সিরাহর প্রাথমিক উৎস | সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাক-ইসলামি আরব, মহানবি মুহাম্মদ (সা) জন্মেছিলেন ১,৪০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। এত বছর আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আমরা কীভাবে জানবা কোথা থেকেই বা জানব? এর উৎসগুলোই বা কী?
Table of Contents
সিরাহর প্রাথমিক উৎস | সিরাহ অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাক-ইসলামি আরব | মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ জীবন
১) পবিত্র কোরান:
সিরাহর প্রাথমিক উৎস হলো পবিত্র কোরান। মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বর্ণনা কোরানে লিপিবদ্ধ আছে। কোরানকে সিরাহর প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহারের বেশ কিছু সুবিধাও রয়েছে। যেমন:
- (ক) কোরান আল্লাহর বাণী হওয়ার কারণে এর সত্যতা নিয়ে কোনো রকম সন্দেহ নেই।
- (খ) কোরানের বাচনশৈলী অতুলনীয়।
- (গ) কোরানে অদৃশ্য (‘গায়েন’) বিষয়গুলোর বিশদ ব্যাখ্যা আছে। ইতিহাসবিদেরা শুধু বাহ্যিকভাবে দেখা বিষয়গুলোই লিপিবদ্ধ করে থাকেন। কিন্তু আপাতভাবে দেখা যায় না এমন অনেক বিষয়েরও বর্ণনা কোরানে রয়েছে (৪৭:২৯, ৩:১২৪, ৪৮:১)
তবে কোরানকে সিরাহর উৎস হিসেবে ব্যবহার করতে হলে দুটি বিষয়ে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। যেমন: (১) কোরান ক্রনোলজিক্যাল বা কালানুক্রমিক নয়, এবং (২) এতে অনেক ক্ষেত্রেই ঘটনার প্রেক্ষাপটের সরাসরি উল্লেখ নেই। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ কোরানে ওহুদের যুদ্ধের বর্ণনায় কোথাও “ওহুদ’ শব্দের উল্লেখ করেননি। কিন্তু আমরা জানি, সুরা আলে ইমরান ওহুদের যুদ্ধের সময়ে নাজিল হয়েছিল। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, সিরাহ এবং কোরান একটি আরেকটির পরিপূরক। কোরান বুঝতে যেমন আমাদের সিরাহ দরকার, তেমনি সিরাহ বোঝার জন্যও কোরান দরকার।
২) হাদিস:
প্রতিটি সহিহ হাদিসই যেন সিরাহর একটি করে ‘স্ন্যাপশট’ বা খণ্ডিত অংশ। লিখিত হাদিস থেকে মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবনের অনেক কিছুই জানা যায় । হাদিসের বইগুলোর মধ্যে সর্বাধিক খ্যাত ছয়টি (সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, সুনান আবু দাউদ, জামি আল-তিরমিজি, সুনান নাসা, এবং সুনান ইবনে মাজাহ) কুতুব আল-সিত্তাহ নামে অভিহিত।

৩) সিরাহগ্রন্থ (জীবনীগ্রন্থ):
মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবন নিয়ে প্রথম বই লেখা শুরু করেছিলেন সাহাবিদের সন্তানেরা। তাঁরা তাঁদের অভিভাবকদের কাছ থেকে নবিজি (সা) সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছিলেন। এ বিষয়ে প্রথম বড় আকারের বিবরণ লিখেছিলেন জুবায়েরের পুত্র উরওয়া। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট তাবেয়িন। তাঁর পিতা, মাতা, মাতামহ এবং ভাই—সবাই সাহাবি ছিলেন। উরওয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন নবিজির (সা) মৃত্যুর পরে, তাই তাঁকে আমরা সাহাবি বলতে পারব না।
নবিপত্নী আয়েশা (রা) ছিলেন তাঁর খালা। ‘মাহরাম’ (সম্পর্কে ভাগিনা) হওয়ার সুবাদে উরওয়ার আয়েশার (রা) সঙ্গে দেখা করার অধিকার ছিল। ফলে তিনি ফিকহ, হাদিস, তাফসির এবং সিরাহ বিষয়ে আয়েশার (রা) পক্ষে অন্যতম প্রধান বর্ণনাকারী ছিলেন।এ ছাড়া উসমান ইবনে আফফানের (রা) পুত্র আবান (মৃ. ১০৫ হিজরি) সিরাহর ওপর একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। সিরাহ-লেখক হিসেবে এরপরে যাঁর কথা উল্লেখ করতে হয় তাঁর নাম ইবনে শিহাব আল জুহরি (মৃ. ১২৯ হিজরি)।
দুর্ভাগ্যক্রমে, প্রথম সময়কালে লেখা ওই বইগুলোর অস্তিত্ব এখন আর নেই। কারণটি সহজেই অনুমেয়। পরবর্তীকালের বইগুলোতে প্রথম দিকের বইগুলোর বিষয়বস্তু এমনিতেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। যেহেতু সেই সময় ছাপাখানা ছিল। না, তাই কেউ বই লিখতে চাইলে তাঁকে পুরোটাই নিজের হাতে লিখতে হতো। ফলে কেউ যখন কোনো সিরাহের বই পড়তে বা অনুলিপি করতে চাইত, তখন সে স্বভাবতই পরবর্তী সময়ের আরও ভালোভাবে সংকলিত বই থেকেই বেছে নিত। তবে এর ঠিক পরের প্রজন্মের লেখা বইয়ের অস্তিত্ব এখনও আছে। এগুলো হাদিস সংকলনেরও আগে লেখা হয়েছিল।
প্রথম যুগের সিরাহ রচনাকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যক্তি হলেন মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক, যিনি ইবনে ইসহাক নামে সমধিক পরিচিত। তাঁর জন্য ৮৫ হিজরি সালে। তিনি মদিনায় বাস করতেন, এবং সাহাবিদের প্রথমদিকের উত্তরসূরিদের সান্নিধ্যে বড় হয়েছিলেন। তিনি কিছু সাহাবিকে তাঁদের জীবদ্দশায় পেয়েও থাকতে পারেন। ইবনে ইসহাক তাঁদের কাছ থেকে যা কিছু শুনেছেন তার কোনো কিছু বাদ না দিয়ে সবই লিখে গিয়েছেন। তিনি পূর্ববর্তী বইগুলো থেকে ঘটনাবলি কালানুক্রমিকভাবে সংকলন করতে শুরু করেছিলেন। এভাবে তিনি ১০- ১৫ খণ্ডের একটি খুব বড় বই লিখে ফেলেন। তিনি প্রাথমিকভাবে মদিনা থেকে তথ্য-উপাত্ত ও কাহিনি সংগ্রহ করলেও পরে একই উদ্দেশ্যে বসরা ও কুফাসহ বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করেছিলেন।
ইবনে ইসহাকের সিরাহর অন্যতম বিশেষত্ব হলো, তিনি বর্ণনাকারীদের নামধাম আদ্যোপান্ত (‘ইসনাদ’) সংকলন করেছিলেন। ইসলামি সাহিত্যে ইসনাদ একটি অনন্য বিষয়। এটি অন্য কোনো ধর্ম বা সংস্কৃতিতে নেই। কোনো একটি ঘটনা কোথা থেকে কীভাবে এসেছে তা ইসনাদের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, এবং সত্যতা যাচাই করতে পারি। আমরা কোনো একটি ঘটনার বর্ণনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি মানুষকে জানি; তিনি কখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, কবে মারা গেছেন, মুসলিম হিসেবে তিনি কেমন ছিলেন, তাঁর স্মৃতিশক্তি কেমন ছিল ইত্যাদি । ইবনে ইসহাক ১৫০ হিজরি সালে মৃত্যুবরণ করেন।

সিরাহ রচনার ক্ষেত্রে এরপরে যাঁর নাম নাম আসবে তিনি আবদ আল মালিক ইবনে হিশাম। তিনি ইবনে হিশাম নামে পরিচিত ছিলেন। যে কোনো সাধারণ মুসলিমের জন্য প্রথম দিকের প্রধান সিরাহগ্রন্থ সম্পর্কে জানতে হলে যে দুটি নাম। শুরুতেই আসবে তা হলো ইবনে ইসহাক এবং ইবনে হিশাম। ইবনে হিশামের বইটি ইবনে ইসহাকের বইয়েরই সংক্ষিপ্ত রূপ। ইবনে হিশাম বুঝতে পেরেছিলেন। যে, ইবনে ইসহাকের রচনাটি খুব বড় হয়ে গেছে। তাই তিনি সেটি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
তা করতে গিয়ে তিনি কোনো কিছু নতুন করে যোগ করেননি। বরং বেশ কিছু অংশ বাদ দিয়ে বইটিকে অনেক বেশি পাঠযোগ্য করেছিলেন। ইবনে হিশামের বইটি এখন চার খণ্ডে পাওয়া যায়। সেই যুগে কোনো ছাপাখানা না থাকায় কেউ কোনো বই সংগ্রহ করতে চাইলে তাকে তা আগাগোড়া পুরোটাই নিজের হাতে লিখে নিতে হতো। ইবনে হিশাম কর্তৃক ইবনে ইসহাকের রচিত সিরাহগ্রন্থটি সংক্ষিপ্তরূপে প্রকাশ করার এটিও একটি প্রধান কারণ।
ইবনে ইসহাক শুধু মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবনী রচনার ক্ষেত্রেই প্রথম ছিলেন না, তিনি ছিলেন মানবজাতির ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রেও প্রথম ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি আদম (আ) থেকে শুরু করে নুহ (আ), ইব্রাহিম (আ), মুসা (আ) হয়ে মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত সবার কাহিনিই ইতিহাস আকারে বর্ণনা করেছেন।
ইবনে হিশাম তাঁর গ্রন্থে ইবনে ইসহাক কর্তৃক বর্ণিত আগের নবিদের ইতিহাসসহ মহানবি মুহাম্মদের (সা) জীবনের কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বাদ দিয়েছিলেন। সময়ের আবর্তনে ইবনে হিশামের সিরাহগ্রন্থটিই জনপ্রিয় হতে শুরু করে। এখন কেউ চাইলে তাঁকে ‘সিরাতে ইবনে হিশাম’-ই কিনতে হবে। পুরো সিরাতে ইবনে ইসহাক’-এর কোনো অস্তিত্বই আজ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
সিরাহ রচনার কথা এলে ড. হামিদুল্লাহ (মৃ. ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ) নামে একজন প্রসিদ্ধ স্কলারের নামও চলে আসে। তিনি ওরিয়েন্টালিজম বা প্রাচ্যতত্ত্বের ওপর অন্যতম সেরা গবেষক ছিলেন। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট বহু পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার/উদ্ধার করেছিলেন। সেগুলোর মধ্যে একটি ইবনে ইসহাক রচিত সিরাহর আংশিক অনুলিপি, যা ছিল পুরো বইয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশের মতো। ড. হামিদুল্লাহ সেটি সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন।
এখন যদি আমরা দুটি সিরাহগ্রস্থকে তুলনা করি, তাহলে ইবনে হিশামের বক্তব্যের সত্যতা হুবহু খুঁজে পাব; অর্থাৎ তিনি ইবনে ইসহাকের রচনার প্রায় অর্ধেকটাই হেঁটে ফেলেছিলেন। ছেঁটে ফেলা অংশের মধ্যে ছিল দীর্ঘ কবিতা, আরবদের বংশকুলের বিশদ বিবরণ ইত্যাদির মতো বিষয়। আমরা আজ যখন ইবনে হিশাম রচিত সিরাহ পড়ি, তখন নিশ্চিতভাবেই জানি যে আমরা নবি করিমের (সা) মৃত্যুর আনুমানিক ১০০ বছরের মধ্যে লেখা কোনো জীবনীগ্রন্থ পড়ছি।
৪) নবিজির (সা) বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রচিত গ্রন্থঃ
নবিজির (সা) বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত এই রচনাগুলোকে আরবিতে ‘শামাইল’ বলা হয়। শামাইল হচ্ছে এমন এক ধরনের বই যা মহানবি মুহাম্মদের (সা) বর্ণনা, বৈশিষ্ট্য, আচার-আচরণ, বৈষয়িক সম্পদ, বাড়িঘর ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। এ বিষয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থটি হলো ‘শামাইল আল-তিরমিজি’।
৫) দালাইলঃ
‘দালাইল’ হলো নবিজিকে (সা) নিয়ে প্রচলিত ‘মিরাকল’ বা অলৌকিক বিষয়গুলো নিয়ে লেখা বই। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হলো আল বায়হাকি রচিত ‘আল-নুবুওয়াহ’। এটি ১২ খণ্ডের এক বিশাল রচনা । ৬) সাহাবিদের ইতিহাস: এর মধ্যেও আমরা সিরাহর অনেক উৎস খুঁজে পাই।
৭) মক্কা ও মদিনার ইতিহাস:
এখানেও সিরাহর উৎস রয়েছে। উপরে উল্লিখিত সবই সিরাহর প্রাথমিক উৎস। আধুনিক যুগের অনেকেই সিরাহ রচনা করতে গিয়ে এমন আরও কিছু উৎস যোগ করেছেন যা মুসলিমদের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। ইদানীং পাশ্চাত্য বিশ্বে রোমান ও পারস্য রাজত্বকালে সেখানকার মুসলিমদের সম্পর্কে যেসব রচনা ছিল সেগুলোকে কেন্দ্র করে এক ধরনের নতুন ধারার গবেষণা হচ্ছে।
আরো পড়ুনঃ