা হালিমা আস-সাদিয়ার কাহিনি জানি। হালিমা এই কাহিনিটি নিজেই বর্ণনা করেছেন। সে সময় আরবভূমিতে দুর্ভিক্ষজনিত খাদ্য ও অর্থসংকট বিরাজ করছিল। হালিমা এবং তার স্বামীও তখন অর্থকষ্টে ভুগছিলেন। তাঁরা দুজনে তাদের একজন দুগ্ধপোষ্য সন্তানসহ বনু সাদ গোত্রের একদল মহিলার সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে ২-৩ বছরের জন্য দুধপান করবে এমন শিশুর খোঁজে মক্কায় যান। এ ব্যাপারে হালিমা তাঁর স্বামীকে রাজি করেছিলেন।
মরুভূমির বাসিন্দাদের আয় বেশি ছিল না। তাই তারা মক্কায় গিয়ে অর্থের বিনিময়ে ধনী ও অভিজাত কুরাইশদের কাছ থেকে সন্তানদের দত্তক নিতেন। এটা এক ধরনের বাৎসরিক রেওয়াজ ছিল। সবাই ওই সময়টার কথা জানত যখন এক সপ্তাহের জন্য তারা মক্কায় গিয়ে সদ্যোজাত শিশু-সন্তানের মায়েদের দ্বারস্থ হতো। সেখানে মায়েরা তাঁদের সবচেয়ে বেশি পছন্দের ধাত্রীকে বেছে নিতেন, ঠিক যেমনটি আমরা আমাদের সময়ে আয়া বা ন্যানি নির্বাচন করি।
তখন হালিমার সদ্য একটি সন্তানের জন্ম হয়েছে। তা ছাড়া তাঁর শায়মা নামে সাত-আট বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তানও ছিল। তাঁর নিজের একটি নবজাতক শিশু থাকায় তিনি সহজেই আরেকটি শিশুকে বুকের দুধ পান করাতে এবং যত্ন নিতে সক্ষম ছিলেন। হালিমা মক্কায় গিয়ে একটা এতিম শিশুর কথা শুনতে পেলেন যাকে কোনো মহিলা নিচ্ছিল না। শিশুটি আবদুল মুত্তালিবের নাতি হওয়া সত্ত্বেও পিতৃহীন বলে কেউ তাকে গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। কারণ, দুধপান করানোর জন্য দুগ্ধপোষ্যের পিতার কাছ থেকে উত্তম বিনিময় লাভের প্রত্যাশা সবারই ছিল।
কিন্তু ওই শিশুটি পিতৃহীন হওয়ায় তাঁর ক্ষেত্রে তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই বলে মহিলাদের মনে হয়েছিল। যে শিশুর মা বিধবা এবং দাদা বৃদ্ধ, তাকে লালন-পালন করার বিনিময়ে কী আর পাওয়া যাবে—এ রকম ভাবনা থেকে ধাত্রীদের কেউ ওই শিশুটিকে নেওয়া দূরের কথা, এমনকি আমিনার বাড়িতেই গেল না। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে ধাত্রীদলের সবাই একজন করে শিশু সংগ্রহ করে ফেলেছে। হালিমার পক্ষে তখনও কোনো শিশু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। ফিরে যাওয়ার সময় যতই ঘনিয়ে আসতে লাগল, হালিমার মনটা ততই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। তিনি কিছুটা বিব্রতও বোধ করতে লাগলেন ।
শেষমেশ তিনি স্বামীকে বললেন, “আমার সঙ্গিনীরা সবাই একজন না একজন শিশু নিয়ে ফিরছে, আর আমাকে খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। তার চেয়ে আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে এই এতিম শিশুটিকেই নিয়ে যাই।” তাঁর স্বামী বললেন, “আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি গিয়ে তাকেই নিয়ে এসো। এমনও তো হতে পারে যে আল্লাহ এই শিশুটির মাধ্যমেই আমাদের জন্য কোনো বরকত নিহিত রেখেছেন।” হালিমার কথায়, “এমন এক অবস্থার প্রেক্ষাপটে আমি শিশু মুহাম্মদকে (সা) দুধপান করানোর জন্য গ্রহণ করলাম।”
বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, শিশু মুহাম্মদকে (সা) দত্তকরূপে গ্রহণ করার পর থেকেই হালিমা ও তাঁর পরিবারকে কেন্দ্র করে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটতে শুরু করে। মক্কা থেকে ফিরে যাওয়ার সময় হালিমা ও তাঁর স্বামী মুহাম্মদকে (সা) নিয়ে তাঁদের দুর্বল ও নিজে গাধার পিঠে ওপর সওয়ার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাধাটি দলের সবাইকে পেছনে ফেলে দ্রুত বেগে এগিয়ে যেতে শুরু করে। তাঁদের একটি বয়স্ক ছাগল ছিল, সেটি দীর্ঘকাল ধরে আর দুধ দিত না। কিন্তু শিশু মুহাম্মদকে (সা) তাঁবুতে নিয়ে আসতে না আসতেই ছাগলটি আবার দুধ নিতে শুরু করেছিল।
যাত্রী হালিমা ও তাঁর পরিবারের সযতু লালন-পালনে দুটি বছর কেটে যায়। সেই দুই বছরে হালিমার পরিবারে সচ্ছলতা এসেছিল; তাই তিনি মুহাম্মদকে (সা) আরও কিছুকাল রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি এ বিষয়ে মা আমিনার কাছে নানা ধরনের যুক্তি তুলে ধরেন। আমিনা তাতে রাজি হয়েছিলেন, যদিও তিনি হালিমাকে অন্য ধাত্রীদের সমতুল্য পারিশ্রমিক দিতে পারেননি। হালিমার জন্য অর্থটাই বড় ছিল না। মুহাম্মদকে (সা) লালন-পালনের ফলে তাঁর সংসারে আসা বরকতগুলোই ছিল তাঁর কাছে মুখ্য বিষয়। যা-ই হোক, হালিমার পরিবারে এই দ্বিতীয়বার থাকার সময়েই নবিজির (সা) বক্ষ উন্মুক্ত করার বিখ্যাত ঘটনাটি ঘটে।
আরো পড়ূনঃ