নবিজির (সা) ছোটবেলায় সিরিয়ায় যাওয়া। আসলেই কি তা ঘটেছিল? | মহানবি মুহাম্মদের (সা) শৈশব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

নবিজির (সা) ছোটবেলায় সিরিয়ায় যাওয়া। আসলেই কি তা ঘটেছিল? | মহানবি মুহাম্মদের (সা) শৈশব, নবি করিমের (সা) ছোটবেলায় সিরিয়া-যাত্রার কাহিনি আলোচনা । সুনানে আল তিরমিজিতে এই কাহিনিটির উল্লেখ আছে। এখানে একটি বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে, আমরা নবিজির (সা) জীবনের যেসব কাহিনি জানতে পারি তার বেশির ভাগই সিরাহ গ্রন্থগুলো থেকে এসেছে, হাদিস গ্রন্থগুলো থেকে নয়। এই সিরাহ গ্রন্থগুলো (যেমন ইবনে ইসহাক, ইবনে সাদ ইত্যাদি) হাদিস গ্রন্থগুলো (যেমন বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাই, ইবনে মাজাহ, মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, মুসনাদ আহমদ ইবনে হাম্বল ইত্যাদি) থেকে বিশুদ্ধতার মানদণ্ডে এক ডিগ্রি কম। আমাদের ফিকহ, ধর্মতত্ত্ব, নৈতিকতা এবং আইনি বিষয়গুলো কোরানের পর হাদিসের ওপর ভিত্তি করে রচিত।

 

 

নবিজির (সা) ছোটবেলায় সিরিয়ায় যাওয়া। আসলেই কি তা ঘটেছিল? | মহানবি মুহাম্মদের (সা) শৈশব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

নবিজির (সা) ছোটবেলায় সিরিয়ায় যাওয়া। আসলেই কি তা ঘটেছিল? | মহানবি মুহাম্মদের (সা) শৈশব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

সিরাহে উল্লিখিত অনেক ঘটনাই সহিহ হাদিস ও ধর্মতত্ত্বের বিচারে সঠিক নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলোর বর্ণনায় কোনো সমস্যা নেই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা সমস্যার মধ্যে পড়ে যাই। নবিজির (সা) বাল্যকালে সিরিয়ায় গমনের কাহিনিটিও সেরকমই একটি কাহিনিটি হলো:

নবিজির (সা) বয়স যখন ১১-১২ বছর, তখন তাঁর চাচা আবু তালিব তাঁকে ব্যবসার কাজে সিরিয়া নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আবু বকর এবং বেলালকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পথে একসময় তাঁরা একটি আশ্রম বা মঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই আশ্রমে বুহায়রা নামের এক সন্ন্যাসী বাস করতেন, যিনি কখনই দিনের বেলায় বাইরে বের হয়ে কারও সঙ্গে দেখা করতেন। না। কিন্তু আবু তালিব ও তাঁর কাফেলা (যার সঙ্গে বালক মুহাম্মদও (সা) ছিলেন) সেখানে গেলে বুহায়রা তাঁদের সঙ্গে সাথে দেখা করতে বিহার থেকে বেরিয়ে আসেন।

এমনকি বুহায়রা তাদেরকে সম্ভাষণ জানিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে ভোজের ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, “তোমাদের মধ্যে একটি বালক আছে, যে এক সময় নবি হবে।” কীভাবে সেটা জানলেন তা জিজ্ঞেস করা হলে বুহায়রা এ কারণেই এতিমদের দেখভাল করা ও যত্ন নেওয়াকে উৎসাহিত করে অনেক হাদিস রয়েছে। নবি করিম (সা) বলেছেন, “এতিমদের দেখভালকারী ব্যক্তি ও আমি জান্নাতে ‘এরকমভাবে’ থাকব” এ কথা বলে তিনি তার তর্জনী এবং মধ্যমা একত্র করে দেখিয়েছিলেন (অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এতিমদের দেখভালকারী ব্যক্তি তার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে)।

নবিজি (সা) আরও বলেছেন, “যখন তোমরা কোনো এতিমকে দেখতে পাও তখন তার সঙ্গে ভাে কথা করে বলো এবং তার মাথার ওপরে হাত রেখো।” অর্থাৎ ‘এতিমদের সঙ্গে স্নেহময় আচরণ করো। নিশ্চয়ই নবিজি (সা) এ কথা বলার সময় তাঁর নিজের শৈশবের সময়কে স্মরণ করছিলেন।বলেন, “গিরিপথের দিক থেকে তোমাদের এগিয়ে আসাটা যখন ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচরে আসছিল, তখন আমি দেখলাম যে একটি মেঘমালা তাকে ছায়া দিচ্ছে। একই সাথে গাছগাছালিও তাকে ছায়া দিচ্ছে, আর পাথরগুলোও তাকে সেজদা করছে।” তারপর বুহায়রা আবু তালিবকে বালকটির প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে বলেন।

 

islamiagoln.com google news
আমাদের গুগল নিউজে ফলো করুন

 

তাঁরা যখন আহার করছিলেন, তখন সেখানে সাতজন রোমান সৈন্য উপস্থিত হয়। সৈন্যরা একজন অনাগত নবিকে খুঁজছিল, পেলে তারা তাঁকে হত্যা করবে। এ অবস্থায় বুহায়রা আবু তালিব ও তাঁর সঙ্গীদের আড়ালে নিয়ে গিয়ে অবিলম্বে মক্কায় ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। তিরমিজি, ইবনে হাজার, আল-হাকিমসহ বেশিরভাগ ইতিহাসবিদই এই কাহিনিটিকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন। আবার ইমাম আল-ধাহাবি, ইবনে কাসির এবং ইবনে সাইয়িদ আল-নাসসহ অনেকে সমালোচনা করে বলেছেন যে, কাহিনিটির মধ্যে কিছু গোলমাল আছে।

ইমাম আল-ধাহাবি ছিলেন সপ্তম শতাব্দীর অন্যতম সেরা ইতিহাসবিদ। তিনি অত্যন্ত সমালোচনামূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মনের অধিকারী ছিলেন, কোনো কিছুই যাচাই-বাছাই না করে গ্রহণ করতেন না। কাহিনিটি ও এর বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি গভীরভাবে পর্যালোচনা ও চিন্তা করেছিলেন। আল-ধাহাবি এই কাহিনির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর প্রশ্নগুলো ছিল এই:

—আবু বকর তখন মাত্র একটি শিশু ছিলেন, আবু তালিবের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না; তাহলে কেন তিনি আবু তালিবের সঙ্গে কাফেলায় যাবেন?

—বেলাল তো তখনও জন্মগ্রহণই করেননি; তিনি তো ইসলাম আসার পর আবু বকরের মালিকানায় আসেন! বেলাল কীভাবে এই কাহিনিতে এল? —মেঘমালাই যদি ইতিমধ্যে তাঁকে ছায়া দিয়ে থাকে, তাহলে গাছগাছালির কেন তাঁকে ছায়া দিতে হবে?

—মুহাম্মদ (সা) নবি হওয়ার পর আবু তালিবকে এই ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেননি কেন? তিনি তো আবু তালিবকে বলতে পারতেন, “বুহায়রা কি বলেননি যে আমি নবি হব?’ —বুহায়রা যদি আগেই ঘোষণা করে থাকেন যে মুহাম্মদ (সা) নবি হবেন, তাহলে কুরাইশরা কেন মুহাম্মদকে (সা) নবি হিসেবে মেনে নিতে পারছিল না? নবিজি (সা) কেন বুঝতে পারেননি জিব্রাইল কী উদ্দেশ্যে হেরা গুহায় তাঁর কাছে এসেছিলেন? তাঁর তো উচিত ছিল সেই সময়ের অপেক্ষায় থাকা এবং জিব্রাইলকে বলা, ‘তুমি কেন এত দেরি করে এলে? আমি তো তোমার জন্য গত বিশ-তিরিশ বছর ধরে অপেক্ষায় ছিলাম।’ কেন তিনি এত ভয় পেয়েছিলেন, আতঙ্কিত হয়েছিলেন?

ওয়ারাকার কাছে গিয়ে কেন ঘটনাটি ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল? কিছু স্কলার আবার কাহিনির সপক্ষে বলেছেন, “ঠিক আছে, ধরে নিন গল্পটিতে বেলাল এবং আবু বকরের উপস্থিতির বিবরণ ভুল ছিল। গল্পের বাকি অংশকে সত্য বলে মেনে নিন।” এর জবাব হচ্ছে। প্রথমত, বেলাল ও আবু বকর একই গল্পের অংশ। যদি আপনি গল্পটির কিছু অংশ প্রত্যাখ্যান করেন, তাহলে আপনাকে বাকি অংশও প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আপনি একই গল্পের কিছু নেবেন, আর অন্য কিছু নেবেন না, তা তো হতে পারে না।

দ্বিতীয়ত, এই গল্পটি নিয়ে অন্য যে সমস্যা তা হলো: আমাদের সময়ের বেশিরভাগ অমুসলিম ইতিহাসবিদ ও গবেষক এই গল্পটির মধ্যে এমন উপাদান খুঁজে পান, যা তাঁদের মনগড়া ধারণাকে সমর্থন করে। তারা বলেন, “দেখুন! কোথা থেকে মুহাম্মদ (সা) ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সম্পর্কে সমস্ত তথ্য পেয়েছিলেন।” কারণ আমরা তো জানি, মক্কায় সে সময় ইহুদি বা খ্রিষ্টানদের সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না। কোনো গ্রন্থাগার বা বইপত্র ছিল না।

 

নবিজির (সা) ছোটবেলায় সিরিয়ায় যাওয়া। আসলেই কি তা ঘটেছিল? | মহানবি মুহাম্মদের (সা) শৈশব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) জীবন

 

ওল্ড কিংবা নিউ টেস্টামেন্টও ছিল না। আরবরা কখনোই ইউসুফ (আ), মুসা (আ), ইসা (আ) প্রমুখ নবির কাহিনি জানত না। আসলে বনি ইসরাইলের সঙ্গে কুরাইশদের কোনো যোগসূত্রই ছিল না। তাই আজ পর্যন্ত অমুসলিম ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের কাছে কোনো সদুত্তর নেই যে কীভাবে শিক্ষা-দীক্ষায় অনেক পিছিয়ে থাকা একটি পরিবেশে থেকে মুহাম্মদ (সা) বনি ইসরাইলের ইতিহাস এত নির্ভুলভাবে বর্ণনা করেছেন।

[অমুসলিম ইতিহাসবিদ ও গবেষকরা তাঁদের মনগড়া ধারণা ব্যাখ্যা করার জন্য বুহায়রার কাহিনিটির মধ্যে উপাদান খুঁজে পান । আল্লাহ পবিত্র কোরানে উল্লেখ করেছেন “(হে মুহাম্মদ!) তুমি তো এর আগে কোনো কিতাব পাঠ করনি বা নিজহাতে কোনো কিতাব লেখনি যে মিথ্যাবাদীরা সন্দেহ করবে।” [সুরা আনকাবুত, ২৯:৪৮] আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন: “(হে মুহাম্মদ!) গায়েবের (অদৃশ্যলোকের) এসব সংবাদ আমি তোমাকে ওহির মাধ্যমে অবহিত করছি, যা এর পূর্বে তুমি জানতে না, আর তোমার সম্প্রদায়ও জানত না।

[সুরা হুদ, ১১:৪৯] বুহায়য়ার কাহিনিটি যদি সত্যও হয়, তবুও প্রাচ্যবিদদের দাবি হাস্যকর মনে হয়। কীভাবে একজন ১১ বছর বয়সী বালক মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে বিশ্বকোষের সঙ্গে তুলনীয় সমস্ত তথ্য মুখস্থ করে ৪০ বছর পরে তা আবার ব্যবহার করতে পারে? এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যা-ই হোক, আমাদের এত গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা শুধু আমাদের কিছু স্কলারের ব্যাখ্যা মেনে নিয়ে এটুকু বলব যে, বুহায়রার কাহিনিটি মনগড়া। আল্লাহ এ ব্যাপারে ভালো জানেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে, ইতিহাসের কালক্রমে অনেক লোকই জাল বা বানোয়াট হাদিস বানিয়েছে; কেউ ভালো উদ্দেশ্যে, কেউ-বা মন্দ উদ্দেশ্যে। একটা বহুলপ্রচারিত বানোয়াট হাদিস হচ্ছে, ‘কোরানের প্রত্যেকটি সুরার মধ্যেই বরকত আছে।’ ইমাম মহানবি মুহাম্মাদের (সা) জীবন ও সময় আহমদের প্রশ্নের জবাবে ওই লোক (বানোয়াট হাদিস বর্ণনাকারী) বলেছিল, “আমি লক্ষ করেছি যে মানুষ ফিকহ ও ইতিহাসের বিষয়বস্তু নিয়েই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

আমি চাইছিলাম তারা কোরান বেশি করে পড়ুক। তাই আমি ওই হাদিস বানিয়ে প্রচার করেছিলাম।” দেখা যাচ্ছে, এখানে উদ্দেশ্যটি ভালো। কিন্তু বানোয়াট হাদিস কখনোই সমর্থন করা যায় না, তা সে যে উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন। আমাদের ধর্মশিক্ষায় ‘হাদিস বিজ্ঞান’ একটি আলাদা শাখা হিসেবে স্বীকৃত।

আমাদের মনে রাখতে হবে, মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবনী লিখতে গিয়ে মানুষ আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেক কিচ্ছা-কাহিনি যোগ করেছে যা প্রথম যুগের সিরাহর গ্রন্থগুলোতে নেই। কিছু মানুষ শুধু শুধু বাড়িয়ে বলেছে এবং তা প্রচার করেছে। আমাদের এসব কল্পকাহিনির আশ্রয় নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এসব কাহিনি ছাড়াই নবিজি (সা) পৃথিবীর সেরা মানুষ। এসব কল্পকাহিনি বললে আমাদের ধর্মের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় না। বরং মানুষ ভাবে, এটি কোন ধরনের ধর্ম?’ আমাদের যা কিছু জানা প্রয়োজন, আল্লাহ তায়ালা তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন।

আরো পড়ুনঃ

 

Leave a Comment